Advertisment

জোট এবং বাস্তবতা ও বাধ্যবাধকতা

একলা লড়াই করে পশ্চিমবঙ্গে হারানো কর্মী সমর্থকদের মনোবল যদি চাঙ্গা করা যায় তাতে কোন ক্ষতি নেই। নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিতে সরকার গড়ার প্রশ্ন যখন আসবে তখন এবিষয়টি আর ততটা তাৎপর্যপূর্ণ থাকবে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Opposition Alliance

সীতারাম ইয়েচুরি তো আর কবি শ্রীজাত নন যে বিজেপি বিরোধিতার নাম নিয়ে টপাস করে দিদির মঞ্চে উঠে পড়বেন

তেরোই ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে বিরোধী জোটের যে সম্মেলন হলো আপাত দৃষ্টিতে তা অতি তাৎপর্যমণ্ডিত। বিজেপি বিরোধী প্রায় সব দলই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় মধ্যমণি। সবাই একযোগে মোদীর বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন। অনেকটা ১৯৮৯ সাল মনে পড়লো। অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি নির্মাণের কথা উঠলো। একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার দাবিও উঠলো।
কিন্তু গোলাপে কিছু কন্টকও ছিল। পদ্মের পাপড়ি যতই প্রসারিত হোক তাকে গুটিয়ে ফেলা সম্ভব সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। সেই সম্মিলিত প্রচেষ্টার আকাঙ্ক্ষা বিলকুল থাকলেও রাজনীতিতে সব কিছু অত সহজে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না বলেই তা অসম্ভব, এমনটা নয়। কিন্তু তা থাকে কোনও এক অনাগত ভবিষ্যতের গর্ভে।

Advertisment

আরও পড়ুন, ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে মহাজোট

এই যেমন সিপিআইএম এর সীতারাম ইয়েচুরি কিংবা সিপিআই-এর ডি রাজা ধর্না মঞ্চে থাকলেও তৃণমূল নেতৃত্ব আসার একটু আগে সেখান থেকে চলে গেছেন। এটা অনেককেই বিস্মিত করলেও মনে রাখা প্রয়োজন যে স্বাভাবিক রাজনৈতিক সৌজন্য আর বাস্তব রাজনীতির মধ্যে কিছু তফাৎ আছে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলছেন যে বামপন্থীরা জাতীয় রাজনীতিতে একঘরে হয়ে পড়বেন। তাঁদের সাথে আমি একমত নেই। এখানে দুটো বিষয় প্রাসঙ্গিক। এক, নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শগত বাধ্যবাধকতা এবং দুই, সাংগঠনিক শক্তি। কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে ১৯৮৯ সালে জ্যোতি বসু আর অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন এক মঞ্চে মিটিং করেছিলেন তখন কি মতাদর্শগত বিভেদের প্রশ্নটিকে আলমারিতে তুলে রাখা হয়েছিল? যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে মতাদর্শভিত্তিক রাজনীতি যাঁরা করেন তাঁদের কাছে রণনীতি এবং রণকৌশল উভয়েই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কখনো যদি নীতি অগ্রাধিকার পায় তো কখনো কৌশল এগিয়ে থাকবে। ১৯৮৯তে উভয়ের একটি মেলবন্ধন ঘটেছিল। বিজেপি কেরল, ত্রিপুরা বা পশ্চিমবঙ্গ যেখানে যেখানে বামপন্থীরা শক্তিশালী সেই জায়গা গুলিতে আজকের মতো অবস্থানে ছিল না। সুতরাং বামপন্থীদের প্রবলভাবে কোন রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশ্ন ওঠেনি। কংগ্রেস ছিল প্রধান প্রতিপক্ষ। তাই রণকৌশলগত ভাবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যত বেশি সম্ভব দলের ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। ঘটেছেও তাই। কিন্তু মতাদর্শগত আপোস হয় নি। কোথাও বিজেপি আর বামপন্থীরা আসন সমঝোতা করেন নি।

এখন পরিস্থিতি জটিল। একদিকে মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপির আগ্রাসন ক্রমবর্ধমান। রাজ্যে রাজ্যে লড়াই এর প্রস্তুতি চলছে। জনজীবনে বামপন্থীদের আন্দোলন অব্যাহত থাকলেও স্থানিক তাৎপর্য হ্রাস পেয়েছে। এর মূল কারণ একদিকে যেমন বিজেপি অন্যদিকে তেমনি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের আধিপত্য। এই ক্ষেত্রে রণকৌশলকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে। সীতারাম ইয়েচুরি তো আর কবি শ্রীজাত নন যে বিজেপি বিরোধিতার নাম নিয়ে টপাস করে দিদির মঞ্চে উঠে পড়বেন। তাঁর একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা এবং দীর্ঘ আন্দোলনমুখী ঐতিহ্য আছে। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিরোধিতা এখন মাঝে মধ্যে কিছু মানুষের কাছে ছুতো বলে মনে হচ্ছে। বিজেপি যেভাবে তার আগ্রাসন চালাচ্ছে, বিরোধী মতকে পদদলিত করছে, যেভাবে চলছে রাজ্যপাট তার স্পষ্ট বিরোধিতা সময়ের দাবি। কিন্তু সেটাকেই অজুহাত করে ছুতোয়নাতায় তৃণমূল হয়ে যাওয়াটা কিছুটা আশ্চর্যজনক।

আসল প্রসঙ্গে আসি। শুধু বামেরাই বা কেন? কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ও বলেছেন যে কেরল ও পশ্চিমবঙ্গে প্রাক নির্বাচনী সমঝোতার প্রশ্নে কিছু অসুবিধা আছে। মনে রাখতে হবে যে এটাও তিনি রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকেই বলেছেন । পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের কাছে কংগ্রেস ক্রমাগত জমি হারিয়েছে গত দুই তিন বছরে। ফলে আপন অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ তাঁদের থাকতেই পারে। বিজেপি বিরোধিতা আবশ্যক। কিন্তু তাই বলে দলটা তো আর তুলে দেওয়া যায় না । পশ্চিমবঙ্গে একটি জোরালো অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই কংগ্রেসকে করতেই হবে। আবার বামপন্থীদের সাথে জোট করেও দেখা গেছে যে বিশেষ সুবিধা কিছু হয়নি। তাই একলা লড়াই করে পশ্চিমবঙ্গে হারানো কর্মী সমর্থকদের মনোবল যদি চাঙ্গা করা যায় তাতে কোন ক্ষতি নেই। নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিতে সরকার গড়ার প্রশ্ন যখন আসবে তখন এবিষয়টি আর ততটা তাৎপর্যপূর্ণ থাকবে না। ছোটখাটো তিক্ততাও হয়তো অপসারিত হবে।
কিন্তু কংগ্রেস বা বামপন্থীরা তো প্রকাশ্যে তাঁদের মতামত জানাচ্ছেন। অথচ যাঁরা বাইরে একরকম অন্তরে অন্য, তাঁদের নিয়ে কী হবে? সমাজবাদী পার্টি মমতার মঞ্চে একরকম বললেন। অখিলেশ যাদবের আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করলো। অথচ পিতা মুলায়ম বললেন যে তিনি আর একবার মোদীকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান। তাও আবার ভরা সংসদের অভ্যন্তরে। কী বলবেন? রণনীতি ও কৌশলের কোনটাই এখানে নেই। বিশুদ্ধ সুবিধাবাদ ।

উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি আর বহুজন সমাজ পার্টি আসন সমঝোতা করে ফেলেছিল । কিন্তু প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আসার পর আবার দোলাচল। কংগ্রেসকে নাকি কিছু বাড়তি আসন ছাড়া হতে পারে। তাতে উভয় তরফেই কিছু সমস্যা হলেও শেষ পর্যন্ত জয়ের হাসি কে হাসবেন বলা যাচ্ছে না। পিতা লালুপ্রসাদ অসুস্থ। পুত্র তেজস্বী চাইছেন একটা হেস্তনেস্ত হোক। পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি লোকে ভুলে যাক। তাই কখনো কলকাতায় এসে দিদি ভজনা, কখনো পটনায় ফিরে গিয়ে রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখার ঘোষণা। কিন্তু পরিস্থিতি যা মনে হচ্ছে দিল্লি আভি বহুত দূর হ্যায়।

(লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মতামত ব্যক্তিগত)

lok sabha 2019
Advertisment