হেমন্তের বুক ঝিম করা এক সন্ধে। কলকাতার বুকে বিকেল গড়ালে সামান্য হিমেল হাওয়া। ডিএল খান রোডের ওপর দাঁড়িয়ে ভবানীপুর সিমেট্রি। বাইরে বড়বড় করে লেখা ১৯০৭। নভেম্বরের ২ তারিখ। অল সোলস' ডে-র ভিড় বাড়ছে একটু একটু করে। প্রিয়জনের সমাধিতে একটু ফুল দিতে, মোম জ্বালাতে কলকাতার কত প্রান্ত থেকে মানুষ আসছেন এই একটা বিকেলে। দেখতে দেখতে প্রদীপের আলোয় ভরে উঠল চারপাশ। আলো এবং নৈশব্দে সন্ধের পথে পথে নেমে এল কার্তিকের রাত।
সস্ত্রীক গৌতম ভট্টাচার্য এসেছেন কাছ থেকেই, নেতাজী ভবনের কাছে কয়েক পুরুষের বাস। গৌতম বাবুর ঠাকুরদা ছিলেন বিদ্যাসাগরের অনুগামী। বিধবা বিবাহ সমর্থন করায় সমাজ তাঁকে মেনে নেয়নি। তাই খ্রিষ্ট ধর্মে আশ্রয় নেওয়া। প্রতি বছর এই দিনটায় এখানে আসেন গৌতম বাবু। পাশাপাশি শুয়ে থাকা পিসি আর পিসতুতো বোনের সমাধিতে ফুল ছড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, "আসলে সবাই সবার নিকট আত্মীয়দের হারিয়েছেন, তাঁদের কারোর জন্মদিনে, কারোর মৃত্যুদিনে আলাদা আলাদা করে সে সব দিনে সবাই আসেন এখানে, কিন্তু আজকের দিনটায় এই যে সবাই আসছি, এটা যেন আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষদের সঙ্গে দেখা করার দিন"। স্বাভাবিক নিয়মেই সদ্য স্বজন হারানোদের শোক কিছু বেশি। কারোর চোখে জল। প্রার্থনা করতে গিয়ে বুজে আসছে গলা। কান্না চাপতে ঘন ঘন ঢোক গেলা। আবার বিচ্ছেদে যাদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে, তাঁরা কিছুটা অন্য ভাবেও ভাবছেন। পাশের সমাধিতে প্রদীপ নিভে গেলে জ্বালিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের সঙ্গে করে আনা মোম।
বছর তিনেকের জেরম শুধু জানে ওর বড় দাদা 'পরম শান্তি'তে ঘুমিয়ে আছে ফুলে বিছোনো সমাধির নীচে, শুধু খেলতে ডাকলে ছুটে আসে না। তাই আশেপাশে কেউ হাত বাড়ালেই জেরম গায়ে গায়ে লেপটে থাকতে চায়, বলে "উইল ইউ প্লে উইথ মি?"। আরেকটু দূরের এক সমাধি ঘিরে বেশ জনা সাতেক মানুষের ভিড়। রোমা এসেছেন মেয়ে-জামাইএর আত্মার শান্তি কামনায়। সঙ্গে বোন গ্রেস এবং তাঁর পড়শিরা। গ্রেসের চোখে কিছুটা বিষণ্ণতা, মুখে উদ্বেগ। কথায় কথায় জানা গেল গ্রেসের মেয়ে কর্মসূত্রে কলকাতায়, কিন্তু ওদের বাড়ি শিলং-এ। ছেলে রয়েছে দেশের সেনাবাহিনীতে। ক'দিনের জন্য বাড়ি ফিরেছে। ছুটি শেষ হলে ফিরে যাবে জম্মুতে। মৃত্যুর কাছে এসে জীবনের কথা ভাবছে গ্রেস। হাতটা ধরে খুব নীচু স্বরে বলছে, "ওর জন্য একটু প্রার্থনা কোরো"।
আরও পড়ুন, পৃথিবী জুড়ে কেন হেমন্তেই হয় মৃত্যু-উদযাপন?
আরও একটু ভেতরের দিকে দেখা হয়ে গেল অ্যান্থনির সঙ্গে। এ কথা সে কথার পর অ্যান্থনি নিয়ে গেলেন জনি পুর্তির সমাধিতে। এই ক'বছর আগেও সেন্ট জোন্স চার্চে গেলে শোনা যেত অর্গানের মিষ্টি সুর। এক মনে বাজিয়ে যেতেন জনি। জনি আর নেই। এই শহরে আর কেউ অর্গান বাজাবে না। অ্যান্থনি না বললে জানতেই পারতাম না কিছু সুর ফুরিয়ে আসছে এক এক করে। কিছু গল্প শেষ হয়ে আসছে। প্রবহমান সময়ের কিছু কিছু অংশ প্রতি মুহূর্তে অতীত হয়ে যাচ্ছে।
নভেম্বরের সন্ধেয় ভবানীপুরের এই সমাধিক্ষেত্রে আসা প্রতিটা মানুষ যে রক্তের টানেই আসে, এমনটা নয়। কেউ আসে নিজের পুরোন পাড়ায়। কেউ আবার হাজার হাজার প্রদীপের মাঝে খুঁজে নেন সবচেয়ে অন্ধকার কোনটা, জ্বালিয়ে দেন একটা দুটো প্রদীপ।প্রতি বছর ডিসুজাকেও আসতে দেখেছি। বন্ধুর দাদুর সমাধিতে একটু ফুল দেবেন বলে। শৈশবেই বন্ধু ফিরে গিয়েছিল ব্রাজিল। ডিসুজা আজও আসেন ফুলের একটা তোড়া হাতে। দাদুর সমাধি খুঁজে না পেয়ে ফিরে যান একা একা। কেউ আসেন শুধু জীবনের টানে। একসঙ্গে এত মানুষ দেখতে পাবে বলে। প্রদীপ নিভতে থাকলে একে একে ফিরে যাওয়ার পালা। ফেরার সময় কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া কথা হয়, কিছু কুশল বিনিময়। ওরা জানে আলো থাকলে বেঁধে বেঁধে থাকতে হয়। অন্ধকারে আরও বেঁধে বেঁধে।