(রাজনীতি ও নৈতিকতা সবসময়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটে না, এমন আক্ষেপ শোনা যায় অনেকেরই মুখে। দৈনন্দিনতায়, ভাষণে, বয়ানে, চিন্তনে - ঠিক কোন কোন সময়ে সে দুইয়ের পথ আলাদা হয়ে যায়? এই কলামে সেই তফাৎ ঘটে যাওয়া মুহূর্তগুলি খুঁজছেন কৌশিক দত্ত।)
একটি জনপ্রিয় দৃশ্যকল্প মনে পড়ে যায় মাঝেমাঝে। বন্যায় উত্তাল নদীতে একটি গাছের ডাল ভেসে যাচ্ছে। প্রাণপণে সেই ডাল আঁকড়ে ভেসে আছে একজন মানুষ ও একটি সাপ। অনাদিকালের দুই শত্রু পরস্পরকে ছোবল দেবার কথা ভাবছে না, কারণ তখন তারা দুজনেই বন্যা নামক তৃতীয় শত্রুর দাপটে অসহায়। আপাতত সাপের কথা তোলা থাক। ভাবা যাক মানুষের সঙ্গে মানুষের অহিনকুল সম্পর্কটুকু নিয়ে, মূলত যা নিয়ে ইদানীংকালের রাজনীতি।
কী ঘটলে “মানুষের জন্য রাজনীতি” জাতীয় কিছু সম্ভব হবে? কোন পরিস্থিতিতে মানুষ সহমানুষকে শুধুমাত্র মানুষ ভাববে? এই বিষয়ে তত্ত্বজ্ঞরা যা বলেছেন, সাধারণ বুদ্ধির মানুষও তাই ভাববেন। প্রজাতি হিসেবে মানুষ যখন বেশি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়, যাকে পর্যুদস্ত করতে পারার উপর নির্ভর করছে মানুষের জীবন-মরণ, তখনই “মানুষ” নামক দলটির অস্তিত্ব বাস্তব হয়ে ওঠে।
তখনই এই জাতীয় সংহতি সম্ভব। রোগ-মহামারী চরিত্রগতভাবে এরকম শত্রু হলেও তা প্রায়শ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ রোগ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। কলেরা বসন্তের দেশকালে তাই মানুষ মানুষকে ফেলে চলে গেছে নিজেকে বাঁচাতে। সুপ্রাচীন অতীতে বন্যপ্রাণীদের কিছু ক্ষমতা ছিল ভয় দেখিয়ে মানুষকে সংহত করার, আজ তারা বড়ই অসহায়। আধুনিক পৃথিবীতে আমাদের মনে ভয়ের অনুভূতি জাগিয়ে মানুষকে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়তে বাধ্য করতে পারে একমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্প। এরা যখন আসে, মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়।
আরও পড়ুন, ব্যর্থ কে? কলকাতায় ফণী নাকি হুজুগে বাঙালি?
সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের হিংস্রতা এবং ঘৃণা দেখতে দেখতে ভয় হচ্ছিল কলহ ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সঙ্ঘবদ্ধ হবার ক্ষমতাই হয়ত আমরা হারিয়ে ফেলছি। ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত লাভের পিছনে ধাবিত হতে গিয়ে বিস্মৃত হচ্ছি যাবতীয় দায়িত্ববোধ। সেদিক থেকে বিচার করলে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় ফণী ক্রান্তিকালে কিছু স্বস্তি দিল। লোকসভা নির্বাচনের ঘোরতর কোন্দলের মুহূর্তে ক্ষমতাসীন রাজনেতারা দলগত পরিচয়ের বাইরেও মন্ত্রী বা সরকারি পদাধিকারীর পরিচয়গুলিকে মনে রেখে দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করলেন, এ বেশ ভরসা দেবার মতো ঘটনা।
ওড়িশায় ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনে দশ থেকে পনেরো হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এবার সেই রাজ্যের সরকার প্রায় এগারো লক্ষ মানুষকে উপকূলবর্তী এলাকা থেকে সরিয়ে নেবার ফলে মৃতের সংখ্যা অনেক কম। ঝড়ের তাণ্ডব এবং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি কম নয়, তবু মানুষের জীবন এভাবে বাঁচাতে পারা এক বিরাট ব্যাপার। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও ঝড়ের মোকাবিলায় উদ্যোগী ছিলেন। ভোটের প্রচার ছেড়ে ঝড়ে সতর্কবাণী প্রচারে ব্যস্ত থেকেছেন তাঁরা এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় সামলানোর জন্য আগাম ব্যবস্থাদি নিয়েছেন। ঝড় কোথাও তীব্র হয়েছে, কোথাও মৃদুতর, কিন্তু প্রকৃতির রোষের মোকাবিলায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি স্তরে এই যে মনোযোগী প্রস্তুতি, তা প্রশংসার্হ। রাষ্ট্রপুঞ্জও এই তৎপর ভারতের প্রশংসা করেছেন।
বস্তুত এটাই তো প্রগতির লক্ষণ। এটাই তো সুস্থ রাজনীতি। সবার উপরে মানুষ সত্য মনে রেখে যে রাজনীতি, তাই তো মানুষের। আশা জাগছে, যাঁদের বাড়িঘর জমি-ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হল, একইরকম দায়িত্ব ও মানবিকতার সঙ্গে তাঁদের আশ্রয় ও পুনর্বাসন দেওয়া হবে নির্বাচনের মধ্যে এবং তার পরেও। ভরসা হয়, এভাবেই ক্রমশ খরা, বন্যা, যক্ষা, অপুষ্টি, অশিক্ষা ইত্যাদি অনেককিছুর বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াতে পারি। সেই ক্ষমতা যে আমাদের মধ্যে আছে, প্রয়োজনে আমরা যে এখনো মানবিক হতে পারি অন্তত কিছুক্ষণের জন্য, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো ফণী। এই শিক্ষাটা যদি আমরা ধরে রাখি, এই “কিছুক্ষণ”কে যদি আমরা ক্রমশ প্রলম্বিত করতে পারি, তাহলে এখনো মানুষের ভবিষ্যৎ আছে।
স্বস্তি বা ভরসা তা বলে নিষ্কণ্টক নয়। নিপুণভাবে কোনো জরুরি কাজ করলে প্রশংসা সরকারের প্রাপ্য, কৃতিত্বও। সেই কৃতিত্বের প্রতিফলন ভোটের বাক্সে হতেই পারে। বস্তুত সেটাই হওয়া উচিত। সৎ প্রচেষ্টার পুরস্কার হিসেবে জনসমর্থন আসবে, এটাই সুস্থ রাজনীতি। কিন্তু প্রতিটি উদ্যোগের বিজ্ঞাপন আজকাল যেভাবে হয় (প্রায় সব দল, সব সরকারের তরফে), তাতে দুটো প্রশ্ন জাগে মনে। এক) সরকার (বিভিন্ন রাজ্যের এবং দেশের) কি আজকাল দায়িত্ব পালনকে স্বাভাবিক কর্তব্য বলে মনে করে না আর? দুই) মানুষের প্রাণ রক্ষা বা জীবনের মানোন্নয়ন কি মূল লক্ষ্য আদৌ, নাকি পুরো প্রচেষ্টাই শুধুমাত্র প্রচারযোগ্য কিছু বিষয়ের সন্ধানে? ভোট মিটে যাবার ঠিক পরেই এমন দুর্যোগ আবার হলে এই উদ্যোগ আবার দেখা যাবে তো? এই হল প্রথম কাঁটা। তবে এক্ষেত্রে সংশয়বাদকে দমিয়ে রেখে আশাবাদকেই প্রশ্রয় দেব, কারণ কিছু তারিফ সরকারের প্রাপ্য আর আঁকড়ে ধরার মতো আশাপ্রদ কোনো নোঙর আমাদেরও প্রয়োজন।
দ্বিতীয় কাঁটা হল সাধারণ মানুষের আচরণ। সরকারেরা ভালো হোক বা মন্দ, শেষ অবধি মানুষের শেষ ভরসা মানুষ। সমাজ কোন দিকে এগোবে বা পিছোবে, তাও অনেকটাই নির্ধারিত হয় সাধারণ মানুষের মনোভাবের দ্বারা। এই ক্ষেত্রে শিক্ষিত ও বাকপটু সাধারণ মানুষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁরা আশেপাশের অন্যান্য মানুষের ভাবনাকে প্রভাবিত করেন নিজেদের বাচন ও যাপনের দ্বারা। পথে-ঘাটে, সোশাল মিডিয়ায় গত সপ্তাহে শিক্ষিত নাগরিক মানুষকে খুব বেশি আত্মমগ্ন, সুখী ও চটুল মনে হল। এরই মধ্যে কয়েকজন অবশ্যই দুর্গতদের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিতে চেয়েছেন অচেনা মানুষকে। এসব উদ্যোগ প্রীতিকর, আশাব্যঞ্জক। এর বিপরীতে বিরাট সংখ্যক মানুষকে দেখলাম নিজের নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত করেই ঝোড়ো বিনোদনে মেতে উঠতে। যে সময়ে সচেতন মানুষের উচিত সম্ভাব্য বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারকে সাহায্য করা, ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু করা সম্ভব হলে করা, পাশের মানুষকে সচেতন করা, নিদেনপক্ষে নিজের কাজটুকু ঠিকমতো করে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলোকে যতটা সম্ভব চালু রাখা এবং মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে প্রণোদিত করা, সেই সময়ে অনেকেই ব্যস্ত রইলেন ঝড়ের চুটকি নিয়ে। কেউ বানাচ্ছেন, কেউ হাসছেন। ঝড়কে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনের আগে অপছন্দের কাউকে বেঁধার সুযোগটুকু ছাড়তে চাইছেন না এবং সেটা করতে গিয়ে দুর্যোগের মুহূর্তে মানুষে মানুষে বিভেদকেই বাড়িয়ে তুলছেন, যা একরকম নৈতিক অপরাধ। অতঃপর নিরাপদে টিভির সামনে বসে ধ্বংস দেখার ভয়ারিস্টিক সুখ। কভারেজ ভালো হচ্ছে না বলে মিডিয়াকে গালাগালি, অথচ ঝড়ের মুখে সমুদ্রের ধারে দাঁড়ানো সাংবাদিকও যে মানুষ এবং সে মরে যেতে পারে, সেই খেয়াল নেই। কেউ রোম্যাণ্টিক মেজাজে, সে থাকতেই পারেন। কিন্তু এই রাজ্যে ঝড়টা জমিয়ে হল না, ক্ষয়-ক্ষতি তেমন হল না বলে যে আক্ষেপ দেখা গেল, তা স্তম্ভিত করে দেবার মতো। এই কাঁটাটি গভীরভাবে বিঁধেছে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের ভূমিকা বা দায়িত্ব সম্বন্ধে যখন পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করে দেখলাম বেশিরভাগই মনে করেন, ওসব সরকারের দায়িত্ব। আমরা ভোট দিচ্ছি, ট্যাক্স দিচ্ছি, তারপর আবার এসব কেন? স্পষ্ট বোঝা যায় আত্মসর্বস্ব ভোগবাদী এক বিশেষ রাজনৈতিক বোধ আমাদের চেতনাকে গ্রাস করেছে। ছোটবেলায় আমরা সকলেই হান্স ব্রিংকারের গল্প পড়েছিলাম। পনেরো বছরের সেই ওলন্দাজ কিশোর নিজের আঙুল দিয়ে বাঁধের ফুটো বন্ধ করে শহরকে বন্যা থেকে রক্ষা করেছিল। হান্সের কাহিনিটি বাস্তব মানুষ না মেরি ম্যাপেসের সৃষ্ট, তা নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু কাহিনি থেকে যে শিক্ষাটুকু স্কুলবেলায় পেয়েছিলাম, তা এত তাড়াতাড়ি না ভুলে গেলেই ভালো। গণতন্ত্র মানুষের জন্য মানুষের ব্যবস্থা হয়ে উঠবে তখনি, যখন ভোট আর নোটের বাইরেও আমরা নিজেদের কর্তব্য খুঁজে পাবো।
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)