Advertisment

ভীতি ও অহংকার

মানুষকে যূথবদ্ধ করতে এবং অপর একটি যূথের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে মূলত দুটো উপাদানকে কাজে লাগানো যায়... “অহংকার” আর “ভীতি”।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Politics And Ethics Column

অলংকরণ- অরিত্র দে

মানুষের রাজনৈতিক লড়াই যেহেতু মূলত প্রজাতির অন্তর্দ্বন্দ্ব, তাই এর গোড়ার কাজটা হল সময়, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজন অনুসারে মানুষকে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ করে ফেলা এবং “অপর” হিসেবে চিহ্নিত গোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে সাময়িক এবং দীর্ঘস্থায়ী আদান-প্রদান ও সম্পর্কের ভিত্তিতে আঁতাত, সহযোগিতা, শান্তিপূর্ণ দূরত্ব বা সরাসরি শত্রুতা তৈরি করা। এসব গোষ্ঠীর নানা পরিচয় হতে পারে... দল, গ্রাম, সমীতি, জাত, দেশ, ধর্মসম্প্রদায়, ইত্যাদি। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বন্ধুত্ব বা শত্রুতার সম্পর্ক চিরকাল একইরকম থাকে না, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সুস্থির থাকে না ব্যক্তি মানুষের নির্দিষ্ট গোষ্ঠীভুক্তিও। শুধু যে গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নিরন্তর টানাপোড়েন চলতে থাকে, তাই নয়, গোষ্ঠীর অভ্যন্তরেও থাকে ব্যক্তিগত স্তরে নানা সংঘাত। ব্যক্তিগত সম্পর্কের উত্থান-পতন যুগেযুগে রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে ঠিকই, তবু রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সংঘাত বলতে আমরা যা বুঝি, তা প্রধানত গোষ্ঠীগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ককেন্দ্রিক।

Advertisment

গোষ্ঠী যেহেতু বিভিন্ন স্তরের এবং নানাধরণের তাই একই মানুষ একইসঙ্গে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্য হতে পারেন। যেমন একজন ব্যক্তি একটি দেশের নাগরিক, একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সমর্থক, একটি পেশার কর্মী, একটি ধর্মে বিশ্বাসী, ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচয় একত্রে বহন করতে পারেন। সুতরাং এর মধ্যে একটিমাত্র পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্ভুক্তি বা তার প্রতি আনুগত্য কোনো ব্যক্তিকে একশ শতাংশ চিহ্নিত করতে পারে না। ব্যক্তির নিজের মধ্যেও এই বিভিন্ন পরিচয় এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট (খণ্ড)সত্তাগুলির মধ্যে চলতে থাকে অনন্ত টানাপোড়েন। প্রতিটি গোষ্ঠী তাই একটি মিশ্রণ মাত্র, যৌগ নয়। যৌগের অণুর মধ্যে যেমন মৌল পরমাণুগুলির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে না, তেমনিভাবে একটি সমাজ, শ্রেণী, দল, সম্প্রদায় বা দেশের মধ্যে ব্যক্তি মানুষ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে, এমন প্রত্যাশা যদি কেউ করেন, তবে তিনি অ্যাডলফ হিটলার, জোসেফ স্তালিন বা নরেন্দ্র মোদী যেই হোন, তাঁর প্রত্যাশা পূর্ণ হওয়া অসম্ভব। মিশ্রণের অণু-পরমাণুগুলির মতোই যেকোনো গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যক্তির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় থাকে... বেঁচে থাকে মানুষটির অন্যান্য পরিচয় ও আনুগত্য।

আরও পড়ুন, মানুষ, র‍্যাশনাল অ্যানিম্যাল!

একজন জার্মান মানুষ খ্রিষ্টান, ইহুদি বা ধর্মহীন হতে পারেন, আবার একজন খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী জার্মান ভূসম্পত্তির মালিক, শিল্পপতি, শ্রমিক বা কর্মহীন হতে পারেন। এসবের উপর নির্ভর করবে তাঁর বাস্তব সমস্যা ও রাজনৈতিক আনুগত্য। সর্বহারার মুক্তির মহান স্বপ্ন নিয়ে জগতের মেহনতি মানুষদের এক হবার ডাক দেবার মুহূর্তেও মনে রাখা দরকার তাঁদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, জীবনদর্শন, ইত্যাদি পঞ্চাশরকম পার্থক্যের কথা। এইসব পার্থক্যকে সম্মান দেবে, এমন ছাতার তলাতেই তাঁরা এক হতে পারেন, অন্যত্র নয়। শ্রমিক শ্রেণীর বহু সাধারণ সমস্যাকে বোঝা এবং তার সমাধানের উদ্দেশ্যে তাঁদের সংগঠিত করার জন্য শ্রেণীচেতনা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু একজন নাস্তিক যুক্তিবাদী শ্রমিকের ক্ষেত্রেও শ্রেণীচেতনাই একমাত্র চেতনা হতে পারে না। পুরুষ শ্রমিক, শ্রমজীবী নারী, তৃতীয় লিঙ্গের শ্রমিক, সমকামী শ্রমিক, শারীরিকভাবে দুর্বল শ্রমিক, সাম্যবাদী দেশে জন্মানো অটিজম আক্রান্ত বালক... এঁদের সকলের সমস্যা ও চাহিদার ভিন্নতাকে তুচ্ছ করে শ্রেণিচেতনাকেই তাঁদের সত্তার একমাত্র পরিচয়ে পরিণত করতে চেষ্টা করলে তাও হবে অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ-প্রসূত একধরণের আধিপত্যবাদ, যা অসন্তোষের জন্ম দেবেই ব্যক্তি-মানসে।

তেমনি প্রত্যেক ভারতবাসী হিন্দু নন, সব হিন্দুর বা সব মুসলমানের ভাষা এক নয়, সব পাকিস্তানি আই-এস-আই ও পাকিস্তানি সেনার দ্বারা একইভাবে উপকৃত বা উৎপীড়িত নন। শুধুমাত্র একটি দেশে বা ধর্মের নামে এঁদের সকলের সত্তাকে একটি গোষ্ঠীর সত্তায় বিলীন করতে চেষ্টা করলে, তাতে ফল হবে বিপরীত। জনগোষ্ঠী নামক মিশ্রণটি এমনকি সমসত্ত্ব দ্রবণও হতে পারে না, অথচ ক্ষমতাধর শাসকেরা প্রায়শ নিজের শাসনাধীন জনসমগ্রকে “হোমোজেনাইজ” করার স্বপ্ন দেখেন। তাঁরা মনে করেন, চিনির দানাকে আরো পিষতে থাকলে যেমন সে মিহি হতে থাকে এবং একসময় দানাগুলোকে আর আলাদা করে চেনা যায় না খালি চোখে, তেমনি এক সামাজিক মিক্সার-গ্রাইন্ডারে জনগণের অতি-উত্তম পেষাই করতে পারলেই সমাজ সমসত্ত্ব হয়ে যাবে। তাঁদের লক্ষ্য পূর্ণ হয় না, কিন্তু নিষ্পেষণ দুর্নিবার হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন,  আমাদের (রাজ)নীতি

যখন বৈষয়িক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে, তখন সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তো দূর, এমনকি শান্ত দূরত্ব বজায় রাখাও কঠিন হয়ে ওঠে। তখন তাদের লড়াই অনিবার্য। তখন তাদের লড়তেই হয়। একটু গভীরে গেলে বলা যায়, আসলে তখন তাদের লড়িয়ে দিতে হয়। এই যে দুটি দেশ বা ধর্ম বা দলের মধ্যে বৈষয়িক স্বার্থের সংঘাত, তা তো একটি জনগোষ্ঠীর সব মানুষের স্বার্থের সঙ্গে অপর গোষ্ঠীর সব মানুষের স্বার্থের সংঘর্ষ নয়, অল্প কিছু মানুষের স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয় আসলে, যাদের স্বার্থ গোষ্ঠীর মধ্যে সুরক্ষিত ছিল। যে হিন্দু লোকটি নিজের সমাজেই নিষ্পেষিত, দরিদ্র, অনাহারক্লিষ্ট, তার আর কোন ক্ষতিটা করতে পারে একজন আরববাসী মুসলমান? যে পাকিস্তানি নিজের দেশে সামান্য শিক্ষা, চিকিৎসার সুযোগটুকু পেল না, নিজের পুলিশের ষড়যন্ত্রে জেলে নরকবাস করল সাত বছর, তার কোন স্বার্থহানি করতে পারে ভারত নামক প্রতিবেশী দেশটি? তবু নিরন্তর মগজ ধোলাইতে এদের দুজনেরই মনে বাসা বেঁধেছে জুজুর ভয়। একজনের জুজুর নাম ইসলাম, অপরজনের জুজুর নাম হিন্দুস্তান। এক নির্মিত গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে এক নির্মিত স্বার্থের প্রহরায় বল্লম উঁচিয়ে দাঁড়ানো প্রত্যেকের কর্তব্য হয়ে ওঠে, যে নির্মিত স্বার্থ আসলে ক্ষমতাসীন কতিপয়ের চাহিদার প্রতিনিধিত্ব করে।

আরও পড়ুন, রাষ্ট্র, সরকার, দেশ: প্রেম

একটি জনগোষ্ঠীর কাজ আসলে একজন বা কয়েকজনের লড়াই সকলে মিলে লড়ে দেওয়া। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া বৃদ্ধাকে নিয়ে যখন হাসপাতালে দৌড়ায় “পরিবার” বা “পাড়া” নামক কোনো এক জনগোষ্ঠী, তখন এর ভালো দিকটি চোখে পড়ে; আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ হতে আরো উৎসাহিত বোধ করি। অন্যদিকে পৃথিবীর অশোধিত তৈলভাণ্ডারের ওপর কতিপয় ব্যবসায়ীর দখলদারী নিষ্কণ্টক করতে যখন লক্ষ-লক্ষ মানুষ বন্দুক উঁচিয়ে মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যায় বিশ্বযুদ্ধে, তখন আমরা আতঙ্কিত হলেও গোষ্ঠীবদ্ধ হবার উৎসাহ হারাই না, এমনকি গোষ্ঠী নির্মানের ভিত্তি ও পদ্ধতিগুলোকেও প্রশ্ন করি না, বদলে যুদ্ধে মৃত সৈনিকদের একটি দলের পক্ষ নিয়ে অপর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধস্পৃহ হয়ে উঠি... শোকগাথার বদলে রচনা করি বীরগাথা। একজনের লড়াই সকলে মিলে লড়ে দেওয়ার দুটো বিপরীত চিত্রের প্রতিটির পিছনেই আছে রাজনীতি। রাজনীতি মানেই তাকে প্রতি মুহূর্তে বিভেদকামী বা হিংসাত্মক হতে হবে, এমনটা নয়। বস্তুত মানুষ প্রকৃত র‌্যাশনাল অ্যানিমাল হয়ে উঠলে তার রাজনীতি হবে মূলত গঠনমূলক, জনমুখী, আর মৃত্যু হবে শোকের, যুদ্ধ হবে ত্যাজ্য। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের (রাজ)নীতি আজও স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাবানদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত।

তাই “রাজ” শব্দাংশটি এত মূল্যবান, যেখানে জনসাধারণের হাতে নীতির নিয়ন্ত্রণ কমই থাকে। ফলত মূল ধারার রাজনীতির অভিমুখ হল দ্বিতীয় চিত্রটির দিকে, যুদ্ধেই তার মোক্ষ। শোকগাথাকে বীরগাথায় পরিণত করাই তার তাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক হাতিয়ার।

মানুষ যখন নিজেদের প্রয়োজনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জোটবদ্ধ হয়, তখন তার প্রক্রিয়াটি একরকম, যা মানবজাতির আদিম ইতিহাস চর্চা করলে খানিকটা বোঝা যায়। পরবর্তী যুগে মানুষকে জোটবদ্ধ করা অনেকসময় একটি সুচিন্তিত প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে, যাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন কিছু ব্যক্তি। সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই সেইসব নেতৃস্থানীয়দের উদ্দেশ্যগুলো প্রাধান্য পেয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তা জোটের অন্তর্ভুক্ত সাধারণ মানুষের স্বার্থও দেখেছে বা মূলত সাধারণের স্বার্থ রক্ষার্থেই করা হয়েছে, আবার কখনো জনসাধারণকে স্রেফ বোকা বানিয়ে যূথবদ্ধ করা হয়েছে নেতার লড়াইটা লড়ে দেবার জন্য।

যে উদ্দেশ্যেই করা হোক না কেন, মানুষকে যূথবদ্ধ করতে এবং অপর একটি যূথের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে মূলত দুটো উপাদানকে কাজে লাগানো যায়... “অহংকার” আর “ভীতি”। আমার ধর্মীয় বা জাতীয় পরিচয়ের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে যে অহংকার আমার মনে সৃষ্টি করা যাবে, তা আমাকে ধর্মীয় বা জাতীয় পতাকার নিচে সমগোত্রীয় অন্যদের সঙ্গে একজোট হতে প্রণোদিত করবে এবং অন্য পতাকার নিচে একত্র হওয়া অপরদের তাচ্ছিল্য বা ঘৃণা করতে শেখাবে। পাশাপাশি আমার যাবতীয় অতীত ও বর্তমান অপ্রাপ্তি, ভবিষ্যৎ বিষয়ক অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা, ইত্যাদিকে যদি কৌশলে ব্যবহার করা যায়, তবে গ্রামের “ডাইনি” চিহ্নিত মহিলা, পাশের পাড়ার ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষ, বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী বা প্রতিবেশী রাজ্যের বা রাষ্ট্রের মানুষের প্রতি আমাকে সহজেই বিক্ষুব্ধ করে তোলা যায়। এই দু’য়ের মিশেল হলে যুদ্ধ-পরস্থিতির সৃষ্টি হয়।

অহংকার অথবা ভীতিতে প্রয়োজনমতো ইন্ধন যুগিয়ে সাধারণ মানুষদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেবার প্রক্রিয়াটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে বহুযুগ ধরেই দেখা গেছে। শাসন ও শোষণের স্বার্থে তো এই বিভাজন ও লড়িয়ে দেবার নীতি ব্যবহৃত হয়েই চলেছে, এমনকি যাঁরা সাধারণ মানুষকে দুর্দশামুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাঁরাও এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক মোজেসের কথা। পরবর্তীকালে ইহুদী হিসেবে চিহ্নিত জনগোষ্ঠীটি যখন মিশরে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দ্বারা প্রবলভাবে অত্যাচারিত, নিষ্পিষ্ট, তখন মোজেস তাঁদের সংগঠিত করে দেশত্যাগের পরিকল্পনা করেন। তাঁর ভাবনায় ছিল সকলের মুক্তি, কিন্তু তাঁর কাজটি সহজ ছিল না। ভীতি তাঁর গোষ্ঠীর মানুষের মনে যথেষ্টই ছিল, অত্যাচার ছিল মূর্তিমান, তাই এসব নিয়ে আর বাড়িয়ে বলার প্রয়োজন ছিল না। বরং প্রয়োজন ছিল এই সন্ত্রস্ত মানুষগুলির মনে ভরসা জোগানো, যাতে মোজেসের নেতৃত্বে পরাক্রান্ত শাসকের হাত থেকে নিস্তার পাবার সম্ভাবনায় বিশ্বাস করতে শুরু করেন তাঁরা। মোজেস তাঁদের অহং-কে স্ফীত করার পথ নিলেন। তিনি তাঁদের বোঝালেন যে তাঁদের গোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা জিহোবাই সবচেয়ে শক্তিধর এবং আসল দেবতা, অন্যান্য দেবতারা তেমন কিছু না। এই ইহুদিরা সেই শ্রেষ্ঠ বা একমাত্র ঈশ্বর জিহোবার দ্বারা “নির্বাচিত” মানুষ, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ জনগোষ্ঠী। মোজেসের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ ও বৈপ্লবিক, কিন্তু তাঁর পদ্ধতির মধ্যে ইহুদীদের মনে শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার প্রতিষ্ঠিত করে মিশরীয়দের সম্বন্ধে ভীতিকে সেই জনগোষ্ঠীর প্রতি তাচ্ছিল্য ও ঘৃণায় পরিণত করার প্রকল্পটি ছিল। পরবর্তীকালে খ্রিষ্টান ও মুসলমানেরা আবার ইহুদীদের ঘৃণা করতে শিখেছেন প্রাণপণে, পুরোটাই আঞ্চলিক রাজনীতির প্রয়োজনে, যার ফলে দীর্ঘ সময় জুড়ে ইহুদীদের অত্যাচারিত হবার আর পলায়নের ইতিহাস। এমনকি বিগত শতাব্দীর ইওরোপেও তাঁদের জোটেনি মানুষের মর্যাদা। বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে আবার ইহুদীরা কিছুটা ক্ষমতাবান হয়ে চরম নিষ্ঠুরতায় অত্যাচার চালিয়েছেন প্যালেস্তাইনে, যার পিছনেও সেই শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার আর সুখ-সুস্থিতি থেকে পুনরায় চ্যুত হবার ভয় থেকে জাত আক্রোশ ও ঘৃণা।

আমাদের দেশে এই মুহূর্তে এই বহুপরীক্ষিত পদ্ধতিটিকে অতি অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে প্রজাসাধারণের মধ্যে বিভেদের রাজনীতিকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা সংঘবদ্ধভাবে অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারেন। আবার এরই পাশাপাশি, কী আশ্চর্য, তাঁদের ভোটগুলিকে সংগঠিতভাবে একদিকে প্রবাহিত করার জন্য কোনো এক মিনারের তলায় তাঁদের একত্র করার প্রয়োজনও দেখা দিয়েছে। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য বহিশত্রুর ভীতিকে কাজে লাগানোর পাশপাশি তুরুপের তাস করা হচ্ছে মানব-সভ্যতার ইতিহাসে অহংকারের আধুনিকতম নির্মাণকে, যার নাম “জাতীয়তাবাদ”। জাতীয়বাদ না বলে ব্যবহার করা হচ্ছে “দেশপ্রেম” নামক শব্দটি, যা অনুভূতিপ্রবণ ভারতীয় সমাজের আবেগকে আরো বেশি স্পর্শ করে। ব্যবহার করার স্বার্থে বিকৃত হয়ে যায় সুন্দর শব্দটি, তার ভাবটি... প্রেম বিদায় নিয়ে তার স্থান দখল করে ঘৃণা, উগ্রতা। লোকসভা নির্বাচনের আগে আগে ঘটতে থাকে পুলওয়ামার ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হত্যাকাণ্ড আর এক বৈমানিক প্রতি-আক্রমণ। রাজনেতা থেকে বিশ্লেষক সকলে প্রকাশ্যে আশা ব্যক্ত করেন যে এই ঘটনাক্রম বদলে দেবে নির্বাচনী সমীকরণ। সাধারণ মানুষ আবারও বিভ্রান্ত হন। কেউ কেউ স্তম্ভিত হয়ে ভাবেন, কার পক্ষ নেবেন? কার পক্ষ নিলে আদতে প্রিয়তম দেশের পক্ষে থাকতে পারবেন? চল্লিশজন সেনাকর্মীর ভয়াবহ হত্যার প্রতিশোধে যাঁরা পাকিস্তানে বোমা ফেলে আসছেন, তাঁরাই আবার নিজের দেশের সেনার করুণ মৃত্যু থেকে নির্বাচনে লাভবান হবার আশা করছেন। দেশ তাহলে কোথায়? আর প্রেম?

Advertisment