Prof. Amartya Sen Spoke About Health & Education: প্রাথমিক শিক্ষা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন কখনোই পূর্ণতা পেতে পারে না। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধি জয়দীপ সরকারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন মতই ব্যক্ত করেছেন বিশ্বখ্যাত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন।
প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রসার এবং সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়তা করার জন্যই তিনি ১৯৯৯ সালে গঠন করেন 'প্রতীচী ট্রাস্ট', যা এই ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজও করে চলেছে। সাক্ষাৎকারের সারাংশ আমরা পাঠক পাঠিকাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম:
প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আপনি বরাবরই সরব হয়েছেন...
শিশুদের মানসিক পরিবর্তনে উন্নত চিন্তার ভিত গড়তে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার তো কোনো উপায় নেই। এর একটা দিক হলো নিজেদের লেখাপড়া করার ক্ষমতা বাড়ানো, গুণ ভাগের ক্ষমতা বাড়ানো, চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা বাড়ানো। শিক্ষার সাহায্যেই এগুলোর প্রসার সম্ভব। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তো বলেছিলেন, আমাদের দেশে দারিদ্র্য, অভাব, এবং যেসব সামাজিক সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষার। প্রাথমিক শিক্ষা এবং স্কুল শিক্ষা ছাড়া মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রগতি সম্ভব নয় বলে আমারও দৃঢ় বিশ্বাস।
বিশ্বের নানা দেশের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তবে এর নমুনা দেখা যাবে। যেমন ধরুন চিন। একসময় ওদের জাতীয় আয় আমাদের দেশের জাতীয় আয়ের চেয়ে অনেক কম ছিল, কিন্তু এখন ওরা অনেক ওপরে। এর অন্যতম কারণ ওখানে সব ছাত্রছাত্রী, কী গ্রাম কী শহরে, একটা ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের দেশের সঙ্গে একটা পার্থক্য এই যে, একটা ভালো স্কুল হলো, সেখানে সবার পড়াশোনা করার সুযোগ হলো, তেমন ব্যবস্থা এখনও হয়ে ওঠে নি। শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা দৈন্য আছে, অভাব আছে।
শিক্ষার পূর্ণতা হলে উৎপাদন ক্ষেত্রেও উন্নতি সম্ভব। চিন আজ হরেক উৎপাদনে নজর কাড়ছে, তাদের ক্ষমতা বাড়ছে, যেগুলো মানুষের পক্ষে উৎপাদন করা সম্ভব, সবই প্রায় তারা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এর উৎস অবশ্যই শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশে তো সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দেশে স্কুল ব্যবস্থার দুরবস্থার ফলে একদিকে নিজেদের চিন্তাশক্তি ও জ্ঞান আহরণের ক্ষমতা কমছে, অন্যদিকে আমাদের শিল্পে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ পাওয়ার সুযোগও তৈরি হচ্ছে না। উৎপাদনেও ঘাটতি থাকছে। যার ফলে ভারতীয় শ্রমিকদের যেভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল, তা তাঁরা হতে পারছেন না।
অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চারা স্কুলে হয়তো গেল, কিন্তু সে স্কুল কেমন, তাও তারা জানে না। এসব নিয়ে আমাদের প্রশ্ন করার, ভাবার, অবকাশ আছে। যেটা আমার মনে হয়, শিক্ষার অভাবে আমাদের ক্ষতি তো হচ্ছেই। শুধু কে শিক্ষা পেল না তার জন্য নয়, উৎপাদন শৈলী গড়া যায়, এমন শিক্ষা কতটা পেলাম, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে।
আমাদের দেশে অনেক ছাত্রছাত্রীই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আর এগোতে পারে না...
স্কুলে ড্রপ আউটের কারণ স্কুল ব্যবস্থা ভালো চলছে না, শিশুরা লাভবান হচ্ছে না। এসব পুরোনো সমস্যা তো আছেই, স্কুলে পড়ানো ভালো না হলে তাদের ক্লাসে আটকে রাখা কঠিন। এখন তো আবার পরীক্ষার নিয়ম ফিরে আসছে। এসব দেখে মনে হয়, প্রকৃত অর্থে শেখার সম্ভাবনা কমছে, ফলে অবশ্যই শিক্ষার ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন, আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব না হলেও অনেকটা উন্নতি সম্ভব, এটা আমার আশা। এর ফলে ছাত্র বা ছাত্রীকে পূর্ণভাবে গড়ার পাশাপাশি তাদের সুযোগ সুবিধে বাড়বে, দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতার প্রসারও হবে, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
গ্রাম শহরে এখনও বহু পরিবার মনে করেন, লেখাপড়া শিখে কী হবে? চাকরি তো পাওয়া যাবে না। এই ভাবনার অবসান কীভাবে সম্ভব?
এটা দুদিক থেকে দেখতে হবে। একদিকে যেমন চাকরি না থাকলেও কেউ শিক্ষিত হলে তাঁর সামনে অন্য অনেক সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু না হলে তো কিছুই থাকে না। অন্যদিকে, কী চাকরি বা কাজের সুযোগ আছে, সেটা নির্ভর করবে প্রশিক্ষিত কর্মপ্রার্থীর ওপরেও। যেমন ধরুন, এমন কর্মপ্রার্থী এলেন যিনি যোগ বিয়োগ গুন ভাগ জানেন না, তাঁকে কী কাজ করতে বলা হচ্ছে তাও অনুধাবন করতে পারেন না। তবে তো সত্যিই সেই মানুষটির কাজের সুযোগ হওয়া কঠিন। তাই বেকারত্বেরও দুটো দিক আছে। একটা তো অবশ্যই অর্থের প্রয়োজনে কাজের ক্ষেত্র গড়া, অন্যদিকে কর্মপ্রার্থী যদি তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা বা মেধার কল্যাণে কাজ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে তিনি যাতে শিক্ষার পূর্ণতা পান, সেটাও দেখতে হবে।
শিক্ষা বাড়লে সবাই চাকরি পেতেন না, বা এখনও পাবেন না, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একদিকে শ্রমের চাহিদা এবং তার সঙ্গে কর্মপ্রার্থীর যে শ্রম দিয়ে আয়ের সুযোগ, দুদিকের সঙ্গেই এর যোগ আছে। তাই পড়াশোনা শেষ করলেও বেকারত্ব কিছুতেই কমবে না, বা পড়া শেষ করে তারা স্কুলের বেঞ্চেই বসে থাকবে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার...
আমাদের দেশে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সরকার অর্থ ব্যয় করছে ঠিকই, কিন্তু এটা যেভাবে করা হচ্ছে তাতে সমস্যা কিন্তু মিটছে না। যেমন আমাদের দেখতে হচ্ছে, প্রধান সমস্যা কী? প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজে বড় ধরনের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। ধরুন, সরকার 'আয়ুষ্মান যোজনা' বা 'রাষ্ট্রীয় সমবিকাশ যোজনা' করেছে ভালো কথা, এক্ষেত্রে একজন অসুস্থ মানুষ তাঁর চিকিৎসার জন্য বড় বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেন, সেই চিকিৎসার খরচ সরকার দিল। কিন্তু প্রাথমিক স্তরে যে চিকিৎসার প্রয়োজন, গ্রামীণ স্তরে পুষ্টির প্রয়োজন, প্রাথমিক চিকিৎসায় যে রোগ প্রতিরোধ সম্ভব, তার ওপর গুরুত্ব কম দিয়ে সরকার বেশি খরচের দিকে নজর দিল, এটা আমার মতে একটা অসামঞ্জস্য।
গ্রামীণ স্তর বা একদম নিচু তলায় মানুষকে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিয়ে প্রাথমিক স্তরেই তাকে সরকারিভাবে সহায়তা করা সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে তো তা হচ্ছে না। কোনো বিকল্পের চিন্তা না করে আয়ুষ্মানের মতন যোজনাকে কাজে লাগানোটা ঠিক নয়, কারণ এর ফলে সাধারণ মানুষজন সরকারি পরিষেবা থেকে আরও দূরে সরে যাবেন।
সরকারি ক্ষেত্রে অর্থাভাব কি আমাদের মতো দেশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়?
অর্থের অভাবে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতন ক্ষেত্রে কাজ হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। বাংলাদেশের মতন দেশ, যাদের মাথাপিছু আয় আমাদের জাতীয় আয়ের চেয়ে অনেক কম, তারা যদি এই সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজে এগোতে পারে, আমাদের সমস্যা কোথায়? আমাদের চিন্তাধারার ভুলটা এই যে, আমরা ভাবি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বেসরকারিভাবে ভালো চলবে। এটা কিন্তু ঠিক নয় বলে আমি মনে করি।