মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা পরিষ্কার। বেশ কিছু সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অভাব। তুলনায় যে সমস্ত জায়গায় যাতায়াতের অসুবিধে (সুন্দরবন) কিংবা যেখানে গণ্ডগোলের প্রবণতা বেশি (জঙ্গলমহল) সেখানে শিক্ষক নিয়োগ করলেও ধরে রাখা যাচ্ছে না। ফলে সেই সব জায়গার অনেক স্কুলে শিক্ষকের অভাব আরও সাংঘাতিক। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে বেকার সমস্যা তীব্র। পরিসংখ্যান হাতের কাছে না থাকলেও, এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না যে কয়েক লক্ষ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তর পাশ করা যুবক যুবতী ঠিকঠাক কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। সেই কারণে সদ্য পাশ করা স্নাতকদের (কিংবা আরও বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা যাদের আছে তাদের) বছর দুয়েকের জন্যে শিক্ষানবিশ রাখা হবে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। তাঁরা জলপানি পাবেন মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা পরিকল্পনার স্তরে, রূপায়ণের বাস্তবতায় তা পৌঁছতে কিছুটা সময় লাগবে এটাই স্বাভাবিক। অনেকে একে বলছেন লোকসভার আগে নির্বাচনী চমক, অনেকে বলছেন বেকার সমস্যা সমাধানে এক গভীর পদক্ষেপ ইত্যাদি ইত্যাদি। বিভিন্ন মত তো থাকবেই। থাকবে পরিকল্পনা থেকে রূপায়ণের রাস্তায় অনেক খানাখন্দ। পাড়ার ক্লাবকে বছরে দুলাখ টাকা দেওয়ার সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষানবিশ নিয়োগের তুলনা আসবে। সহজ অঙ্ক বলবে যে একটা ক্লাবকে খেলাধুলো এবং বাংলার সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্যে দান করা দুলাখ টাকায় বছরে প্রায় চারজন শিক্ষানবিশ নিয়োগ করা যাবে। তুলনা আসবে যে শিক্ষানবিশ হিসেবে অল্প কিছু টাকা রোজগারের আশায় রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীদের তুষ্ট করতে হবে কিনা। এরকম তুষ্ট করতে গিয়ে কলেজে ভর্তির সময়ে রেজাল্ট বাঁধা রেখে ভুগেছেন অনেকেই। ভর্তি তো হয়ই নি, বরং টাকা দিয়ে শংসাপত্র ফেরত পেতে হয়েছে কলেজের পেছনের গলিতে। একই অঙ্কে শিক্ষানবিশ হিসেবে দু বছরে আটচল্লিশ থেকে ষাট হাজার টাকা রোজগারের জন্যে যদি পাড়ার দাদাকে ফুল বেলপাতা দিতে হয় তাহলে হাতে বাকি কত থাকবে সেই লাভ-ক্ষতির পাটিগণিতের জন্যে অবশ্যই গণকযন্ত্র লাগবে না। কিন্তু হিসেবটা না মিললেই মুশকিল। পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে আগের কিছু ঘোষণার বাস্তবতা নিয়ে।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গের ঘোষিত প্রকল্প বেকারদের জন্যে মাসে দেড় হাজার টাকা বেকার ভাতা। চালু হওয়ার কথা সেই বছরের অক্টোবরের এক তারিখ থেকে। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে সেই ঘোষণা এবং রূপায়ণের। কিন্তু অন্তর্জাল খুঁজে সেই প্রকল্প সংক্রান্ত তথ্য বিশেষ পাওয়া গেল না। অন্তর্জাল ব্যবহারে অপটু লেখকদের এমনটাই কপাল। তবে প্রশ্নগুলো সহজ। কতজন এই বেকার ভাতার সুযোগ পেয়েছেন এবং কতবছর ধরে? এই প্রশ্নের উত্তর জানা গেলে অবশ্যই সুবিধে হত। কারণ তাহলে বর্তমানে ঘোষিত শিক্ষানবিশ প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত হয়ে কাজ করতে পারত আমাদের রাজ্য সরকার।
আরও পড়ুন, উচ্চবর্ণে গরীবের সংজ্ঞা এবং দশ শতাংশ ছাড়
এবার বৃহত্তর আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতে বিষয়টি আলোচনা করা যাক। সারা বিশ্বজুড়ে মূল সমস্যা সাধারণ মানুষদের ভালো থাকা। সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহে এই সংখ্যাটা সাড়ে সাতশো কোটি থেকে আটশ কোটির দিকে এগোচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে ন-কোটি থেকে দশের দিকে। এই মানুষগুলোকে খেতে দিতে হবে, থাকতে দিতে হবে, পরতে এবং পড়তে দিতে হবে, আলো দিতে হবে, জল দিতে হবে, বিদ্যালয় দিতে হবে, হাসপাতাল দিতে হবে, এবং সর্বোপরি কাজ দিতে হবে। সকাল বিকেল মাছ ধরে, খবরের কাগজ পড়ে, দাঁত মেজে, রাজনীতি আলোচনা করে, ক্রিকেট কিংবা ফুটবল দেখে কিংবা খেলে তো আর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কাটিয়ে দেওয়া যাবে না। খুব কম মানুষেরই সে সৌভাগ্য হয়। এখন মানুষকে বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়ার একটা অঙ্ক আছে। ব্যক্তিমানুষ প্রথমে পরিবারভিত্তিক। সেখানেও বিভিন্ন স্তর আছে। সাধারণভাবে মানুষ সবথেকে ভালোবাসে তার সন্তান-সন্ততিকে, তারপর নিজেকে, তারপর নিজের বাবা-মাকে, কিছুটা নাক কুঁচকে এরপর নিজের স্বামী বা স্ত্রীকে, তারপর অন্যান্য আত্মীয় পরিজনদের। এদের মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা থেকেই সম্পদ এক জায়গায় জমে যায় অনেকটা। ধনতন্ত্রের মূল সূত্র এটাই।
অন্যদিকে হিংসা এবং স্বার্থপরতার বেড়া ভেঙে অনেক সময় আমরা চাই পাশের বাড়ির অনাত্মীয়টি-ও ভালো থাকুক। কিউবা কিংবা নিকারাগুয়ায় বন্যা হলে সে জন্যেই দল বেঁধে পুরনো জামাকাপড় খুঁজতে বেরোই আমরা। এখানে আমাদের ব্যক্তিচরিত্র সমষ্টির আকার নেয়। ঠিক এই জায়গাটাতেই সমাজতন্ত্রের ভাবনা শুরু হয়। সোজা বাংলায় ফ্রান্স থেকে রাফেল যুদ্ধবিমান কেনার সময় বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার আম্বানিকে তিরিশ হাজার কোটি টাকার বরাত দিলে সেটা ধনতন্ত্রের স্বজনপোষণ, আর রাজ্যে তৃণমূল সরকার শিক্ষিত বেকারদের জন্যে দু-আড়াই হাজার টাকার ভাতা দিলে সেটা সমাজতন্ত্রের দিকে উত্তরণ। কিন্তু সবটাই সরল অঙ্কের বিশ্ববাংলা নয়। সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি কিংবা অর্থনীতি নিয়ে দেশ বিদেশে গভীর পড়াশোনা তো লোকজন শুধু শুধু করে না। তাই ধনতন্ত্রে একটা বড় অংশের মানুষের যে বিপুল অসুবিধে হবে এটা পরিষ্কার জানা থাকলেও, বেকারভাতা দিয়ে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন কতটা সফল হবে সে উত্তর কিন্তু অস্পষ্ট। ধনতন্ত্রের সুবিধে হল সেখানে অল্প কিছু মানুষ সুখে থাকলেই অঙ্ক মিলে যায়। তাই সেটা অর্জন করা সহজ। সমাজতন্ত্রে সবাইকে ক্ষিদের পাঁউরুটি আর শীতের ভদকা যোগান দিতে হয়। পিরামিডের মাথার দিকে সে কেক পৌঁছলেও নীচে নামতে দেরী হয় অনেক। সে মাধ্যাকর্ষণের টান যত বেশিই হোক না কেন। অনেক সময় কেক শুকিয়ে শক্ত টোস্ট-বিস্কুট হয়ে যায়, কিন্তু গরীব মানুষদের কাছে তা পৌঁছয় না মোটে। তাই বার বার এ প্রশ্ন উঠবেই যে দুই-আড়াইয়ের শিক্ষানবিশের চিঠি পাড়ার ক্লাব থেকে বিলি হবে না তো?
এ পর্যন্ত শিক্ষানবিশ সম্পর্কে যে সাধারণ ধারণা বহাল ছিল তা হল এমন ধরণের বিশেষ কাজে তাদের নেওয়া হয় যাতে পরবর্তীকালে তাদের স্থায়ী কাজ পেতে সুবিধে হয় এবং সেই চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় তারা যেন কাজ করার জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকে। মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলের একটা বড় সময়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে অনেক মেধাবী স্নাতক সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। আজকের দিনেও বহু নামকরা ইংরিজি মাধ্যম স্কুলের সঙ্গে তুলনায় একই মানের শিক্ষক শিক্ষিকা খুঁজে পাওয়া যাবে মফস্বলের অত্যন্ত সাদামাটা বাংলা মাধ্যমের স্কুলে। সেখানে ভালো ছাত্রছাত্রী কেন কম যাচ্ছে আর সবাই ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে ছুটছে কেন সে এক অন্য সামাজিক বিতর্কের বিষয়। তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকাদের বেতন সাধারণভাবে সরকারি স্কুলের থেকে অনেক কম। বেসরকারি ক্ষেত্রে এই অবিচার আশ্চর্য হওয়ার মত কিছু নয়। ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এটাই দস্তুর।
এখানেই অল্প টাকায় শিক্ষানবিশের নিয়োগ আর একটা বড় সমস্যার জন্ম দেবে। বেসরকারি স্কুলগুলোর মালিকরা অবশ্যই মুনাফা বাড়াতে চাইবেন। সেখানে সরকারি জায়গায় এতো অল্প টাকায় শিক্ষানবিশ শিক্ষক পাওয়া যাওয়ায় বেসরকারি ক্ষেত্রে বেতন আরও কমে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর তা অবশ্যই হাওয়া দিতে পারে “শোষণের মাধ্যমে দক্ষতার” তত্ত্বে। আজকের দিনে বেসরকারি ছোট স্কুলে আট-দশ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করা শিক্ষক শিক্ষিকাদের একটা বড় চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে দিতে পারে এই সিদ্ধান্ত। আসলে রাজ্যের নেত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা নিয়ে কোন সন্দেহের জায়গা নেই। কিন্তু বেকার ভাতা, ক্লাব বা দূর্গাপুজোয় সাহায্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষানবিশ — এই ধরণের সমাজতান্ত্রিক ভাবনাগুলো মোটেও নতুন আবিষ্কার নয়। মার্কিন দেশেও নবীন মহিলা সাংসদ আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ দাবি তুলেছেন ধনীদের ওপর সত্তর শতাংশ কর ধার্য করার জন্যে। পশ্চিমবঙ্গেও যাদের মাসে দুলক্ষ টাকার ওপর রোজগার তাদের থেকে মাসে কুড়ি হাজার টাকা করে অতিরিক্ত কেটে নিয়ে শিক্ষানবিশ শিক্ষকদের মাইনে অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ভাবনা ভাবা যতটা সহজ তাকে রূপায়িত করা অনেক বেশি শক্ত। আর সেই জন্যেই ইংরিজি অভিধানে ‘ইনটার্ন’ শব্দটার মূল অর্থটার দিকে একবার তাকানো দরকার। বিশেষ্য হিসেবে শব্দটা নিয়ে তো অনেক আলোচনা হল। কিন্তু ক্রিয়াপদ হিসেবে এর অর্থ “যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে অন্তরীণ করা”। ফলে আমাদের রাজ্যে সদ্যঘোষিত ইনটার্ন বিশেষ্য হিসেবে কাজ করবে নাকি দলদাস নিয়োগের মাধ্যমে সামনের নির্বাচনে বিরোধীদের অন্তরীণ করার ক্রিয়ায় মেতে উঠবে সে প্রশ্ন থেকেই গেল।
বার বার শুনে কান কটকট করলেও একথা সত্যি যে আমাদের রাজ্যের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেও সুবিধের নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ এ রাজ্যকে বারবার বিপদে ফেলেছে। অতীত বাম এবং বর্তমান তৃণমূল আমলেও শিল্প সম্ভাবনা তেমন দেখা যাচ্ছে না। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে চটজলদি শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষানবিশ নিয়োগে আদতে কতটা কাজের কাজ হবে তা বোঝা যাবে বছর কয়েক পরে। তবে তখন হয়ত ২০১৩ সালের বেকারভাতার মতই কোন তথ্য অন্তর্জালে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে তথ্যে তো পেট ভরে না। ভাতার টাকায় ভাত জুটলেই প্রকল্পের সার্থকতা।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)