হিন্দুত্ববাদী হওয়ার এই হল বিপদ! যা-ই করবে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে চলে যাবে। আসামের বরাক ভ্যালিতে, ভাষা শহীদের দেশে, বাংলাভাষার অগ্রণী কবি শ্রীজাতের অনুষ্ঠানে হামলা করে আবার হিন্দুধর্মের মুখ পোড়াল বিজেপি। ইসলামের অসহিষ্ণুতার নিন্দা করে হিন্দুত্ববাদীরা। কিন্তু কার্যত তারা নিজেরাই ওই অসহিষ্ণুতার চর্চা করে। আসলে গলদ গোড়ায়। গত শতকে হিন্দু মহাসভার নেতা চক্ষু চিকিৎসক বালকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জে দেখা করেছিলেন ইটালির ফ্যাসিস্ট একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির সঙ্গে। উদ্দেশ্য ছিল মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট দলের আদলে একটি জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী দল তৈরি করা।
পরে মুঞ্জের শিষ্য ও হিন্দুত্ববাদের গত শতকের পোস্টারবয় বি ডি সাভারকার ও গুরুজি এম এস গোলওয়ালকারেরও প্রিয় ছিল ইতালীয় জঙ্গি ফ্যাসিবাদ। যেদিন থেকে হিন্দুত্বকে মিলিট্যান্ট হিন্দুইজমে পরিণত করতে চাইলেন নেতারা, হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে হিন্দুধর্মের চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেল। যা থাকল, তা পুরোটাই স্ববিরোধ ও গোঁজামিল।
শ্রীজাত'র অপরাধ, তিনি ত্রিশূলে কন্ডোম পরাতে চেয়ে কবিতা লিখেছেন। তাতেই মামলা থেকে হামলা, যাবতীয় আক্রমণ সামলাতে হচ্ছে তাঁকে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময়, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিতে, পুলিশের বন্দুকের নলে কন্ডোম পরানো আছে কিনা বলে বিতর্ক বাধিয়েছিলেন সিপিএম নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত। সেই বক্তব্য আজও সমালোচিত হয়। কিন্তু কোনও ধর্মীয় বিতর্ক তৈরি হয়নি তখন। সম্ভবত বন্দুক কোনও দেবদেবীর অস্ত্র নয়, তাই বন্দুকে ছাড়! কিন্তু ত্রিশূল পুরাণ বর্ণিত দেবাদিদেবের অস্ত্র। মহিষাসুর মর্দিনীরও। হিন্দুত্ববাদীরা যেহেতু রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ এবং ৩৩ কোটি দেবতার স্বঘোষিত ঠিকাদার, তাই ত্রিশূলের পেটেন্টও তাদের। পূজ্য অস্ত্রে তাঁরা কিছুতেই কন্ডোম পরাতে দেবেন না। কন্ডোম পরালে গর্ভবতীর পেট চিরে ত্রিশূলে ভ্রূণ গেঁথে তাণ্ডব হবে কীভাবে, যা তাঁরা গুজরাট গণহত্যায় করেছিলেন। ঘৃণ্য অপরাধের অস্ত্র হিসেবে ত্রিশূলের ব্যবহার তখন কেবল অন্যায় নয়, পুণ্যের কাজ!
আরও পড়ুন, শিলচরে গেরুয়া বিক্ষোভের মুখে শ্রীজাত, পণ্ড সভা
বিধর্মী মৃত নারীশরীর কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করার হুমকির প্রতিবাদ করে আক্রমণে উদ্যত ত্রিশূলে কন্ডোম পরাতে চেয়েছিলেন কবি, আর তাতেই তুমুল দোষ খুঁজে পেয়েছেন হিন্দুত্ববাদী হার্মাদরা। আর কে না জানে, গেরুয়া গেস্টাপোরা যুক্তি মানে না, বিশ্বাস মানে।
ইতিহাসের অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী খুব স্পষ্ট করে ধরিয়ে দিতে পারেন হিন্দুত্ববাদের দ্বিচারিতা ও গোঁজামিল। "ফ্যাসিস্ট ভাবাদর্শের মধ্যে অনেক ধোঁয়াশা ও অস্পষ্টতা ৷ হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শেও তাই ৷ চিন্তার দারিদ্র্য ও স্ববিরোধ হিন্দুত্ববাদের সর্বশরীরে৷ যেমন ধরুন:
১. হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শ অন্য ধর্মের নিরেট বা একশৈলিক (monolithic) চরিত্রের সমালোচনা করে, কিন্তু নিজে কামনা করে হিন্দুধর্মের ও সম্প্রদায়ের একই রকম নিরেট ঐক্য, ভিন্নমতের স্থান যেখানে নেই৷
২. এই মতবাদ ঐতিহাসিক হিন্দু ধর্মের বৈচিত্র্য ও উদারতার গুণগান গায়, এই বৈচিত্র্য ও স্বাধীনতাই নাকি সেমিটিক ধর্মগুলির চেয়ে হিন্দুধর্মকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে, অথচ হিন্দু সমাজের বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা দমন করাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য নির্ধারিত হয়৷
৩. আগ্রাসন ও আগ্রাসী মনোভাবকে ইসলামের ন্যক্কারজনক দিক হিসেবে হিন্দুত্ববাদীরা চিহ্নিত করে, আবার সেই বৈশিষ্ট্যই হিন্দুধর্মের মধ্যে প্রোথিত করার জন্যে তাদের তৎপর হতে দেখা যায় ৷
৪. মুখে তারা বলে, সহিষ্ণুতা হিন্দুদের সর্বোত্তম গুণ (যা নাকি ইসলামে নেই), আবার তাকেই হিন্দুদের দুর্বলতার উৎস বলে চিহ্নিত করে ৷
৫. অন্য ধর্মের ধর্মীয় পীড়ন ও মন্দির ধ্বংসের সমালোচনা করে, অথচ নিজে সেই রাজনীতিই সংগঠিত করতে উদ্যত হয়, যেমন বাবরি ধ্বংস তার প্রমাণ।
৬. ইসলামিক রাষ্ট্রগুলির নিন্দায় সোচ্চার হয়, অথচ ভারতকে একইরকম ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বানাতে চায়৷
৭. তিন তালাক প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানায়, আবার শবরীমালা মন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ঐতিহ্য ও প্রথার দোহাই দিয়ে অমান্য করে৷ ফলত স্ববিরোধ, শুধু স্ববিরোধ। ভাবাদর্শে এত দুর্বলতা ও ফাঁকফোকর থাকার জন্যেই যুক্তি ও যুক্তিবাদ নয়, অশিক্ষা ও ভাবাবেগই হিন্দুত্ববাদের মূল ভিত্তি।”
আসামে এনআরসি আগুন নিয়ে যে খেলা হিন্দুত্ববাদীরা শুরু করেছিল, তাতে এখন নিজেরাই পুড়ে যাওয়ার দশা। নাগরিকত্ব আইন মানতে চাইছে না আঞ্চলিক দলগুলো। লোকসভা নির্বাচনও দোরগোড়ায়। ভোটার দেশবাসীর হালচালও সুবিধের ঠেকছে না। পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলে যা স্পষ্ট। ফলত ব্যাক টু বেসিক। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদ। ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ করে ভোট ছিনিয়ে নেওয়ার সনাতনী পদ্ধতি। তাই হিন্দুত্ববাদী জিগির। তাই হিন্দুধর্মের রক্ষাকারীর ভূমিকা। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, গলদ গোড়ায়। জঙ্গি হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে হিন্দুধর্মের এতটাই দূরত্ব, হিন্দু ভারতবাসী গোরক্ষকদের বন্ধু ভাবতে পারে না, জঙ্গিই ভাবে।"