আজ থেকে ২৫ বছরেরও বেশি আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) নির্দেশে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন আহমেদাবাদের স্থপতি চন্দ্রকান্ত সোমপুরা। গত শনিবারের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে তাঁর বক্তব্য, মন্দিরের কাজ পুনরায় শুরু করলে তা শেষ হতে লাগবে আড়াই থেকে তিন বছর।
এখন যা পরিস্থিতি, তাতে মন্দির প্রায় ৪০ শতাংশ তৈরি, জানিয়েছেন সোমপুরা। আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই মন্দিরের গোলাপি স্যান্ডস্টোন আসছে রাজস্থানের বংশী পাহাড়পুর এলাকা থেকে।
এই একই পাথর দিয়ে তৈরি হয় গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগরের অক্ষরধাম মন্দির। স্থপতি সেই সোমপুরা। অনেকেই হয়তো জানেন না যে সোমপুরার হাতে তৈরি হয়েছে শতাধিক মন্দির, যাদের মধ্যে রয়েছে লন্ডনের নিসডেন (Neasden) এলাকার সুবিখ্যাত স্বামীনারায়ণ মন্দির, যা অনেকের মতে বিশ্বের বৃহত্তম মন্দির।
শুক্রবার ৭৭ বছর পূর্ণ করলেন সোমপুরা। একই দিনে জন্মেছিলেন বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবানী, যাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে রাম মন্দির নির্মাণ অভিযান। কিন্তু শনিবার সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার পর থেকে জন্মদিনে পাওয়া ফুলের তোড়ার দিকে তাকানোরও সময় নেই সোমপুরার। বরং শনিবার তাঁর বাড়িতেই অবস্থিত দফতরে গিয়ে দেখা যায়, চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে নানারকমের ম্যাপ, থ্রি-ডি চিত্র, এবং রাম মন্দিরের একাধিক প্রতীকী ছবি।
সুপ্রিম রায় নিয়ে একটিই বাক্য ব্যয় করলেন সোমপুরা, "এই রায়ের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, উভয়পক্ষের প্রতিই সুবিচার করা হয়েছে।" তাঁর মন এখন পড়ে রয়েছে বাকি কাজের দিকে। "এখন সরকারের মর্জি - তিনমাসে কী সিদ্ধান্ত নেয় (কমিটি গঠন করার ব্যাপারে), কত অর্থ আসবে...এসব দেখতে হবে।"
এতদিন এই নির্মাণ প্রকল্পের দায়িত্বে ছিল ভিএইচপি, এবং সংস্থার প্রয়াত সভাপতি অশোক সিঙ্ঘলের হাতেই ছিল পরিকল্পনার রাশ। কিন্তু এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে ট্রাস্ট গঠন করলে তাতে ভিএইচপি থাকবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
আরও পড়ুন: অযোধ্যায় রাম মন্দির: অবশেষে সঙ্ঘ পরিবারের ইচ্ছা পূরণ
অবাক লাগলেও একথা সত্যি যে স্থাপত্যবিদ্যায় কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পান নি সোমপুরা। তাঁর পুত্র আশিসের দাবি, সোমপুরার শিক্ষাগুরু ছিলেন তাঁর পিতা, পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত স্থপতি প্রভাশঙ্কর, যাঁর হাতে তৈরি হয় সোমনাথ মন্দির। আশিস জানাচ্ছেন, ১৯৮৯ সালে প্রথম রাম মন্দিরের নকশা তৈরি করেন সোমপুরা, এবং ছ'মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণ করে ফেলেন মন্দিরের ডিজাইন। শেষবার তিনি মন্দিরের 'সাইট' দেখতে যান পাঁচ-ছ'বছর আগে।
গুজরাটের বল্লভ বিদ্যানগরের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগ থেকে ১৯৯৬ সালে ডিগ্রি নিয়ে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই আশিসকে সামিল করে নেওয়া হয় রাম মন্দির নির্মাণ প্রকল্পের কাজে। "কর সেবার পর তখন পুরোদমে চলছে কাজ। আমি তখন সবে কলেজ থেকে বেরিয়েছি, এবং এত সম্মানজনক একটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে খুবই গর্ব বোধ করেছিলাম। মন্দিরে এখনও আমাদের একটি দল রয়েছে, কিন্তু টাকা ফুরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় মন্দিরের কাজ," বলছেন আশিস।
সোমপুরার বক্তব্য, এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হবে এটির অষ্টকোণ, যা কিনা মন্দিরশিল্পে বিরল। এই ধরনের একটি সূর্য মন্দির রয়েছে রাজস্থানের রনকপুরে। এছাড়াও, এটি হবে রাম লাল্লার (রামের শিশু বয়সের নাম) নামাঙ্কিত প্রথম সর্বজনীন মন্দির। মূলত দুটি তলা থাকবে মন্দিরের, বলছেন সোমপুরা। "একতলায় থাকবে রাম লাল্লা গর্ভগৃহ, এবং তার ওপরে থাকবে রাম দরবার (যেখানে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, হনুমানের মূর্তি থাকবে)।"
আশিসের কথায়, মন্দিরের কাজ শুরু হয় ১৯৯৩ সালের কর সেবার পর (৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর হয় কর সেবা)। সোমপুরাদের একটা আন্দাজ দেওয়া হয়, কতটা জায়গা নিতে পারে এই নতুন মন্দির। আশিসের কথায়, "যেভাবে ভাবা হয়েছিল, সেভাবেই তৈরি হবে মন্দির। হয়তো আনুষঙ্গিক কিছু বদল হলেও হতে পারে।"
আরও পড়ুন: বিশ্লেষণ: অযোধ্যা রায়ের আদ্যোপান্ত
মন্দিরের খুঁটিনাটি
'নগর' রচনাশৈলী মেনে তৈরি এই মন্দিরের মূল ডিজাইনে রয়েছে প্রধান মন্দিরটি, সঙ্গে সীতা, লক্ষ্মণ, গণেশ, এবং হনুমানের উদ্দেশে নিবেদিত আরও চারটি মন্দির, এবং চার দিকে চারটি তোরণ, যা দিয়ে মন্দির কমপ্লেক্সে প্রবেশ করা যাবে। প্রতিটি তোরণের শৈলী সেটির মুখ কোনদিকে, সেই অনুযায়ী রচিত হবে। "যেমন দক্ষিণমুখী তোরণটি তৈরি হবে (দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের) 'গোপুরম'-এর অনুকরণে," জানালেন সোমপুরা।
মূল নকশায় আরও রয়েছে একটি চিরস্থায়ী প্রদর্শনী, সন্ত নিবাস, কলাকুঞ্জ যেখানে 'রাম কথা' শোনানো হবে, খাওয়ার জায়গা, কর্মীদের কোয়ার্টার, প্রশাসনিক এলাকা, এবং লাইব্রেরি ও রিসার্চ সেন্টারের পরিকল্পনা।
১৩৫ × ২৪০ ফুটের এই রাম মন্দির নির্মিত হবে একটি বেদীর উপর, এবং অধিকাংশ হিন্দু মন্দিরের চারটি উপাদানই দেখা যাবে এখানে - চৌকি (বারান্দা), নৃত্যমণ্ডপ, গুঢ় মণ্ডপ, এবং গর্ভগৃহ - সবকটিই একই অক্ষে। সমগ্র নির্মাণে ব্যবহৃত হবে আড়াই থেকে তিন লক্ষ ঘনফুট (cubic feet) স্যান্ডস্টোন, জানাচ্ছেন আশিস। মন্দিরের ক'টি স্তম্ভ থাকবে, তা এই মুহূর্তেই বলেন নি তিনি, যদিও মূল প্ল্যানে বলা হয়েছে ২১২ টি স্তম্ভের কথা। আশিস এটুকু বলেছেন যে প্রতিটি স্তম্ভে খোদিত হবে ১৬ টি করে মূর্তি। গর্ভগৃহের মূর্তি হবে মার্বেলের। স্তম্ভমুল (plinth) হবে ২৭০ ফুট লম্বা, ১২৫ ফুট চওড়া, এবং আন্দাজ ১২ ফুট উঁচু। মন্দিরের উচ্চতা হবে ১৩২ ফুট।