কয়েক সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ। যা প্রতীক হয়ে উঠেছে লকডাউনের মাঝে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার মরিয়া চেষ্টার। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বিহারের মজফফরপুর রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে রয়েছে এক মহিলার নিথর দেহ। তাঁর গায়ের চাদর নিয়ে খেলাচ্ছলে টানাটানি করছে ছোট্ট একটি শিশু। মা যে আর নেই, তা তো কেউ বলে দেয় নি তাকে। তাই ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে মাকে জাগানোর সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।
সেই মর্মান্তিক ছবির নেপথ্যে রয়েছে একটি শোকস্তব্ধ পরিবার, কাটিহার জেলার মারাদাঙ্গি গ্রামে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া একটি এক-কামরার বাসস্থান, এবং একরাশ প্রশ্নের ধোঁয়াশা।
সেই ধোঁয়াশার কেন্দ্রে মৃতা আরভিনা খাতুনের দুই ছেলে - চার বছরের আরমান, এবং ভিডিওতে দৃশ্যমান দেড় বছরের রহমত। পাশাপাশি তাঁর স্তম্ভিত মা-বাবা, শায়রুন এবং ভোকা মীর, যিনি দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান। বছর দুয়েক আগেই আরভিনার স্বামী পরিত্যাগ করেন তাঁর পরিবারকে।
শায়রুন বলছেন, "আবারও একবার মা হতে হবে আমাকে, এই বাচ্চা দুটোর জন্য।" আরভিনার বোনের স্বামী মহম্মদ ওয়াজির ৩৫ বছরের শ্যালিকা এবং তাঁর দুই পুত্রকে পৌঁছে দিতে আসছিলেন তাঁদের সঙ্গেই। "চোখের সামনে ওর মৃত্যুটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে আমাকে," বলছেন ওয়াজির।
এই মৃত্যুর ধাক্কায় নড়েচড়ে বসেছে রাজ্যও।
আরভিনার মা-বাবাকে প্রতি মাসে শিশু দুটির প্রতিপালনের জন্য ৪,০০০ টাকা করে দেবে বিহারের সমাজকল্যাণ দফতর। এ ছাড়াও সহায়তা মিলবে মুখ্যমন্ত্রী আবাস যোজনার আওতায়, এবং মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার কল্যাণ প্রকল্প থেকে দেওয়া হবে এককালীন ২০ হাজার টাকা। বিরোধী দলনেতা তেজস্বী প্রসাদ যাদব ইতিমধ্যে আরভিনার পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন ৫ লক্ষ টাকা।
তবে এই মৃত্যু একরাশ প্রশ্নও তুলে ধরেছে।
ওয়াজিরের দাবি, আহমেদাবাদ থেকে ২৩ মে যে শ্রমিক স্পেশাল ধরেন তাঁরা, তাতে "ঠিকমতো খাবার পায় নি" বলেই মৃত্যু হয় আরভিনার। তাঁর পরিবারের বক্তব্য, আরভিনার দেহ তাঁদের দিয়ে দেওয়া হয় "পোস্টমর্টেম না করেই", এবং "করোনা পরীক্ষার কোনও নমুনা না নিয়ে"।
মৃত্যু-পরবর্তী তদন্তের রিপোর্টে রেল পুলিশ জানিয়েছে, ছাপরায় ট্রেনের ভেতরেই "স্বাভাবিক মৃত্যু" ঘটে, এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃত করে বলেছে, "খাবারে বিষক্রিয়া" তার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। কাটিহার প্রশাসনের দাবি, পোস্টমর্টেম হয় নি কারণ তাদের "না জানিয়েই" দেহ কবরস্থ করেন মৃতার পরিবার।
উত্তর মেলা খুব কঠিন।
প্রাথমিকভাবে সাংবাদিকদের ওয়াজির জানিয়েছিলেন যে ট্রেনে "খাবারের অভাব ছিল না"। তবে শুক্রবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "তখন মাথার ঠিক ছিল না আমার, কী বলছিলাম নিজেই জানি না। আমরা প্রথম খাবার পাই ২৩ মে, আহমেদাবাদে। তারপর একেবারে ২৫ মে, মজফফরপুরে।"
আধিকারিকরা মানতে রাজি নন এই দাবি। কাটিহারের জেলাশাসক কঁভল তনুজ বলছেন "প্রশাসনকে না জানিয়েই দেহ কবর দেওয়া হয়"। তবে তনুজ এও আশ্বাস দিয়েছেন যে "ওই পরিবারটিকে বাড়ি তৈরি করার জন্য জমি দেওয়া হবে"।
বাড়ির বাইরে বসে থাকা শায়রুন এবং মীরের মাথায় অবশ্য এখনও অতশত ঢোকে নি। "আমাদের তৃতীয় মেয়ে ছিল ও। সাত বছর আগে ইউপি-র বরেলির একজন লোকের সঙ্গে ওর বিয়ে দিই। স্বামীর নাম ছিল মহম্মদ ইসলাম। মাত্র দু'বার বরেলি নিয়ে যায় ওকে, তারপর রহমত যখন পেটে, সেই অবস্থায় তালাক দিয়ে দেয়," বলছেন ৫৫ বছরের শায়রুন। "আমাদের কোনও চাষের জমি নেই, আর আমার স্বামী খুব বেশি শারীরিক পরিশ্রম করতে পারেন না... আমাদের পক্ষে আরভিনাকে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছিল। এখানে মেয়েদের কাজের প্রায় কোনোই সুযোগ নেই।"
এই সময় ওয়াজির, যাঁর বিয়ে হয়েছে আরভিনার তিন বোনের একজনের সঙ্গে, পরামর্শ দেন যে আরভিনা আহমেদাবাদ গিয়ে তাঁদের বাড়িতে থেকে কাজ খুঁজুন।
"আট মাস আগে দুই ছেলেকে নিয়ে এখানে আসে আরভিনা, এবং বাড়ি তৈরির কাজে মিস্ত্রিদের হেল্পার হিসেবে কাজ পায়। দিনে প্রায় ৩০০ টাকা রোজগার করছিল। ভালো চলছিল সব। আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম... আমার স্ত্রী আর ছেলে, সঙ্গে আরভিনা ও তার দুই ছেলে," বলছেন ওয়াজির, যিনি নিজে আহমেদাবাদে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে মাসে সাত হাজার টাকা রোজগার করতেন। "কিন্তু লকডাউন এসে এত তাড়াতাড়ি আমাদের জীবনটা বদলে দিল..."
আরভিনার বাবা জানাচ্ছেন, গত মাসে মেয়েকে দেওয়ার জন্য তিন হাজার টাকা ধার করেন তিনি। "তবে লকডাউন চলতেই থাকল, এবং কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তার কোনও আন্দাজ না পেয়ে ওরা ঠিক করে, গ্রামেই ফিরে এসে কাজের চেষ্টা করবে," বলছেন বছর ষাটের মীর।
গত সোমবার অ্যাম্বুল্যান্স আসার আগে প্রায় দেড় ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মের ওপর শুয়েছিল আরভিনার দেহ। পাশে খেলছিল রহমত। মীর বলছেন, "আমি মেয়েকে দেখার আশায় বসেছিলাম। ও বাড়ি ফিরল কফিনে।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন