উপমহাদেশে পর্তুগিজদের কথা বললেই প্রথমে মাথায় আসবে গোয়ার কথা। কিংবা বড়জোর হুগলীর ব্যান্ডেল। কিন্তু অনেকেই জানেন না, বর্তমানে যা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, সেই জেলাতেও ছিল পর্তুগিজদের ঘাঁটি। ১৫৮০ সালে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলায় হুগলী নদীর তীরে পর্তুগিজদের কুঠি তৈরির সনদ প্রদান করেন। যে জায়গায় তারা কুঠি তৈরি করে, তার নাম 'পোর্ট পিকানো', যার নাম এখন ব্যান্ডেল। এরপর নদী থেকে সাগর, সাগর পেরিয়ে কর্ণফুলি নদী। নদীর ধারে চট্টগ্রামকেই বেশী মনে ধরেছিল ফিরিঙ্গিদের। যদিও ইংরেজ শাসনকালের আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় পর্তুগিজদের প্রতিপত্তি।
ভাস্কো-দা-গামা দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করার পর থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের সূত্রপাত। এর আগে পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগর (রেড সি) হয়ে কিছুটা জলপথ ও কিছুটা স্থলপথ ধরে ভারতের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্য চলত, কিন্তু ১৪৫৩ সালে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পতনের ফলে এই বাণিজ্যপথ ব্যাহত হয়। এই অবস্থায় ভাস্কো-দা-গামার আগমন ভারত-ইউরোপের বাণিজ্যে এক যুগান্তরের সৃষ্টি করে। এরপর থেকেই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা হয়ে ওঠে বিদেশিদের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের পর্তুগিজদের লেখায় বারবার উঠে এসেছে 'সিটি অফ বাংলা'র নাম। এই 'সিটি অফ বাংলা' কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের পশ্চিমবঙ্গ নয়। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামও। পর্তুগিজরা সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে আসে ১৫১৮ সালে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত কেটে গিয়েছে পাঁচশ বছর। পর্তুগিজ বণিক দুয়ার্তে দে বাবোসা (১৪৮০-১৫২১) আফ্রিকা ও ভারতীয় উপকূলের ভৌগোলিক বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, "এই সাগর (বঙ্গোপসাগর) হচ্ছে একটি উপসাগর। এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছে। এর উপকূলে শহরটির নাম বাংলা।" পর্তুগিজদের লেখায় চট্টগ্রামের উচ্চারণ ছিল 'চাটিগাম'।
আজ থেকে ৫০০ বছর আগে প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে তখনকার অবিভক্ত বাংলায় আসে পর্তুগিজরা। প্রথমে ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্য নিয়ে এলেও পর্তুগিজরা পরবর্তীতে পরিণত হয় জলদস্যুতে। বিভিন্ন গ্রামে লুটপাট করে জাহাজে পালিয়ে যেত তারা। সে সময় চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে বাংলার একাধিক গ্রাম পর্তুগিজ কর্মকাণ্ডের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। পরবর্তীতে পর্তুগিজরা সংখ্যায় বাড়তে থাকে। খ্রিস্টধর্ম প্রচারে আসতে শুরু করেন আরও অনেকে। বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয় চার্চ। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় পর্তুগিজদের বংশধরের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার, যদিও 'বিশুদ্ধ' পর্তুগিজ বলতে মাত্র ৩০০। এই ২০ হাজারের অর্ধেকের বেশী বাস করত হুগলীতে। বাকিরা ছিল সপ্তগ্রাম এবং চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম তখন তাদের কাছে 'পোর্ট গ্রান্ডে' অর্থাৎ বড় স্বর্গ। আর সপ্তগ্রাম হচ্ছে 'পোর্ট পিকানো' অর্থাৎ ছোট স্বর্গ।
এরকমই কালের সাক্ষী হয়ে আছে চট্টগ্রামের পাথরঘাটার ৫০০ বছরের পুরানো ক্যাথিড্রাল চার্চ, বান্ডেল রোডের পাশে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা ভবন। বাংলাদেশের সবচয়ে প্রাচীন গির্জা। খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রাচীন গির্জা রয়েছে পনেরোটি। এরমধ্যে চট্টগ্রাম পাথরঘাটা ব্যান্ডেল রোডের 'আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারি ক্যাথিড্রাল চার্চ' সবচেয়ে প্রাচীন। বর্তমানে এই গির্জার নাম 'পবিত্র জপমালার রানি'। এক সময় চট্টগ্রামকে প্রাচ্যের রানি অভিধা দিয়েছিলেন পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ ক্যাম্পোজ। ক্যাম্পোজের মতনই চট্টগ্রামে এসে বসবাস করেছিলেন বহু পর্তুগিজ। তাঁদের স্মৃতিচিহ্ন আজও বহন করে চলেছে পাথরঘাটার গির্জা।
গির্জারই পরিচালন সমিতির মার্গারেট মণিকা জিনসের কথায়, "চট্টগ্রামকে পর্তুগিজরা বেছে নেয় তার কারণ, বঙ্গোপসাগর শহরের খুব কাছাকাছি। কর্ণফুলি নদী এরই মোহনা। নদীর পাশের জায়গাকে তারা বসবাসের আদর্শ জায়গা হিসেবে মনে করে। প্রথমে কেবল বর্ষাকালেই তারা বাংলায় ব্যবসা করত। বর্ষা শেষ হলে গোয়ায় ফিরে যেত। কেননা, গোয়া ছিল পর্তুগিজদের অন্যতম ঘাঁটি। পরে অবশ্য পর্তুগিজরা বাংলায় স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। এবং ধীরে ধীরে বণিক থেকে পরিণত হয় জলদস্যুতে। এখানেই তারা বিভিন্ন জায়গায় উপাসনার জন্য প্রার্থনা ভবন তৈরি করে। তার মধ্যে এই গির্জাটিও। এটি রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান গির্জা।"
পর্তুগীজ আমলে নির্মিত এই গির্জার ভেতরে দেওয়ালের স্তম্ভগুলিতে রয়েছে আকর্ষণীয় কারুকাজ। গির্জাকে ঘিরে রয়েছে সাধারণ ও পুরোহিতদের আলাদাভাবে নির্মিত সমাধিস্থল। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা ও সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা প্রার্থনায় মিলিত হন গির্জায়। প্রতি রবিবার সকাল সাড়ে ছ'টা, বিকাল সাড়ে চারটা ও সন্ধ্যা ছ'টায় অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রার্থনা সভা। ভেতরে-বাইরে বসতে পারেন পাঁচশোর বেশি মানুষ। টিনের ছাউনি দেওয়া প্রাচীন এই গির্জার পাশইে সাজানো রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সমাধি।
শের শাহ প্রবর্তিত বাংলায় পাঠান-করানি সুলতানদের শাসনের অবসান হলে অরাজকতার সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম দখল করে নেন বর্মা-আরাকানের মগ রাজারা। এই সময় মগদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে পর্তুগিজরা কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ তীরে বর্তমানের আনোয়ারা উপজেলাধীন দেয়াঙ এলাকায় তাদের বাণিজ্য কুঠি ও গির্জা নির্মাণ করে। দেয়াঙ, যা সমসাময়িক ইউরোপীয়দের বর্ণনায় দিয়াংগা নামে উল্লেখিত, পরিণত হয় বাংলা তথা ভারতবর্ষে পর্তুগিজদের প্রধান শহরে। যাকে তারা ব্যান্ডেল বা বন্দর নামেও অভিহিত করত।
এর ওপর পর্তুগিজরা মগদের সাথে যোগ দিয়ে ক্ষমতার স্বাদও পেতে থাকে। ফলে বণিক থেকে পরিণত হয় দস্যুতে। আরাকানের মগ রাজা তাদের বাংলায় লুঠতরাজ, নির্যাতন ও দস্যুবৃত্তিতে উৎসাহ দেন। পর্তুগিজরা তাদের নৃশংসতার জন্য শুধু চট্টগ্রামেই নয়, পুরো বাংলা ও ভারতেও প্রভূত কুখ্যাতি এবং নিন্দা অর্জন করে।
পাঁচশ বছর ধরে কর্ণফুলি দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। বাংলায় পর্তুগিজদের গোড়ার ইতিহাসও অনেকের অজানা। ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের বাসিন্দাদেরও এখন আর নজর নেই পর্তুগিজদের ইতিহাসে।