Advertisment

দুই তরফের মৌলবাদ ও বাংলাদেশের নির্বাচন

সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, নির্বাচনী ময়দানে মোট ৭০টি ইসলামি দল সক্রিয় রয়েছে। তার মধ্যে ৬৩টি আছে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র তথা প্রাক্তন সেনাশাসক এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

বাংলাদেশে সরকারের সমালোচনা করে ১০০ দিনের জেল খাটা চিত্র সাংবাদিক শহীদুল বাম জোটের প্রার্থীর সমর্থনে

বাংলাদেশ নির্বাচনের প্রাক সন্ধেয় রাজধানী ঢাকা শহর ছিল থমথমে। রাস্তাঘাট জনশূন্য। বিকেলের সূর্য ডুবতে না ডুবতেই বন্ধ হয়ে যায় অধিকাংশ দোকানপাট। শাসকদল আওয়ামী লীগ ছাড়া বিরোধীদের পোস্টার প্রায় নেই। বিএনপি সহ জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট এবং বামজোটের নেতাদের অভিযোগ, দেশ জুড়ে প্রবল সন্ত্রাস চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। সর্বত্র বিরোধী-দলের নির্বাচনী এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে। খুন, ধর্ষণ, এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ এবং সেনাবাহিনী কার্যত নিষ্ক্রিয়। বিভিন্ন জায়গায় তারা শাসকদলের সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ।

Advertisment

ঐক্য ফ্রন্টের নেতারা শনিবার নির্বাচনের আগের দিন ঢাকায় সাংবাদিক বৈঠক করে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে হাজির হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের আশা, জনগণই শাসকদলের "সন্ত্রাস" প্রতিরোধ করবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করছেন এমন আহ্বান আদতে বিরোধী জোটের সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই প্রকট করে তুলল। অন্যদিকে, প্রত্যাশিতভাবেই সন্ত্রাসের সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা ওবায়েদুল কাদের দাবী করেছেন, বিরোধী নেতারা নির্বাচনে হালে পানি পাবেন না জেনেই সন্ত্রাসের কাঁদুনি গাইছেন।

শনিবার দুপুরে সেনাবাহিনীর প্রধান আজিজ আহমেদও সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, নির্বাচনী পরিস্থিতি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ। তাঁর দাবী, দেশের ৪৭ বছরের ইতিহাসে তিনি নির্বাচনের প্রাকলগ্নে এমন পরিবেশ দেখেননি।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ-দলীয় জোট এবং বিএনপি-র নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট। এছাড়াও হাতপাখা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের ময়দানে আছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নামে একটি রাজনৈতিক দল। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি পুর এবং গ্রামীণ ইউনিয়ন নির্বাচনে এই দলটি চমকপ্রদ ফল করেছে। চর মোনাইয়ের পীর সৈয়দ মহম্মদ ফজলুল করিমের হাতে গড়া এই দল অনেকগুলি আসনে বড় দুই জোটের হিসাব উলটে দিতে পারে। চতুর্থ শক্তি হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণসংহতি আন্দোলন সহ আটটি দলের বামগণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থীরা। বেশ কিছু আসনে নজরকাড়া প্রচার করলেও বামেদের আসন জেতার সম্ভাবনা কার্যত নেই। দুই বড় জোটের শরিক হিসাবে হাতে গোনা কয়েকটি আসনে লড়ছেন জাসদ, ওয়ার্কাস পার্টি-সহ আরও কয়েকটি বাম দলের নেতারা।

আরও পড়ুন: কেন এবারে বাংলাদেশ নির্বাচনে ভারত নিয়ে কিছু বলছেন না কেউ?

নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে কিনা তা নিয়ে যেমন প্রবল সংশয় রয়েছে, তেমনই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে ফলাফল নির্ধারণে ইসলামি ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে বলে মনে করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, দু'পক্ষই জয়লাভের জন্য ইসলামি ভেটব্যাঙ্কের উপর বাজি ধরেছে। আওয়ামী লীগ নির্ভর করছে দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে থাকা ১৪ হাজার কওমি মাদ্রাসার ছাত্র সংগঠন হেফাজত-ই-ইসলামের উপর। অন্যদিকে বিএনপির ভরসা তাদের পুরনো মিত্র জামাত-ই-ইসলামি। প্রসঙ্গত, দুই জোটে শরিকদলগুলির অনেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে ক্ষুব্ধ। কিন্তু হেফাজত এবং জামাতের বিপুল ভোটব্যাঙ্ক সেই আপত্তিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে।

publive-image ঢাকার মীরপুরে নির্বাচন পূর্ববর্তী সন্ধে

পশ্চিমবঙ্গে বিএনপি এবং জামাতের সম্পর্কের বিষয়টি বহুলচর্চিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ যেভাবে কট্টর মৌলবাদী শক্তি হেফাজতের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে, তা অন্তত প্রকাশ্যে আলোচিত হয় না। হেফাজত নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন বলে দাবি করে। তারা সংগঠনের নামে নির্বাচনে লড়ে না। কিন্তু জয়-পরাজয় নির্ধারণে হেফাজতের ভূমিকা বিরাট। দেশের প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি ইউনিয়নে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত তাদের সংগঠন বিস্তৃত। ২০১৩ সালে ঢাকায় ৫ লক্ষাধিক জনসমাবেশ করে হাসিনার সরকারকে বিপাকে ফেলেছিল হেফাজত। সেই সময়ে হেফাজত নেতৃত্ব সরকারের বিরুদ্ধে ব্যপক মাত্রায় দমন-নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন।

কিন্তু গত কয়েক বছরে ক্রমশ আওয়ামী লীগ ও হেফাজত পরস্পরের কাছে এসেছে। তাদের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে, কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। ইসলামের চেতনার দোহাই দিয়ে আদালত থেকে মূর্তি অপসারণের দাবি জানিয়েছিল হেফাজত। তাও মানা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতাতেই নির্বাচনের প্রাক্কালে ঢাকায় সমাবেশ করে হেফাজতের 'বড় হুজুর' ৯৮ বছর বয়সী মওলানা শফি আহমেদ শেখ প্রধানমন্ত্রীকে 'কওমি জননী' আখ্যা দিয়েছেন। প্রকাশ্যে মঞ্চে উপস্থিত হয়ে হাসিনাও এই বন্ধুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের আশা, দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হেফাজতের বিপুল ভোট তাঁদের নৌকা প্রতীকের পক্ষেই থাকবে।

ইসলামি শক্তির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংযোগ অবশ্য নতুন নয়। হাসিনার জোটে তরিকত ফেডারেশন সহ বেশ কয়েকটি ছোট ইসলামি দল রয়েছে। নির্বাচনে লড়ছে না এমন আরও কিছু ইসলামি দলও নৌকার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম তালিকা প্রকাশ করে দাবি করেছে, নির্বাচনী ময়দানে মোট ৭০টি ইসলামি দল সক্রিয় রয়েছে। তাদের মধ্যে ৬৩টি আছে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র তথা প্রাক্তন সেনাশাসক হুসেইন মহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে। বিএনপির সঙ্গে আছে ৫টি ইসলামি দল, কোনও জোটে না থাকা ইসলামি দলের সংখ্যা ২।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য নিয়ে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বেশি তোলপাড় হয় ২০০৬ সালে। সেই সময় খেলাফতে মজলিশের সঙ্গে পাঁচ-দফা চুক্তি করেছিলেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলের একাংশ, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসাবে পরিচিত বামপন্থীরা অভিযোগ করেছিলেন, এই চুক্তি আদতে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা। বলা বাহুল্য, তাঁদের আপত্তি গুরুত্ব পায়নি। প্রসঙ্গত, বিএনপির জোটসঙ্গী জামাতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সর্বদা সরব হলেও ১৯৯৪-৯৬ কালপর্বে এই দুই দল একত্রে আন্দোলন করেছে।

আওয়ামী লীগের মৌলবাদ তোষণের অভিযোগ হিসাবে সমালোচকেরা আরও কয়েকটি বিষয়কে সামনে আনেন। তার অন্যতম রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং সংবিধানে বিসমিল্লাহ রেখেই সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা। বামেরা আরও অভিযোগ করেন, মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও আওয়ামী লীগের শাসনকালে একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটেছে এবং সরকার কোনও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাহ্যত আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিশ্রুতি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলে চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সুনিশ্চিত করা। কিন্তু এর পাশাপাশি সাংবাদিক বৈঠকে শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, তাঁরা ফের সরকার গড়লে সংসদে কোরান বিরোধী কোনও আইন পাশ করা হবে না। মুসলিম ভোট নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গসংগঠনও রয়েছে। সেটির নাম আওয়ামী উলেমা লীগ। দেশের ধর্মীয় আলেমদের বড় অংশ এর সদস্য।

publive-image আওয়ামী লিগ জোটের প্রার্থী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেমন

বিরোধীদের দাবি, বিএনপি এবং ঐক্য ফ্রন্টের বিরুদ্ধে একাধিকবার রাজাকার (মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনকারী) সংযোগের অভিযোগ তুললেও আওয়ামী লীগ নিজেই ২২ জন রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধীকে টিকিট দিয়েছে। এর মধ্যে একজন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আধিকারিক হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ বেশ পুরনো। অভিযোগের সারবত্তাও রয়েছে। বিএনপির দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামাত সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর আমলে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনকালে তারা ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে বিগত দশ বছরে জামাতের সাংগঠনিক শক্তি বিপুলভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাদের প্রধান নেতাদের অধিকাংশই হয় কারাগারে রয়েছেন, অথবা প্রাণদন্ডে দন্ডিত হয়েছেন। সম্প্রতি আদালতের রায়ে জামাতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। ফলে নিজেদের নাম ও প্রতীক নিয়ে তারা এবার নির্বাচনে লড়তে পারছে না। বিএনপির টিকিটে সে দলের ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জামাত নেতারা।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে এবারের নির্বাচনী ইস্যু: সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা

ঐক্য ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেন সহ বিএনপির সঙ্গী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলি জোটে জামাতের থাকা নিয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল। গণ ফোরাম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতারা জানিয়েছেন, জামাতের সঙ্গে তাঁদের কোনও সংযোগ নেই। তাঁরা জামাত প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী কাজ করবেন না। সম্প্রতি একটি বিদেশী সংবাদমাধ্যমে বিএনপির জামাত-যোগ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কামাল হোসেন। কিন্তু প্রবল শরিকি প্রতিবাদ সত্ত্বেও জামাতকে ছাড়েনি বিএনপি।

এর পিছনেও ভোটব্যাঙ্কের পাটিগণিত। বাস্তবে বিপুল শক্তিক্ষয়ের পরও দেশের বহু আসনে জামাতের ৪-৫ শতাংশ কমিটেড ভোট আছে। বিএনপির ধারণা ওই ভোটই নির্বাচনের রং বদলে দিতে পারে। কারণ ১৯৯১ থেকে আজ পর্যন্ত কোনও নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের ফারাক ৩-৪ শতাংশের বেশি হয়নি। তাই ক্লোজ ফাইটে জামাতের ভোট বড় ভরসা। এছাড়া আওয়ামীপন্থী হেফাজতের ইসলামি ভোট মোকাবিলার অঙ্কও রয়েছে। বিএনপি সূত্রের খবর, তাঁরা মনে করছেন হেফাজতের ভোট জামাতের মতো এককাট্টা নয়। তাই হেফাজতের থেকে আওয়ামী যা লাভবান হবে, জামাত-সঙ্গ তাদের তার চেয়ে বেশি সুবিধা দেবে। অন্তত ৫০টি আসনে জামাতের ভোট ফ্যাক্টর হবে বলে মনে করছে বিএনপি। প্রসঙ্গত, দুটিই ইসলামি সংগঠন হলেও হেফাজত ও জামাত আদর্শগত ভাবে সাপে নেউলে। হেফাজত দেওবন্দি ধারার এবং জামাত মওদুদপন্থী।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশ-দলীয় জোট। ফলে এই মুহূর্তে সংসদে বিএনপি-র কোনও সদস্য নেই। দলনেত্রী তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জেলবন্দী। তাঁর ছেলে তারেক রহমান গ্রেফতারি এড়াতে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ষাটের দশকের শেষ লগ্নের চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং শাসকদলের সন্ত্রাসের কারণে এবছরও আদৌ নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে বিএনপি-র অন্দরে মতভেদ ছিল। নির্বাচন বয়কটের পক্ষে থাকা নেতাদের মির্জা ফখরুল বোঝাতে সমর্থ হন যে এবারও আওয়ামী লীগকে ওয়াক ওভার দিলে দল অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এরপর বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু দলের সঙ্গে মিলে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ নেয়।

ঐক্য ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেন। বেশ কয়েক দশকের ব্যবধানে একাশি বছরের এই বৃদ্ধ আচমকাই বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম প্রধান চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। তুখোড় আইনজীবী কামাল ছিলেন শেখ মুজিবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান রূপকার ছিলেন তিনি। দীর্ঘ কয়েক দশক আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে সক্রিয় কামাল নব্বইয়ের দশকে গণ ফোরাম নামের নতুন দল গঠন করেন। নির্বাচনী রাজনীতিতে কখনও দাগ কাটতে না পারলেও কামাল হোসেনের ব্যক্তিগত ইমেজ গণ ফোরামকে আলোচনায় রেখেছিল। এই বছর জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠনের আগে কামাল বিএনপিকে জামাতের সঙ্গত্যাগের শর্ত দেন। শেষ পর্যন্ত তা রক্ষিত হয়নি। প্রবীণ এই নেতা নিজে এবার নির্বাচনে লড়ছেন না।

কামাল ছাড়াও আরও কয়েকজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা বিএনপি-র সঙ্গে ঐক্য ফ্রন্টে রয়েছেন। ‘বীর উত্তম’ কাদের সিদ্দিকি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ করেছেন। পরে দল ছেড়ে গঠন করেন কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ। তার মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকি টাঙ্গাইল থেকে ঐক্য ফ্রন্টের প্রার্থী হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আ স ম আব্দুর রব। জাসদের একাংশের নেতা রবও ঐক্য ফ্রন্টে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া মাহবুবুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যও ফ্রন্টের শরিক।

বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। বিরোধীরা নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানালেও তা ধোপে টেকেনি। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে যতবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে, প্রতিবার ক্ষমতাসীন দলই ফের সরকার গড়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি পরিচালিত দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনে বিএনপি বিপুল জয় পায়। কিন্তু সেই সরকার মাত্র ৮৬ দিন টেকে। চার মাস পরে ওই বছরের ১২ জুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে ভরাডুবি হয় বিএনপির। আওয়ামী লীগ ট্র্যাডিশন বজায় রাখে, নাকি ঐক্য ফ্রন্ট পাশার দান উল্টে দিতে পারে, তা জানতে আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা।

Sheikh Hasina Bangladesh
Advertisment