Advertisment

যখন বর্গী এসেছিল দেশে

শহর কলকাতা ও বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে নাম জানা ও না-জানা, স্বীকৃতি পাওয়া ও না-পাওয়া অনেক ঐতিহ্য। সে সব খুঁজে আনছেন দুই স্থপতি সুতপা যতি ও সায়ন্তনী নাগ। লিপিবদ্ধ থাকছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Bengal Heritage

ছবি- লেখক

       আঠেরো শতাব্দীর মধ্যভাগ। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবেদার নবাব তখন আলিবর্দী খাঁ। শুরু হলো মারাঠি দস্যুদের হামলা। বাংলায় তাদের বলা হত বর্গী। তাদের লুটপাট, খুনজখম, অত্যাচারে বাংলার মানুষ সন্ত্রস্ত। এমনকি, দুরন্ত ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর জন্য রচিত হয়েছিল ছেলেভুলানো ছড়া যা তিনশ বছর পরেও শোনা যায় বাংলার মায়েদের গলায়,

Advertisment

“খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়োলো, বর্গী এলো দেশে,

বুলবুলিতে ধান খেয়ে যায়, খাজনা দেব কিসে ?”

১৭৪২-১৭৫২ এই দীর্ঘ দশ বছর চলেছিল লুঠতরাজ আর অরাজকতা । ভাস্কর পণ্ডিত আর রঘুজী ভোঁসলে এই দুই মারাঠা সর্দারের পরিচালনায় তৈরী হয়েছিল বিরাট এক বাহিনী। প্রথমটায় আলিবর্দী খাঁ কড়া হাতে বর্গী আক্রমণ প্রতিহত করে বাংলায় শান্তি আনার চেষ্টা করেন কিন্তু তাঁর পক্ষে বেশিদিন এই লড়াই সম্ভব হল না। বর্গীরাও অনেক বেশি হারে খাজনা বা কর (তাদের ভাষায় চৌথ অর্থাৎ নবাবকে দেওয়া করের এক চতুর্থাংশ) আদায় করতে লাগলো। এই পরিস্থিতি শান্ত হলো যখন বাংলার নবাব মারাঠাদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করলেন। মীর হাবিবের মৃত্যুর পর মারাঠারা বাংলা থেকে চলে যায়। তবে কিছু বর্গী ফিরে না গিয়ে এই বাংলাতেই রয়ে যায়। লুঠপাট ছেড়ে অন্য ব্যবসাবাণিজ্যর সঙ্গে যুক্ত হয়। যারা রয়ে যায়, তারা ইতিমধ্যেই লুঠের ধন, চৌথ আদায় এবং ব্যবসার কারণে প্রচুর বড়লোক হয়ে উঠেছিল। অঢেল ধনসম্পত্তির মালিকানা ছিল তাদের হাতে।

আরও পড়ুন, সেন্ট জনস চার্চ: যেন এক জাদুঘর

তেমনই এক মারাঠী বংশ কুন্দাস বা কুন্দন। বাংলার জলবায়ুতে মিলমিশ হতে গিয়ে  তারা ক্রমে হয়ে গেল কুণ্ডু। ১৭৬৬ সালে এই কুণ্ডু পরিবারের সাফল্য নারায়ণ কুণ্ডু হুগলির কাছাকাছি বর্গীডাঙায় তৈরী করলেন এক রাজবাড়ী। প্রাসাদ তৈরির মূল উপাদান ইট ও চুন, তাই তার নামও হল ইটাচুনা রাজবাড়ি। আর বর্গীডাঙার নাম হোলো ইটাচুনা। ইটাচুনা গ্রামে পৌছানো যায় হাওড়া বর্ধমান মেন লাইনের লোকাল ট্রেনে। স্টপেজ খন্যান ষ্টেশন। সেখান থেকে মিনিট দশেক অটো বা টোটোতে।

আরও পড়ুন, হাওড়ার জানবাড়ী: তন্ত্রসাধনার গর্ভগৃহ 

জমিদারী প্রথা কবেই বিলুপ্ত, আজকাল জমিদার ও রাজবাড়ীগুলো অধিকাংশই তত্ত্বাবধানের অভাবে বিলুপ্তির পথে। কিন্তু সাফল্য নারায়ণ কুণ্ডুর চোদ্দোতম বংশধর ধ্রুব নারায়ণ কুণ্ডু রাজবাড়ীর নিয়মিত সংস্কার জারি রেখেছেন এবং ব্যবসায়িকভাবে এটি ব্যবহার করে টিকিয়ে রেখেছেন রাজবাড়ীর রূপ ও ঐতিহ্য।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari রাজবাড়ির রূপ

বেশ কিছু সিনেমা ও অজস্র বিজ্ঞাপনী ছবির শুটিং হয়েছে এখানে। আপাতত এটি একটি হেরিটেজ হোটেল। ইটাচুনার রাজবাড়ী এখন হুগলি জেলার পাণ্ডুয়া ব্লকের ইটাচুনা খন্যান গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari ঐতিহ্যবাহী ঘড়ি

কলকাতা থেকে ৯০ কিমি দূরে অবস্থিত ইটাচুনার রাজবাড়ী গঠনগত দিক দিয়ে সাবেকী জমিদার বাড়ীর স্বাদ এনে দেয়। বিশাল লোহার গেট পার হলেই চোখে পড়বে ইংরাজীর ‘ইউ(U)’ আকৃতির প্রকাণ্ড দোতলা রাজবাড়ী।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari ইউ(U)’ আকৃতির রাজবাড়ী

বাড়ীটি একটি উঠানকে ঘিরে নানা মহলে বিভক্ত । ঢুকেই বিশাল সবুজ চত্বর, তার পরের উঠানে রয়েছে নাটমন্দির, তারও পরে অন্দরমহল। একেবারে পেছনে খিড়কি পুকুর।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari খিড়কি পুকুর

ইটঁ আর চুন সুরকির তৈরী এই স্থাপত্য তার গরিমা প্রকাশ করে উচুঁ উচুঁ ধাপের সিঁড়ি, চারদিকে বিশাল চকমেলানো বারান্দা, প্রকাণ্ড আয়তনের ঘর, খড়খড়ির জানলা, প্রাচীন আসবাব, দেওয়ালে হরিণের শিং, কচ্ছপের খোলস দিয়ে তৈরী যুদ্ধের ঢাল, বারান্দার গোল থাম আর খিলানের ফাঁক দিয়ে আসা ঝিকিমিকি রোদ্দুরে।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari কচ্ছপের খোলস দিয়ে তৈরি ঢাল

সাবেকিয়ানার ছাপ সর্বত্র। তিনমহলা রাজবাড়ীর বহির্মহলে অফিস অর্থাৎ সেরেস্তার কাজকর্ম হতো। এক সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অফিসও ছিল। প্রবেশপথের খিলানের উপর লেখা শ্রীমদভাগবতগীতার বাণী

“পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম পিতাহি পরমং তপ

পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা ”।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari প্রবেশপথ

এর ঠিক উপরে লেখা ‘১৮৯৪ সালে শ্রী নারায়ণ কুণ্ডু মহাশয় কতৃক পুনঃসংস্কৃত। এই প্রবেশপথের দোতলায় জোড়া গোলাকৃতি থামের উপর ছোট ছোট দুটি কারুকার্য মন্ডিত সাদা খিলান, তার উপর বড় একটি খিলান। সবটাই ফুল লতাপাতায় নকশা করা, তার উপরে এই রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠার কথা লেখা- “১৭৬৬ সালে সাফল্য রায় কুণ্ডু মহাশয় কতৃক স্থাপিত”। সবার উপরে কুলদেবতার আশীর্বাদ প্রার্থনা “শ্রী শ্রী শ্রীধর জিউ কৃপাহিকেবলম”।

প্রাসাদের মাঝের অংশে ঠাকুরদালান। প্রশস্ত দালানের দুধারে সার দিয়ে সুন্দর শিল্পিত বাতিস্তম্ভ,মেঝেয় আলপনা। মন্দিরে নারায়ণ বিগ্রহ আছে শ্রীধর জিউ রূপে। বিগ্রহ যেখানে অধিষ্ঠিত তার সামনে গোলাকৃতি বারান্দা, তাকে ধরে রেখেছে তিনটি থাম। থামগুলি আবার ছোট ছোট থাম সংলগ্ন করে তৈরী। সুন্দর তিনটি খিলান বা আর্চ দিয়ে ধরে রাখা আছে বারান্দার এই গোলাকৃতি অংশটি।খিলানের মাথায় সমাজচিত্রর ছবি প্লাস্টারে ফুটিয়ে তোলা আছে। অন্দরমহলে রয়েছে বড় বারান্দা,সিঁড়ি আর ছাত যা দিয়ে অন্দরমহলের সব ঘরগুলিই সংযুক্ত। এক মহল থেকে অন্য মহলে যাতায়াত রীতিমত গোলকধাঁধার মতো। বারান্দার মাথায় চোখে পড়ে টালির ছাউনি। আর নানা তলে বিভক্ত ছাদে উঠলে বোঝা যায় এই বাড়ির বিশালত্ব।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari টালির ছাউনি

শুধু রাজবাড়ীর ভিতরে নয়, রাস্তার অপর পাড়েও রয়েছে রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দির। এই মন্দিরে শিবের মুর্তির বিশেষত্ব নজর কাড়ে। কথিত আছে এই বংশের একজন বিহারে ইংরেজ আমলে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরী করতেন। সেখানে উনি এই বিগ্রহটি পান এবং ইটাচুনায় প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিবমূর্তিটি জটাধারী, গোঁফওয়ালা কোন এক যোগী পুরুষ যেন বসে আছে। এধরনের মূর্তি সাধারণত কোথাও দেখা যায় না।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari শিবের আশ্চর্য মূর্তি

শোনা যায় এই শিবের পুজো শুরু হবার পরেই কুণ্ডু বংশে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে, ফলে তাঁরা আর এই মূর্তির পূজা করেন না, গ্রামবাসীরাই নিত্যপূজা চালান। মন্দিরের আকৃতিও একটু বিশেষ ধরনের। ভিতরের দিকে গোলাকৃতি। সামনে গথিক আর্চ দিয়ে তৈরী বারান্দা, মন্দির চূড়ায় বিভিন্ন খাঁজকাটা। সামনে প্রাঙ্গণে রয়েছে  শিবের বাহন নন্দীর মুর্তি। রয়েছে সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত তুলসী মঞ্চ। এই রকম তুলসী মঞ্চ খিড়কির পুকুরের দিকেও নজরে আসে। বিশাল খিড়কি পুকুর, মাছ রয়েছে এখানে, যা অতিথিরা ছিপ ফেলে ধরতে পারেন, কিন্তু মারবার নিয়ম নেই, ফের জলে ছেড়ে দেওয়াই দস্তুর। বাগানে রয়েছে রয়েছে ধানের গোলা, ঢেঁকি।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari ঢেঁকি

রয়েছে বিশাল দাবার বোর্ডও।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari সুবিশাল দাবা বোর্ড

পুরোনো গোয়াল হয়েছে চা-ঘর। আর রয়েছে অতিথিদের জন্য আধুনিক সুবিধাযুক্ত মাটির কটেজ।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari অতিথিদের জন্য মাটির কুটির

এই সাবেকিয়ানা, এই রাজকীয়তাকে চলচিত্রে বাস্তবরূপ দেবার জন্য বহু হিন্দি ও বাংলা সিনেমাতেই এই রাজবাড়ীকে ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন লুটেরা, পরান যায় জ্বলিয়া রে, রাজমহল প্রভৃতি। তবে এখন আর রাজবাড়ী সিনেমার জন্য ভাড়া দেওয়া হয় না। কারণ রাজবাড়ীকে সিনেমায় ব্যবহার করার জন্য পরিচালকরা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করেন, রঙ করেন, যা এর ঐতিহ্য ও গঠনের পক্ষে ক্ষতিকারক। তাই বর্তমান বংশধর ধ্রুবনারায়ণ কুণ্ডু যাবতীয় ঐতিহ্য বজায় রেখেই এটিকে হেরিটেজ হোটেলে পরিণত করেছেন। বিভিন্ন ঘরের নামকরণও করেছেন পরিবারের যে যে ঘরে যে যে সদস্যরা থাকতেন সেই সব নাম দিয়ে। যেমন গিন্নিমা, বড়মা, বড়পিসি, বড় বউদি, জেঠামশাই, কাকাবাবু, বড়দি ইত্যাদি। অতিথিদের মাটির পাত্রে শরবত দিয়ে বরণ করা হয়। খাবার পরিবেশিত হয় কাঁসার পাত্রে। এমনকি রসুইঘর আজও তাঁরাই সামলান, যারা বংশপরম্পরায় জমিদার বাড়ির রান্নার দায়িত্বে ছিলেন। বাঁশুরিয়া বাঁশি বাজিয়ে ফেরে অতিথিদের ঘরের দ্বারে দ্বারে। রাতে গা ছমছমে পরিবেশে পল্লবিত হয় ভূতের গল্প।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari কাঁসার বাসনে ব্যঞ্জন

নাই বা রইলো রাজপাট, নাই বা হলেন রাজা, জমিদারগৃহে একদিন বাস করে এখানে কদিন রাজা সাজাই যায়। পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাবার জন্য গাইডেড ট্রিপের ব্যবস্থা আছে। বারান্দায় প্রাচীণ আরামকেদারায় হেলান দিয়ে, লাল মেঝেতে রোদের আলপনা আর দেওয়ালে হরেকরকম পুরানো দিনের সাদাকালো ছবি দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। সাবেকী বৈঠকখানা আজো সজ্জিত পুরোনো অস্ত্র, ঝাড়বাতি, শ্বেতপাথরের টেবিল, গড়গড়া, টানা পাখায়।

Bengal Heritage, Itachuna Rajbari অন্দরের ঝাড়বাতি

প্রহরে প্রহরে ঢং ঢং ঘন্টার নিনাদ জানান দেয়, নতুন যুগেও ইটাচুনার রাজবাড়ী তৈরী, তার অতিথিদের বরণ করার জন্য।

heritage
Advertisment