প্রচণ্ড অদ্ভুত একটা পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে এই লকডাউন। মানুষ স্বভাবতই সমাজবদ্ধ জীব, 'সোশ্যাল অ্যানিম্যাল'। মানুষকে মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, দেখা করতে হয়, নাহলে অনেকরকমের সমস্যা দেখা দেয়। একটা অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়, তার সঙ্গে যুক্ত থাকে একটা মানসিক চাপ। সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত মানুষ। এই মুহূর্তে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি শরীরকে, শরীর যাতে সুস্থ থাকে। এই শরীরকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে - বা বলা ভালো এক ধরনের শরীরকে - যাতে করোনাভাইরাস না ঢোকে, সেটা করতে গিয়ে আমাদের ক্ষিদের জ্বালা থেকে মানসিক বিপর্যয়, সবই সামলাতে হচ্ছে।
আর্থিক দিকটার কথাই ধরা যাক। এই লকডাউনের ফলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বড় রকমের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছি। কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের রোজগারের একটা বড় অংশ আসে লাইভ কনসার্ট থেকে। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ছবির কাজগুলো, এবং সেখানে যেহেতু শুটিং বন্ধ, এর পর কবে শুটিং হবে জানি না, সুতরাং গান কী হবে তাও জানি না। অতএব সেই কাজটাও বন্ধ। এবার ভাবুন, আমার রোজগার কিন্তু আমার একার নয়, এর সঙ্গে কিন্তু অনেক মিউজিশিয়ান, এবং ইন্ডাস্ট্রির আরও অনেকে জড়িত। তাঁদের কী অবস্থা হচ্ছে, সেটা ভেবে আমার ওপরেও একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
এই গোটা কাঠামোটা একটা পিরামিডের মতন, নামতে নামতে এমন একটা জায়গায় ঠেকছে, যেখানে মানুষ দৈনন্দিন শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। সেই জায়গাটায় অবস্থা কিন্তু খুব খারাপ, এবং তাঁরা যে কোনও সময় রাস্তায় নেমে পড়তে পারেন। খিদের জ্বালায় তখন আর লকডাউন মানবেন না। আমাদের দেশ যেখানে কিছুই ঠিক করে সামলাতে পারে না, সেখানে এরকম পরিস্থিতি আমরা কীভাবে সামলাব আমি জানি না। খুব বড় চ্যালেঞ্জ।
আমি এখনও মানসিকভাবে অতটা ভেঙে পড়ছি না এই মুহূর্তে, কারণ আমি স্বভাবতই ঘরকুনো, বাড়িতে থাকতে ভালোবাসি। তবে সেই থাকাটা রাজার মতো হলে এক কথা। বর্তমানে অবস্থা খুব খারাপ। এই মুহূর্তে রান্না, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাচা, সবই করছি। কিছুদিন আগেই টুইট করেছিলাম, "My work-life balance has really gone for a toss", তার কারণ 'ওয়ার্ক' তো সব বন্ধ, এবং 'লাইফ' মানেই হয়ে দাঁড়িয়েছে গৃহকর্ম। এবার এই কর্মে আমার দক্ষতা কতটা জানি না, কিন্তু সময় খুব বেশি লাগে, কারণ আমি তো অভ্যস্ত নই এতে। বাসন মাজতে কয়েক ঘণ্টা চলে যাচ্ছে, একটা তরকারি কুটতে, আলু-পটল ঠিক করে কাটতে, আমার একঘণ্টা চলে যাচ্ছে। এই করে দিনটা হুহু করে কেটে যাচ্ছে, হঠাৎ দেখছি আবার রাত্তির, জগে জল নেই, ভরতে হবে। এই প্রক্রিয়াটা চলতেই থাকছে।
সারা পৃথিবীতেই কমবেশি এক অবস্থা। করোনাভাইরাস কাউকেই ছাড়ে নি, তিনি প্রিন্স চার্লসই হন বা হরিপদ কেরানি। আমার মনে হয়, দুনিয়ায় যত সরকার আছে, তারা যে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কতটা অবহেলা করেছে, তা এবার বোঝা যাচ্ছে। এই যে এত টাকা তোলা হয় ট্যাক্স হিসেবে, তার কিছুই প্রায় স্বাস্থ্য পরিষেবার পেছনে খরচা হয় না। তাই আমরা এত অপ্রস্তুত, তাই এত ডোনেশন লাগছে। পুরোটাই যেন যোগাড়যন্ত্র করে চলছে। আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে হাসপাতাল নেই, এই ধরনের মহামারীর মোকাবিলা করার কোনও সামর্থ্যই নেই। তবে এত ট্যাক্স দিচ্ছি কেন? টাকাটা যাচ্ছে কোথায়?
এই নিয়ে প্রশ্ন তুললে অনেকেই দেশের নিরাপত্তার ওপর খরচের কথা বলেন, কিন্তু তা দিয়ে কী হবে যদি মানুষই না বাঁচে? হাসপাতালে ভর্তি হলেও কী পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে আমরা জানি না, পুরোটাই যেন ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে গেছে, স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যাপারই নয় আর। এবং এই অবস্থা শুধু ভারতের নয়, আমেরিকার বা অন্য কোনও উন্নত দেশেরও। পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবা, তাই এত মৃত্যু দেখতে হচ্ছে। ইউরোপের তথাকথিত সভ্য দেশেরই বা কী অবস্থা? সাদা কথায়, যে দুটো ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মনোনিবেশ করা প্রয়োজন, সেই দুই ক্ষেত্রের দিকেই সবচেয়ে কম নজর আমাদের - শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য।
এর ফলেই আজ আর পয়লা বৈশাখের কোনও মাহাত্ম্য আমি বুঝছি না। ভবিষ্যতে যদি কোনোদিন আদৌ লিখি আজকের এই পরিস্থিতি নিয়ে, আমার মনে হয় না কেউ পড়তে বা শুনতে চাইবেন, কারণ সকলেই ভুলে যেতে চাইবেন আজকের এই বিভীষিকার আবহ।
তবে যেহেতু টানা বাড়িতে আছি, তাই নিজেকে সময় দিতে পারছি। সেই কারণেই একান্ত নিজের জন্যই কিছু গান লিখছি, সুর করছি। এবং ঠিক করেছি, কেউ যদি অবসাদে ভোগেন, আমাকে ফোন করতে পারেন, আমি কথা বলব। আর কিছু করতে না পারি, শুনতে তো পারব।
(লেখক প্রখ্যাত, গায়ক, গীতিকার, সুরকার, এবং কবি। মতামত ব্যক্তিগত)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন