একটা তুলনামূলক আলোচনা চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে 'হলোকস্ট' ছিল, আউশউইটজ ছিল, আমাদের অত খারাপ অবস্থা বোধহয় এখনও হয় নি। যে হারে মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারা গেছেন, যে ভয়াবহ দারিদ্র পৃথিবীতে এসেছিল, যে ব্যাভিচার ঘটছিল, সেটার সঙ্গে আমার মনে হয় না কোনও কিছুরই তুলনা হয়। সুতরাং অনেকেই বোধহয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা টানতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন। যাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটুও এই পৃথিবীর খবরাখবর রেখেছিলেন, আমরা তো পরে ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে জেনেছি, তাঁরা জানবেন যে বিষয়টা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ছিল সেই সময়।
হ্যাঁ এখানে গোলাগুলি, কামান অস্ত্র, হিটলারের নাৎসিতন্ত্র, এসবের উর্দ্ধে উঠে অন্যরকমের একটা বিপদ বটে। চোখে দেখা যায় না, এমন এক শত্রুর সঙ্গে লড়াই। তবে আমি খুব একটা আশ্চর্য নই। আমরা অনেক লেখায় পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি, যে মানুষ মানুষকে অপদস্থ করার জন্য নানান ভাবে নানারকমের ফন্দিফিকির সারাক্ষণ ভাবতে থাকে। এই যে লজিক বেরিয়েছে যে এটা খুব সম্ভবত 'বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার', অর্থাৎ জৈব যুদ্ধ, সেটাই কোথাও থেকে বুমেরাং করে মানুষের পেছনে লেগেছে অন্যভাবে, আমার মতে।
মানে ভগবান হালকা করে 'রিসেট' বোতামটা টিপে দিয়েছেন আর কী। ভাবটা এমন, বড্ড লাফালাফি হচ্ছে, একটু থামো। থেমে গালে হাত দিয়ে একটু বোসো, একটু ভাবো। আমরা যে প্রচণ্ড গতিতে ছুটছিলাম, আমাদের পৃথিবীর রেভোলিউশন, রোটেশন, যা যা বিজ্ঞানে বলে, তার চেয়ে অনেক বেশি গতিময় আমাদের বাস্তবিক জীবন, যেখানে একে অপরের জন্য একটু থামার সময় নেই। আমার মনে হয় এই ভাইরাসের আক্রমণের ফলে আমরা যে যার মতন করে একটু ভাবনাচিন্তা করার সময় পেয়েছি। সেই মানুষটা, যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খেটে চলেছে, এবং বাড়ি ফিরে এসে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে বলছে, "খাটছি কার জন্য?", অথচ সেই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা তাকেই কাছে পায় না, তারা ভাবে, "এই লোকটা রোজ আমাদের এই কথাটা শোনায় কেন?"
এবার সময় বিরক্ত হয়ে ভেবেছে, "দূর, তোমার এই খাটনি বন্ধ করার একটা উপায় বের করছি দাঁড়াও।" এবং কষে দিয়েছে COVID-19 ঠুকে আর কী। COVID-19 হচ্ছে যেন জনতার বিরুদ্ধেই একটা জনস্বার্থ মামলা। আসলে জনতার স্বার্থ কী, সেটা কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা ভেবে বের করতে পারি নি। এবার সেই মামলাটাই ওপরওয়ালা বলো, বিধাতা বলো, জোরে ঠুকে দিয়েছে, এবং সেই মামলার কাগজপত্র নিয়ে যে আদালতে যাওয়া হবে, লকডাউনের ফলে সেই উপায়ও নেই। কাজেই মামলাটা এগোচ্ছে না। বিচারপতিরাও আসছেন না, ভয়ের চোটে সবাই সিঁটিয়ে রয়েছেন।
তবে আমার মনে হয় সব জাতির মধ্যে বাঙালি জাতি এই লকডাউন এবং করোনাভাইরাসের ফলে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ আমাদের মধ্যে এমনিতেই এতরকম শুচিবাই রয়েছে, যেমন একটা তালাতে চাবি দেওয়ার পর দশবার সেটা টেনে টেনে দেখা, বাড়িতে দশজন লোক থাকলে দশজনকেই বলা, "তালাটা দেখে নিস বস! তালাটা দিলাম তো?" তা এই শুচিবায়ুগ্রস্ত বাঙালির করোনাভাইরাস কতটা ক্ষতি করবে, আমার সন্দেহ আছে।
এক কাপ চায়ে ঘরকুনো বাঙালির আরামসে দেড় দু-ঘন্টা কেটে যায়। সেই কাপে তুফান উঠল, নাকি স্রেফ বুদবুদ ছড়াল, তাতে কিছু যায় আসে না। সেই ঘরকুনো বাঙালি এখন নাকি ঘর থেকে বেরোতে চাইছে। তবে অবস্থাগতিকে এখন আমাদের সবারই সীতার মতো অবস্থা, বাড়ির ভেতরে থেকে থেকে। কেউ একজন লক্ষণ, সে আমাদের বাড়ির বাইরে একটা রেখা টেনে দিয়ে চলে গেছে, বলেছে, "এর বাইরে বেরোলেই কেস"।
আমাদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ওয়ার্কিং অ্যাট হোম, হোমওয়ার্ক, সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বাঙালি এরকম বসন্ত কোনোদিন দেখে নি। পাশের পাড়ায় পাখি ডাকলেও এ পাড়ায় শোনা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে আমাদের নিজেদের কয়েকটা প্রশ্ন করা খুব দরকার। পয়লা বৈশাখে আরও বেশি করে করা দরকার - ১) আমাদের কি খাবারদাবারের খুব অভাব হচ্ছে? উত্তর: না; ২) বাড়িতে তিনবেলা রান্না জুটছে? উত্তর: হ্যাঁ জুটছে; ৩) মাথার ওপর ছাদ আছে? উত্তর: হ্যাঁ আছে; ৪) গত এক তারিখ স্যালারি ঢুকেছিল? উত্তর: হ্যাঁ ঢুকেছিল; ৫) বাড়িতে আড্ডা মারার লোকজন আছে? উত্তর: হ্যাঁ আছে; ৬) পাশের বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে এহন তার খবর পাচ্ছ? উত্তর: হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার বাড়িতে কী হচ্ছে সে খব পাওয়ার আগেই।
তা এইগুলো যদি সবই হ্যাঁ হয়, তবে তো আর চাপ হওয়ার কথা নয়। এগুলোই তো বাঙালির ভালো থাকার মাপকাঠি। আমাদের রবি-নজরুল হাত ছাড়িয়ে কোথাও চলে যান নি, আমরা এখনও যামিনী রায়ের ছবি দেখে ভীষণভাবে আপ্লুত হয়ে পড়ি, আমাদের রক্তে এখনও রয়েছে মার্ক্সবাদ (বাকি কী কী বাদ চলে গেছে সেটা আলাদা প্রশ্ন)।
এতে মনে হলো, চারদিকে সকলে 'মাক্স মাক্স' করে পাগল হয়ে গেল একেবারে। প্রথমে মনে হচ্ছিল, এত করে কার্ল মার্ক্সের কথা কেন উঠে আসছে? সবাই বলছে, 'মার্ক্স বাদ দেওয়া যাবে না, মার্ক্স বাদ দেওয়া যাবে না'। আসলে কেউ তো 'মাস্ক' বলছে না, সবাই বলছে 'মাক্স'। "মাক্স পড়ো/পরো নি?" এবার এই 'ড়' আর 'র'-এর বিপর্যয় থেকে তো আর বাঙালিকে উদ্ধার করা যাবে না। যাই হোক, নতুন জামা, শাড়ি, পাঞ্জাবি, ধুতি যাই পরো না কেন, সঙ্গে একটা 'মাক্স' পরতে হবে। এটা ভাই ১৪২৭-এর নতুন একটা প্রাপ্তি। 'আমরা কোনোদিন মুখ লুকিয়ে থাকতে শিখি নি' বললে হবে না, আপাতত একটু মুখ লুকিয়েই থাকতে হবে।
এই হলো বাঙালির হাল। তবে সেই হালটা এখন আর খাতায় লিখে রাখতে পারছে না। তাই 'হালখাতা' নেই। আর যাঁরা আপসোস করছেন, "ইস, ওই অমুক রেস্তোরাঁর পয়লা বৈশাখ স্পেশালটা মিস হয়ে গেল", তাঁদের বলছি, বিয়ের সময় শ্বশুরমশাই যে কাঁসার থালাবাটি দিয়েছিলেন, সেগুলো ঘষে মেজে নিজের মতো পঞ্চব্যঞ্জন তৈরি করে নিন। কারণ বাঙালিকে কেউ খেতেই বলুক বা খাওয়াতে, বাঙালি কোনোদিন পিছিয়ে যায় না।
আর শেষ পাতে একটা কথা বলে রাখি, যেটা রেডিওতেও বলেছিলাম, "গড়পড়তা মানুষ আর ক্রিমিনালের মধ্যে কোথায় তফাৎ? ক্রিমিনালের ভাগ্যে লক 'আপ', আর সাধারণ মানুষের ভাগ্যে লক 'ডাউন'!"
শুভ নববর্ষ।
(মীর আফসর আলি প্রখ্যাত রেডিও ব্যক্তিত্ব তথা সঞ্চালক। মতামত ব্যক্তিগত)