/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/06/20200519_142514.jpg)
সন্তানের নামকরণে বাবা-মায়ের পছন্দ নিয়ে কেউ আপত্তি করলে নিশ্চয় অসভ্যতা। আড়ালে আবডালে হাসাহাসি হতে পারে, দ্বিতীয়জন না দেখলে, না শুনলে ঝামেলা নেই। কী ঘটনায়, কোন কারণে, কার কী নামকরণ, এবং নামকরণে ইতিহাসও যুক্ত, কখনও কখনও।
বাংলায় বিস্তর উদাহরণ। চৈত্র মাসে মেয়ের জন্ম হলে, আদর করে মেয়ের নামকরণ 'চৈতি'। শ্রাবণ মাসে 'শ্রাবণী' (বা 'শাওন'), ঘোর বর্ষায় 'বর্ষা'। বৈশাখ মাসে 'বৈশাখী', হেমন্তে 'হৈমন্তী' বা 'হেমন্তী'। পুত্রসন্তান 'হেমন্ত'। বসন্তে 'বাসন্তী', পুত্র 'বসন্ত'। শরতে 'শরৎ'। আবার মাস বা ঋতুর স্মরণেই যে নামকরণ, সর্বদাই নয় তা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্রী কোয়েলি সেন (বিয়ের পরে ঘোষ)-এর জন্মের সময় কি কোকিল ডেকেছিল? বলতে অপারগ।
বিভিন্ন নক্ষত্রের বিভিন্ন নাম। স্বাতী, শতভিষা, অরুন্ধতী, শুকতারা নামে বাংলায় বিস্তর নারীর নাম। আছে প্রভাতী, বৈকালী, সন্ধ্যা। নদীর নামেও নামকরণ। যমুনা, গঙ্গা, পদ্মা, তিস্তা, মেঘনা, তিতাস। ইদানীং আবার ঝড়, সাইক্লোনের নামেও। 'আয়লা'-র সময়ে নিশ্চয়ই বহু সন্তানের জন্ম, এশিয়ায়। বাংলাদেশে দুইজনের নাম 'আয়লা'। একজন কন্যা, একজন পুত্র। ঢাকার কাগজে পড়েছিলুম।
আরও পড়ুন: গির্জার ধর্মীয় বোধ, বাঙালির ঈদ
মিনিয়াপোলিসে একজন 'ব্ল্যাক'-কে হত্যা নিয়ে গোটা আমেরিকা তোলপাড়। ক্রমশ বাড়ছে। সামাল দিতে হিমশিম, কর্তৃপক্ষ দিশাহারা। জার্মান টিভিতে দেখলুম এক তরুণীর সাক্ষাৎকার। নাম 'সুনামি' (সুনামি গোল্ডস্টাইন)। রিপোর্টারের প্রশ্ন: "কেন এই নাম?" তরুণীর উত্তর, "সুনামি দুর্যোগের সময়ে আমার জন্ম"।
তখন পূর্ব পাকিস্তান। নভেম্বর ১৯৭০ সাল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, দক্ষিণবঙ্গে হাতিয়া, সন্দ্বীপ, পটুয়াখালি, ভোলা - নানা অঞ্চলে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, মুহূর্তে বন্যা, এতটাই যে চোখের নিমেষে সমুদ্র-নদী-হাওড়-বিল সব একাকার। জল আর জল। কোথাও কিছু দেখা যায় না। সবই জলমগ্ন। প্লাবিত। দিগন্তের হদিশ নেই।
বঙ্গোপসাগর কখন, কীভাবে ফুলেফেঁপে ফুঁসে টাইফুনে পরিণত, আবহাওয়াবিদরাও হদিশ পাননি। তখন অবশ্য আজকের দিনের মতো আবহাওয়া নিয়ে বৈজ্ঞানিক কেরামতি ছিল না। ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি টাইফুন-টর্নেডোর মারাত্মক আক্রোশ। রাতের আঁধারে ১৬ মিটার উঁচু জল, ঢেউ সাগর থেকে আছড়ে পড়ে। যেন পাহাড়, দিগন্তবিহীন। এরকম তুফান-প্রলয়কান্ড দেখেনি কেউ, ইতিহাসেও বিরল। কেউ কেউ বলেছেন নূহ'র (নোয়া) প্লাবন। ওল্ড টেস্টামেন্টে কথিত নূহ তথা মিথিক্যাল নূহের প্লাবন আমরা দেখিনি। বলতে পারব না, নূহের প্লাবনের সঙ্গে ১৯৭০-এর নভেম্বরের টর্নেডো-প্লাবনের মিল অমিল।
এটুকু জানি, সেই রাতে (তারিখ সঠিক মনে পড়ছে না) ৫০ হাজার মানুষ মারা যান। সলিল সমাধি। বলা হয় বিবিসির রিপোর্টে। সংবাদদাতা ফয়েজ আহমেদ, ঢাকা থেকে। ওই রিপোর্টেই উল্লেখিত, মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, ঘরবাড়ি, গবাদি পশু নিশ্চিহ্ন। প্রকৃতি বিধ্বস্ত। দুদিন পরে আরও বিস্তারিত খবর। কোনোরকমে বেঁচে থাকা মানুষের আর্তনাদে বাতাস মুখরিত। চারদিকে ভাসমান লাশ। বাতাসে লাশের গন্ধ।
'পাকিস্তান অবজারভার' পত্রিকায় তখন একটি খবর বেরিয়েছিল, ভোলার দুই যুবকযুবতী মায়ায় জড়িত, দুই পরিবার থেকে বিয়ে দিতে নারাজ, বিচ্ছিন্ন করা হয়। জলোচ্ছ্বাসের দাপটে অন্যদের মতো তারাও ভাসমান। কিন্তু, 'প্রেমের মরা জলে ডোবে না', ভাসতে ভাসতে দুজনের দেখা, পটুয়াখালিতে, কোনোক্রমে ডাঙায়, পরস্পরকে জড়িয়ে। অতঃপর মিলন।
আরও পড়ুন: করোনা, ঘূর্ণিঝড় ও নিমাইয়ের বৌ
মনে পড়ছে দক্ষিণবঙ্গের প্রলয়ঙ্করী তুফানে আমরা যারা ঢাকায়, রাতে (দশটাও নয়) প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি, লোডশেডিং, সর্বত্র অন্ধকার। ব্যাটারি চালিত মারফি রেডিওতে খবর শুনে জানলুম, দক্ষিণ বঙ্গে নূহের প্লাবন। এত বড়, এত মারাত্মক বিপর্যয় বাংলাদেশে কেউ দেখেনি, ঘটেনি কখনো। অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, পাকিস্তানের শাসককুলের একজনও আসেনি ক্ষয়ক্ষতি দেখতে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ মহা ক্ষিপ্ত। রাজনৈতিক নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান 'ন্যাপ' ভাসানী বিপর্যয়ের কয়েকদিন পরেই পল্টন ময়দানে সভার আয়োজন করেন। ভাষণে বলেন, "ওরা কেউ আসেনি।" না আসায় মওলানা এতটাই ক্ষিপ্ত, ঘোষণা করেন, "আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তান নয়, আজ থেকে পূর্ববাংলা স্বাধীন।"
'ওরা কেউ আসেনি', পাকিস্তান সরকারের 'প্রেস ট্রাস্ট' নিয়ন্ত্রিত দৈনিক 'পাকিস্তানি খবর'-এ শিরোনাম। বাংলাদেশের বহুমান্য কবি শামসুর রহমান ওই বক্তৃতা নিয়ে কবিতা লিখলেন, 'সফেদ পাঞ্জাবি'। 'সফেদ' মানে 'সাদা'। মওলানা সাদা পাঞ্জাবি পরতেন।
সম্প্রতি আমফান যে তাণ্ডব চালিয়েছে বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে (পশ্চিমবঙ্গেই ভয়ঙ্কর), মিডিয়ায় খবর পড়ে, দৃশ্য দেখে ১৯৭০ সালের নভেম্বরের প্রলয়লঙ্কা জাগ্রত হলো স্মৃতিতে। লিখলুম কবিতা। রাজনীতিমাখা কবিতা। প্রতীকে। কবিতার শিরোনাম 'আমফান'।
দুর্গত এলাকা, ধ্বংসস্তূপে মুখগুলি।
কখন কীভাবে শুরু, বাহুল্য এখন
#
ছিলো অশনি সংকেত, ছিলো গগনজুড়ে মত্তগোধূলি
ছিলো নিসর্গবিদ্বেষী রাজনীতিক, সন্ত্রাসী মহাজন
#
যে মানুষ কৃষক-শ্রমিক, সমূলে নিশ্চিহ্ন আজ
দিগন্তবিস্তৃত শ্মশানকবর, শৃগাল-হায়েনা-শকুন উধাও
#
যারা ছিলো রাজাধিরাজ, লাঠিয়াল, বরকন্দাজ,
কোথায় গিয়েছে, কোথায় তথাকথিত দেবতাও?
এই কবিতায় দেশকালের চিত্র, মনে ছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের মহা বিপর্যয় এবং আজকের আমফান। দুইকে মিলিয়ে দেশকাল চিত্র, ভিন্ন কথনে।
কোয়েলি সেন বললেন ফোনে, "এই কবিতার ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ঘটনার দৃশ্যাবলির যোগসূত্র পাঠকের মগজে পরিস্কার হবে না, ব্যাখ্যা করা জরুরি।" বললুম, "পাঠকের দায়িত্ব।" এও বললুম, "পাকিস্তানের সময়ে পাকিস্তানের সরকারের যে উদাসীনতা নভেম্বরের প্রলয়লঙ্কায়, তার সঙ্গে খুব তফাৎ নেই মোদী সরকারের। হেলিকপ্টারে চড়ে দেখলেন, এক হাজার কোটি টাকার দানের কথা ঘোষণা করলেন; ব্যাস, ল্যাটা চুকে গেলো। টাকাই সব নয়। দুর্গতদের পাশে কতটা? রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, 'না বাঁচাবে আমায় যদি, মারবে কেন তবে?'"
কোয়েলি বললেন, "বাঁচব না, মরব। এটাই ভবিতব্য। তবে এখনও কোনো নবজাতকের নাম 'আমফান' শুনি নি। হয়তো শুনব। স্মরণ করিয়ে দেবে মরণ ও জীবনের টানাপোড়েন। ইতিহাস। বাঙালির জীবন মরণবাঁচনে।" বললুম, "করোনা আর আমফান সর্বদাই বাঙালির ঘরে ঘরে নিত্যসঙ্গী।" কোয়েলি সেনের কথা, "বাঙালির ঘরোয়া।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন