সাউথ সেকশনের লোকাল। শিয়ালদার দিকে আসছে। রাত হয়েছে। যাত্রীর সংখ্যা কমই। যাদবপুর থেকে কয়েকজন ছেলে হুড়মুড় করে উঠে পড়ল একটা কামরায়। ট্রেন ছাড়তেই তারা বের করল ছোরা, ক্ষুর। যার কাছে যা আছে ছিনিয়ে নিতে লাগলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মানিব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, রিস্ট ওয়াচ, আংটি, গলার সোনার চেন ইত্যাদি বাগিয়ে ফেললো তারা। ঢাকুরিয়া স্টেশনে ট্রেন যখন স্লো হচ্ছে থামার জন্য, তখনই লাফিয়ে নেমে পড়ার উপক্রম করল ছেলেগুলো। কামরার বাকি পুরুষ মহিলারা যখন ভয়ে গুটিশুটি হয়ে ইষ্টদেবতার নাম জপ করছে, ঠিক তখনই গেটের সামনে বাধা দিয়ে দাঁড়ালেন একজন। খালি হাতেই তীব্র প্রতিবাদ করলেন। তেড়ে গেলেন। নামতে পারলো না ছেলেগুলো। অপ্রত্যাশিত এই প্রতিরোধে খানিকক্ষণের জন্য থতমত খেয়ে গেল তারা।
প্রাথমিক ঝটকা কাটিয়ে দুজন ওই ব্যক্তিকে পিছন থেকে হাত আটকে রাখল। বাকিরা থুতনি চেপে ধরে এলোপাথারি ছোরা, ক্ষুর চালালো গলায়, বুকে, পেটে। বালিগঞ্জ আর পার্কসার্কাস স্টেশনের মাঝে চলন্ত ট্রেন থেকে তারা ছুঁড়ে ফেলে দিল ভয়ানক আহত ওই ব্যক্তিকে। পরের স্টেশনে ছেলেগুলো নেমে গেল। যাত্রীরা সবাই বাকরুদ্ধ। শিয়ালদা আসার পরও কেউ মুখ খুললেন না। কে আর পুলিশের সঙ্গে দেখা করে নিজের ঝামেলা বাড়ায়! কিন্তু সেদিন নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি এক আলুথালু সাধু। নাম প্রভুস্বরূপ দাস। যা দেখেছেন জানিয়ে এলেন ডিউটিতে থাকা রেল পুলিশকে। জানালেন, বনগাঁ বর্ডারের কাছে হরিদাসপুরে এক আশ্রমে থাকেন। কোনও দরকারে তাঁকে যেন ডাকা হয়। সেটা ১৯৭৪ সালের ২আগস্ট। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সেদিন প্রভুস্বরূপকে যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁরা বুঝতে পারেননি কত বড় একটা খবর তিনি দিতে এসেছিলেন এবং পরে কি কি ঘটতে চলেছে।
শুক্রবার শেষবার অফিসে দেখা গিয়েছিল বিজন কুমার বসুকে। শ্যামপুকুর থানা এলাকার বাসিন্দা। এগারো বছর ধরে সিআইটি-র ইঞ্জিনিয়ার তিনি। সোম, মঙ্গলবার অফিসে আসেননি। কেউ কিছু জানেনও না। খোঁজ শুরু হল। জানা গেল, শুক্রবার অফিস ছুটির পর বিজনবাবু বোনের সঙ্গে দেখা করতে সন্তোষপুর যান। সেটা আজকের নাগরিক সন্তোষপুর নয়। তখনও এসব এলাকা গ্রামই বলা চলে। সেখান থেকে ফেরার সময় শিয়ালদাগামী রাতের ট্রেন ধরেন তিনি। সেখানেই...
সিআইটি ইঞ্জিনিয়রা জোর দাবি তুললেন বিজন বসুর খুনের তদন্ত করার জন্য। শিয়ালদা রেলপুলিশের তখন সুপার ছিলেন উমাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্যাপারটা খুন নাকি দুর্ঘটনা সে প্রশ্ন তিনি তুললেন। সবই তদন্ত সাপেক্ষ। এই মৃত্যু তদন্তের দায়িত্ব নিলেন সিআইডি-র প্রধান জেসি তালুকদার। তিনি রাজ্যের মুখ্য সচিবের সঙ্গে দেখা করলেন। নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সরকার। ১০ আগস্ট থেকে তদন্তের দায়িত্ব নিল সিআইডি। রেলপুলিশকেও নিজের মতো করে তদন্ত চালিয়ে রিপোর্ট জমা করতে বলা হল। মনে রাখতে হবে ৮ থেকে ১৭ আগস্ট এই ১০ দিন সে সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রথম পাতায় জায়গা নিয়েছিল বিজন বসু-র মৃত্যু রহস্যের তদন্ত। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল নানা জনকে জেরা, নানা জনের কথার বয়ান রেকর্ডিং ইত্যাদি করেও রহস্যের কিনারা করা গেল না। অনেক খুঁজেও সেদিনের ঘাতকদের কাউকে ধরতে পারা গেল না।
কোথা দিয়ে কেটে গেল বছর চারেক। ততদিনে বালিগঞ্জ-কসবা অনেক ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। লেভেল ক্রসিংয়ের পরিবর্তে একটা নতুন সেতু তৈরি হয়ে গিয়েছে। যেহেতু বালিগঞ্জ বাস ডিপোর গায়েই জাদুসম্রাট পিসি সরকারের বাড়ি, তাই সরকারের তরফে অনেকেই চাইছিলেন তাঁর নামেই সেতুর নামকরণ হোক। কিন্তু সিআইটি-র ইঞ্জিনিয়ারদের দাবিতেই সেতুর নাম রাখা হয় বিজন সেতু। সেতুর দুপাশে ফলকে বাংলা ও ইংরাজিতে সংক্ষেপে লিখেও দেওয়া হয় বিজনবাবুর সম্পর্কে। তাই সেতু দিয়ে উপরে উঠে পড়ার সময় নগরবাসীর মনে রাখা দরকার যে সেতুর ঠিক নিচেই রাতে লোকালের ভিতরে অপরাধীদের বাধা দিতে অসীম সাহসের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এবং খুন হয়েছিলেন একজন। তিনি বিজন বসু।
(গত কয়েক দশকে কলকাতার নানা অপরাধমূলক ঘটনার সময়ে তখনকার সংবাদপত্র ও পত্রিকায় প্রকাশিত খবর এবং ক্রাইম সংক্রান্ত নানা বইয়ে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতেই প্রকাশ করা হচ্ছে এই ফিচার-ধর্মী কলামটি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্য, অপরাধী-আইনজীবী, বাদী-বিবাদী পক্ষ, পুলিশ-গোয়েন্দা, মামলার খুঁটিনাটি ইত্যাদির দায় কোনও অবস্থাতেই এই প্রতিবেদক কিংবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র নয়। শহরে শোরগোল ফেলে দেওয়া ক্রাইমগুলির কয়েকটি এ কলামে গল্পাকারে শোনাতে চাওয়া হয়েছে মাত্র।)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন