ধরুন আপনার প্রিয় কবি ফেসবুকে একটা কবিতা পোস্ট করেছেন। আপনি কবিতাটা পড়লেন, জঘন্য লাগল, এবং সেই খারাপ লাগাটা টাইপ করতে করতে দেখলেন ইতিমধ্যে কুড়িজন লাভ রিয়্যাক্ট করে ফেলেছে। আপনি ভাবলেন তাতে আপনার কিছু আসে যায় না, আপনি আপনার 'অনেস্ট ওপিনিয়ন'-ই দেবেন। টাইপিং চলতে চলতে আরেকটু পরে দেখলেন লাভ রিয়্যাক্ট কুড়ি থেকে বেড়ে দেড়শো। আপনার মনে হল, সবার অ্যাত্ত ভালো লাগছে মানে নিশ্চয়ই কিছু মিস করে গেছেন লেখাটার থেকে! আপনি কবিতাটা আবার পড়লেন এবং দেখলেন, সেটা বাস্তবিকই অখাদ্য। ওদিকে লাভের সংখ্যা পাঁচশো ছুঁই ছুঁই! কিন্তু আপনি আপনার সিদ্ধান্তে অবিচল, ঠিক করলেন একটু বাথরুম থেকে ফিরে এসে প্রাণ খুলে গালি দেবেন।
পনেরো মিনিট পরে কবিতাটা খুলে দেখলেন ওতে দু'হাজার লাভ, সাড়ে চারশো "আহা উহু"। আপনি কনফিউজড হয়ে কবিতাটা আবার পড়লেন। এবার ভালো লাগল, আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু'হাজার এক নম্বর লাভটা দিয়ে কমেন্ট করলেন, "শেয়ার না করে পারলাম না!"
একে বলে 'পিয়ার প্রেশার' বা দলগত চাপ। তবে আজ আমি মানুষ নয়, অন্য এক মজাদার পিয়ার প্রেশারের গল্প বলব আপনাদের। যেটার কথা আপনারা সবাই জানেন, কিন্তু সেভাবে ভাবেননি কোনোদিন!
জীবজগতে বুদ্ধির বিচারে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রাণী হল স্তন্যপায়ী বা 'ম্যামাল'। আর ম্যামালদের মধ্যে অন্যতম বুদ্ধিমান যে মানুষ, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ অদ্ভুতভাবে, পৃথিবীতে মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে কেবল দুটি প্রাণী - মানুষ এবং? নাহ, আমাদের নিকটাত্মীয় শিম্পাঞ্জি নয়, আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড কুকুর বা বিড়াল নয়, বৃহদাকৃতির মস্তিষ্কওয়ালা স্পার্ম হোয়েল (তিমি) বা হাতিও নয়।
ইন ফ্যাক্ট, আমি যাদের কথা বলছি তারা স্তন্যপায়ীই নয়, তারা পাখি! আজ্ঞে হ্যাঁ, মটরদানার সমান ব্রেন নিয়েও 'প্যারট' আর 'সংবার্ড' গোত্রের পাখিরাই হল পৃথিবীর একমাত্র মনুষ্যেতর প্রাণী যারা মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বৈজ্ঞানিকরা বছরের পর বছর মাথার চুল ছেঁড়ার পরে অবশেষে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন। কিন্তু সেটা নিয়ে আলোচনার আগে আসুন ভাষা নিয়ে ভাসাভাসা আড্ডা হোক।
গতকাল রাত্রে এক মজা হল। ডিনার টিনার সেরে আমি আর আমার গিন্নী বসেছি ডকুমেন্টরি ফিল্ম দেখতে, বিষয় - রঙিন পাখিদের জগত। ফিল্ম শুরু, দুজন মিলে হাঁ করে হরেকরকম সব পাখি চিনছি, এমন সময় হল বিপত্তি। আমাদের বেডরুমে রাখা পুষ্যি লাভবার্ড দুজনে কিছুক্ষণ পরপরই দেখি পরিত্রাহি চিৎকার করছে! অথচ ওই সময় অন্যান্যদিন ওরা জড়াজড়ি করে ঘুমোয়। ফিল্ম আরো খানিকটা এগোনোর পরে বুঝতে পারলাম কী ব্যাপার।
আসলে ওরা টিভিতে চলা পাখির আওয়াজ শুনে রেসপন্ড করছে, ফিল্ম আরো খানিকটা এগোনোর পরে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম - ওরা কেবলমাত্র প্যারট গোত্র, মানে নিজেদের বেরাদরের ডাকেই সাড়া দিচ্ছে। স্ক্রীনে যখন কাক, চিল, শকুন, ময়নার ডাকাডাকি, ওরা চুপ। যেই না টিয়া বা কাকাতুয়ার গলা এল, ওমনি "ক্যাঁ ক্যাঁ ক্যাঁ" উফ! আমাদের ডকুমেন্টরি দেখা মাথায় উঠল, ব্যাপারটা প্রথমে বেশ অদ্ভুতুড়ে লাগলেও পরে অনুভব করলাম ওদের অমন বিহেভ করা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কেন? বেশ, আমি একটা লাইন লিখছি, পড়ে দেখুন তো।
"我们的业务是我们的业务, 与您无关" বলুন, এই নিয়ে আপনার কী বক্তব্য। কী বলছেন, আপনি চাইনিজ বর্ণমালা চেনেন না? বেশ, এখানে লেখা আছে, "উমেন দে ইউশি উমেন দে ইউ, ইউ নিন উগুয়ান।" এবারও পারবেন না তো? কারণ আপনি চাইনিজ ভাষা জানেন না, ওতে লেখা আছে, "আওয়ার বিজনেস ইজ আওয়ার বিজনেস, নান অফ ইয়োর বিজনেস।" যাক গে, এবার ধরুন আপনি কর্মসূত্রে চিনে গিয়ে পাঁচ-ছয় বছর থাকলেন। আপনি প্রথমে থাকা-খাওয়ার ঠাঁই খুঁজবেন এবং সেটার বন্দোবস্ত হয়ে গেলেই ওদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করবেন। সব না পারলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দ যেগুলো ছাড়া আপনি কমিউনিকেট করতে পারবেন না। কি, ঠিক তো?
এবার ভাবুন এক পড়ন্ত বিকেলে আপনি একা একা কোনো রেস্তোরাঁয় মনমরা হয়ে বসে অক্টোপাসের মুন্ডু চেবাচ্ছেন। আচমকা কানে গেল, পাশের টেবিলে বসা দুজন বলছে, "বাপ রে বাপ, সারাক্ষণ চিংমিং শুনে শুনে কানের পোকা নড়ে গেল!" আপনি সঙ্গে সঙ্গে সেই টেবিলের দিকে এগিয়ে যাবেন, তারপর বলবেন, "বাঙালি?" বলবেন না, বলুন?
আমাদের লাভবার্ডসও গতকাল তাই করেছে। তারা ক্যাপটিভ ব্রিড, জন্ম থেকে খাঁচার ভেতর অন্য লাভবার্ডস বা বদ্রী বা কাকাতুয়া জাতীয় প্যারটদের সাথে বড় হয়েছে, কোকিলের কুহু তো তাদের কানে চাইনিজ ঠেকবেই! আর সেইসব খিচুড়ি ডাকের মধ্যেই আমাদের টিভিতে চলা ডকুমেন্টারিতে মাঝেমাঝে শোনা যাবে "বাঙালির গলা", যার চক্করে আমার লাভবার্ড দম্পতির সেই কান্নাকাটি।
অর্থাৎ বোঝা গেল, পৃথিবীর সমস্ত গোত্রের পাখিদেরই নিজস্ব ভাষা থাকে, এবং এটা গল্পদাদুর আসরের গাঁজাখুরি নয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সমস্ত পক্ষীশাবকই মোটামুটি হ্যাচিঙ, অর্থাৎ ডিম ফুটে বেরোনোর এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের মায়ের ভাষা নকল করতে শুরু করে। আর গলার আওয়াজ দিয়ে কমিউনিকেট করার স্কিল কতটা উন্নত, সেটা নির্ভর করে সেই পাখিদের ফ্লকিং, বা দল বাঁধার আচরণের উপর। স্বাভাবিক, যেসব পাখি দলবদ্ধ তাদের মধ্যে কথোপকথন চালানোর ঠ্যাকা বেশি।
কিন্তু এ তো গেল নিজেদের মধ্যে কথার আদানপ্রদান, মানুষের গলা নকল করতে যায় কেন এরা? উত্তর সেই 'পিয়ার প্রেশার'। টিয়া বা প্যারট গোত্র বা ময়না, স্টার্লিং, মানে যারা মানুষের গলা নকল করতে ওস্তাদ, তারা প্রত্যেকেই দলে থাকে। মানুষের সান্নিধ্যে আসার পর থেকে এই পাখিরা তাই ভাবতে থাকে এটাও আরেকটা দল। আর স্বাভাবিকভাবেই আমরা যেমন চীনদেশে গিয়ে ওদের ভাষায় কথা বলি, বিদেশ থেকে কেউ যেমন এখানে এলে "হামি ঠুমাকে বালোবাশি" বলতে শেখে, সেই একইভাবে খাঁচার তোতা বলে, "ঠাকুর ভাত দাও", "হরেকেষ্ট" কিমবা "হ্যালো ডার্লিং!" স্রেফ ফ্যামিলিতে জায়গা করে নেওয়ার জন্যে।
পিয়ার প্রেশারের ঠ্যালায় এই যে পাখিদের অনবদ্য সার্ভাইভাল স্ট্র্যাটেজি, মানুষের দলে ফিট ইন করার চেষ্টা, এই নিয়েই বছরের পর বছর গবেষণা চালাচ্ছেন আমেরিকায় ডিউক ইউনিভার্সিটির বাঙালি গবেষক ডাঃ মুক্তা চক্রবর্তী। তাঁর মনেও একই প্রশ্ন যা আমাদের মনে এরপরে আসার কথা - সব পাখি কেন নয়? প্যারট আর সংবার্ডদের মধ্যে এমন কী আছে যে তারা কথা বলতে পারে?
আপনারা কোনোদিন আলিপুর চিড়িয়াখানার ময়নাদের খাঁচাটার সামনে গেছেন? কথার খই ফোটাতে থাকে পাহাড়ি ময়নারা। 'মকিং বার্ড' গোত্রের পাখিরা মানুষ, জীবজন্তু, এমনকি পোকামাকড়ের শব্দও নকল করতে এমন ওস্তাদ, যে তাদের নামই হয়ে গেছে মকিং বার্ড। আবার প্যারটদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাচাল হল বজরিগর, মানে আমাদের বদ্রী পাখি। দলে এরপরেই রয়েছে গ্রে প্যারট, ককাটু, মঙ্ক প্যারাকীট। অথচ ডাকের নাম বকবকম হলেও পায়রা বকবক করে না। প্যারট দলের সদস্য হয়েও লাভবার্ডসের পেটে হাজার বোম মারুন, একটা কথা বলবে না তারা। কেন?
ডাঃ চক্রবর্তীর গবেষণা অনুসারে এর কারণ দুটো - লাভবার্ডরা প্যারট হয়েও মানুষের গলা নকল করে না কারণ তারা প্রকৃতিগত ভাবে দলবদ্ধ নয়, এরা যুগলে মিলে পুঁচকে দলে থাকে। ফলে মানুষের কাছে আসার পরেও তারা পিয়ার প্রেশার ফিল করে না। তারা নিজের পার্টনার নিয়েই মশগুল। দ্বিতীয় কারণ হল মস্তিষ্কের গঠন। গবেষণায় দেখা গেছে, পাখিদের মস্তিষ্কের যেই অংশ বা 'সেল' গলা চেনা বা ভোকাল লার্নিং শেখায়, প্যারট এবং সংবার্ড গোত্রের পাখিদের ক্ষেত্রে সেটা বিশালাকার। শুধু তাই নয়, এদের সেই মস্তিষ্ক প্রকোষ্ঠের ভেতরে নার্ভকোষ বা নিউরনের সংখ্যাও তুলনামূলক ভাবে বেশি। শুধু পাখি নয়, একটা প্রাপ্তবয়স্ক বাঁদরের চেয়েও ঢের ঢে-এ-এ-এ-র বেশি!
পাখির বুলি নিয়ে কম সাহিত্য হয়নি। বাবা লিখেছিলেন কাকেশ্বর কুচকুচের, "সাত দুগুণে চৌদ্দর চার", ছেলে লিখেছিলেন, "ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন, একটু জিরো!" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'তোতাকাহিনী' বা 'ঠাকুমার ঝুলি'-র শুক-সারী, পাখিদের কথা বলা মানুষকে যুগ যুগ ধরে আকর্ষণ করেছে। কিন্তু তবু সমস্ত উত্তর মেলে নি। বৈজ্ঞানিকদের সবেতেই প্রশ্ন বেশি, তাঁরা পাখিদের কথা বলার কারণ খুঁজে পাওয়ার পরে আরেক প্রশ্ন নিয়ে পড়লেন। পাখিরা কি বোঝে তারা কী বলছে?
আমি উপরে যে চাইনিজ বলার উপমা দিয়েছিলাম, সেটা যত কঠিন ভাষাই হোক, শেষপর্যন্ত মানুষের ভাষা। পাখিদের কাছে কাজটা হয় হরবোলার মত। আপনি যখন আপনার পোষা কুকুরকে আদর করতে করতে মুখ দিয়ে "ভৌ ভৌ" আওয়াজ করেন, জানেন তার কী অর্থ? ইউনিভার্সিটি অফ অ্যারিজোনা এবং হাভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রায় তিরিশ বছর ধরে এই রহস্যভেদ করার চেষ্টা করেছিল। গবেষণার কেন্দ্রে ছিল অ্যালেক্স নামের এক টিয়া। গবেষণায় দেখা যায়, বয়স বাড়ার সাথে সাথে অ্যালেক্স শুধু বুলি আউড়ানো নয়, রীতিমত কথোপকথন চালাতে পারত মানুষের সাথে। এমনকি সে নাকি ঘরে একা থাকলে নিজে নিজেই ইংলিশ বলা অভ্যেস করত!
১৯৭৭ থেকে শুরু করে টানা ২০০৭ অবধি আমাদের অবাক করে ইন্টারনেট সেনসেশন অ্যালেক্স মারা যায়। বিজ্ঞান মহলে অনেকের মনেই অ্যালেক্সকে নিয়ে সন্দেহ ছিল, তার কথা বলার ক্ষমতা নাকি অধিকাংশই মিথ্যে। আশা করা যায়, এরও উত্তর মিলবে খুব শিগগিরি। আপাতত সেই বিতর্কিত অতিচালাক অ্যালেক্সের মৃত্যুর আগে আউড়ানো শেষ কথা দিয়ে এই লেখা শেষ করলাম - "ইউ বি গুড। সি ইউ টুমরো। আই লাভ ইউ!"