(বিজেপির ইস্তাহার প্রকাশিত হয়েছে। সে ইস্তাহারে সশক্ত রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই উল্টো একটি বয়ানের কথা উঠে আসছে। যেখানে অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর সরকারই সাধারণ মানুষের উপযোগী বলে দাবি করা হচ্ছে। এ মতামত বলাই বাহুল্য, ব্যক্তিগত)
আগামী নির্বাচনের পর কি শক্তিশালী সরকার চাই? না মিলিজুলি সরকার চাই? এই প্রশ্ন এখন প্রায় সবার মুখে মুখে। একদল বলছে আমাদের দেশে এমন একটা শক্তিশালী সরকার চাই যে সরকার প্রতিবেশী দেশকে একটা মুখের মতো জবাব দিতে পারে। শক্তিশালী অর্থনৈতিক সংস্কার করতে পারে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে ভারত যেন একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে। একমাত্র নরেন্দ্র মোদীই এই স্থায়ী এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র আমাদের দিতে পারে। সুতরাং মোদী ছাড়া কে ? অনেক মিডিয়াও প্রশ্ন করছে মোদী না হলে কে? অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দুবার ভাবছেন। সত্যিই তো এই প্রশ্নের উত্তর কী হবে ? কেউই কিন্তু জোরের সঙ্গে বলতে পারছেন না মোদী ছাড়া যে কেউ। এই ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছে যে আরএসএস , বিজেপি ছাড়া যে কেউ। আসলে তাঁদেরও এই বিষয়টা নিয়ে দ্বিধা আছে, এত জোরের সঙ্গে কি একথা বলা যায়? আসলে তাঁরা যদি নিশ্চিত ভাবে এটা বলতে পারতেন যে “অনিশ্চিত” সরকার হলে কি সুবিধা তাহলে মানুষও এটা বিশ্বাস করত। কারণ শেষ বিচারে নির্বাচন হচ্ছে মানুষের ধারণাকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া কিছু নয়।
তথাকথিত“অনিশ্চিত” সরকার হলে মানুষের কিছু সুবিধা হবে, এমন একটা প্রতিপাদ্য থেকে বিষয়টিকে দেখা যাক। এই যে রামধনু টাইপের মিলিজুলি সরকার বা বিজেপির ভাষায় “মহামিলাবটি” সরকার হলে, যা ১৯৯০ এর শেষ দিকটায় হয়েছিল, তেমনটা হলে কী সুবিধা হবে?
আরও পড়ুন, গরু, উকুন ও মানুষ: সময় কাটানোর রাজনীতি
প্রথমত এই সরকার যদি অকংগ্রেসি অবিজেপির সরকার হয় তাহলে সে সরকারকে হতেই হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ঘরানার। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব ধরনের আঞ্চলিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে সেখানে, তা সে উত্তর পূর্বাঞ্চল হোক বা কাশ্মীর।
দ্বিতীয়ত নাগরিক আন্দোলন বা সিভিল সোসাইটিরও এই ধরনের সরকারের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। তারা সরকারের বাইরে থাকলেও সরকারকে চিন্তা ভাবনার খোরাক দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু একটা ৩০০ সাংসদের সংখ্যাগুরু সরকারের কোনও দায়িত্ব থাকে না বা তাঁরা বাধ্য থাকেন না এই নাগরিক আন্দোলনের মুখেদের কথা শুনতে।
নারেগা বা আরটিআই, খাদ্যের সুরক্ষা সহ শিক্ষার অধিকার এই সমস্ত আইন কিন্তু প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে পাশ হয়েছে যা কিন্তু সেই অর্থে “শক্তিশালী” সরকার ছিল না।
অনেকে বলে থাকেন এই ধরনের মিলিজুলি সরকারে যেহেতু বিরোধী পক্ষও যথেষ্ট শক্তিশালী থাকে সুতরাং সেই সরকার কখনও নোটবন্দি বা সার্জিকাল স্ট্রাইক করতে পারবে না আর। নোটবন্দির মত বড়সড় পদক্ষেপ নিতে সক্ষম শক্তিশালী সরকারের আমলেই জিএসটি-র মত এত বড় একটা কর কাঠামো চালু হয়ে যাবে যাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটাই ধ্বংস হয়ে যায়।
সংখ্যাগুরু সরকারের আরেকটা বড় সমস্যা হল, সমাজের সংখ্যাগুরু থেকে তারা নিজেদের আলাদা করতে পারে না। সংখ্যাগুরুর আকাঙ্ক্ষাকের উপর নির্ভর করতে তাদের ইস্তাহারে রাখতে হয় রাম মন্দির, শবরীমালার মত ইস্যুকে। অন্যদিকে সংখ্য়ালঘু মানুষের, আদিবাসী, দলিত মানুষেরও যে তারাই প্রতিনিধি, সে কথা বিস্মৃত হয় তারা।
সব শেষে আসা যাক সেই অমোঘ প্রশ্নে অর্থনীতির কী হবে, চাকরি বাকরির কী হবে? একটা রামধনু সরকার কি এই প্রশ্নে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে? তাঁদের জন্য পাল্টা যুক্তি এই ২০১৪ থেকে ১৯ পর্যন্ত যে সরকার চলছে সেই সরকারের আমলে গত ৪৫ বছরে বেকারত্বের হাল সবচেয়ে বেশি। এই সরকার তো শক্তিশালী এবং স্থায়ীই ছিল তাহলে কেন তাঁদের আমলেই এত বেশি কাজ হারানোর হাহাকার? কেন এত মানুষ বলছেন আমরা চাকরি চাই? আসলে এইটা নির্ভর করে যে কোনও সরকারের সদিচ্ছার ওপর। এর সঙ্গে সরকার স্থায়ী বা অস্থায়ী তাঁর ওপর নির্ভর করে না। সুতরাং কেউ যদি এই কথাটা বলেন যে একটি দল যদি ২৭২ এর ম্যাজিক ফিগার পেরিয়ে যায় একা তাঁর পক্ষেই একমাত্র সম্ভব অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা , সেই দলই পারে জিডিপি কে বাড়াতে- সে ক্ষেত্রে তাকে ছেঁদো যুক্তি হিসেবে বাতিল করা যায়। এ প্রসঙ্গে পুরোটাই নির্ভর করে যে কোনও সরকারের সদিচ্ছার ওপর।
সুতরাং “কোয়ালিশন” বা মিলিজুলি সরকার হলেই যে সেই সরকার মানুষের হয়ে কাজ করতে পারবে না এটা মেনে নেওয়া আসলে আরও একটা সংখ্যাগুরুবাদের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুই নয়। যা মানুষকে ভাবতে শেখায় যে আমরাই সব আমরা যা বলবো সেটাই একমাত্র ঠিক আর বাকিদের ধারণাগুলো ফেলনা।“কোয়ালিশন” শব্দের ল্যাটিন অর্থ সহকারিতা অর্থাৎ একসঙ্গে বড় হওয়া যা ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রের এখন কেন বহুদিন থেকে প্রয়োজনীয়। বিজেপির একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সুব্রহ্মণিয়ম স্বামী বেশ কিছু দিন আগে বলেছিলেন যে নির্বাচন কোনোদিন অর্থনীতি দিয়ে জেতা যায় না, নির্বাচন জিততে হয় আবেগ দিয়ে।নরেন্দ্র মোদী এখন সেই আবেগ সৃষ্টি করতে চাইছেন তাই আকাশে “শক্তিশেল” বা প্রতিবেশী দেশকে “শক্তিশালী” জবাব দিয়ে শক্তিশালী সরকার আবার গড়তে চাইছেন কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ কি তাই চাইছেন? আগামী দিনে হয়তো এর উত্তর পাওয়া যাবে।
(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার)