ক্ষমতার দিনগুলোতে পশ্চিমবঙ্গে যেমন জানা ছিল বামফ্রন্ট মানে আদতে সিপিএম, কেন্দ্রে তেমনই আজকের দিনে এনডিএ বলতে বিজেপি। তার ওপরে ঠিক যে পরিমাণ আসন বিজেপির ঝুলিতে গেল, তাতে নিশ্চিত যে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ প্রবল বিক্রমে আরও পাঁচ বছর রাজত্ব চালাবেন। তবে বিজেপি জিতলেও যে প্রশ্ন এবারের নির্বাচনে উঠে গেল, তা হচ্ছে নির্বাচন পদ্ধতির স্বচ্ছতা। আমাদের নির্বাচনকে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের সীলমোহর লাগিয়ে যতই বিক্রি করা হোক না কেন, বিষয়টায় পরাজিতদের সন্দেহ কিছুতেই কমছে না। ফলে নির্বাচনের পবিত্রতা সম্পর্কে তাত্ত্বিক কথা না বাড়িয়ে ফলিত ক্ষেত্রে বিচার করাই ভালো।
আর সেই জায়গাতে অবশ্যই সবথেকে আলোচিত বিষয় ভোটযন্ত্র। সবসময়েই যারা হেরে যায় তাদের নৃত্যের তালে বিঘ্ন ঘটায় ভোটযন্ত্রের বাঁকা নকশা। ২০০৯ নির্বাচনে বুথফেরত সমীক্ষায় জয় সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত বিজেপি যখন হেরেছিল, তার অব্যবহিত পরেই একটি বই প্রকাশ করেছিলেন লাল কিষেনচাঁদ আদবানি (যিনি এল কে আদবানি নামে সমধিক পরিচিত) এবং জি ভি এল নরসীমা রাও। বইটির নাম “ডেমোক্রাসি অ্যাট রিস্ক! ক্যান উই ট্রাস্ট আওয়ার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনস?” মানে সবাই বুঝছেন, কিন্তু এতো সুন্দর ইংরিজির বাংলা করার লোভ সামলানো শক্ত, যা কিনা, “গণতন্ত্র বিপন্ন! আমরা কি আমাদের ভোটযন্ত্রগুলোকে বিশ্বাস করতে পারি?” তবে এই ভোটযন্ত্রগুলো আমাদের নয়, নির্বাচন আয়োগের। আর বিশ্বাস করার একটা মূল উপায় এই যন্ত্রের নকশা দেশের বিভিন্ন বৈদ্যুতিন প্রযুক্তিবিদ্যার পাঠ্যসূচিতে ঢুকিয়ে দেওয়া। যে বিষয়টি সকলের চোখের সামনে খুব সহজে প্রকাশ করা যায়, তাকে গোপন রাখার মধ্যেই যত গণ্ডগোল। আশা করতে ক্ষতি কি ক্ষমতায় আসার একশো দিনের মধ্যে এই নিয়ে ভাববে বিজেপি সরকার।
আরও পড়ুন, সাড়ে তিন ডজন আসনের গপ্পো
এবারের গণনা প্রক্রিয়ায় যে ভিভিপ্যাট নিয়ে এতো আলোচনা, মনে রাখতে হবে তার পেছনেও আছেন এক বিজেপি নেতা সুব্রমনিয়ান স্বামী। তিনি ভোটযন্ত্রের স্বচ্ছতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়ে, যার অনুসিদ্ধান্তেই আসে ভিভিপ্যাটের চিরকুট। তবে তার সঙ্গে এ কথাও বলতে হবে যে যতই বিষয়টি পরিষ্কার হোক না কেন, তার মধ্যে কিছু গোলমাল থাকবেই। আসলে আইনস্টাইন সাহেব আপেক্ষিকতাবাদ সম্পর্কে যে সম্যক ধারণা তৈরি করে দিয়ে গেছেন, তারপর আর চরম সত্যকে খুঁজতে না যাওয়াই ভালো।
বিজেপি জিতে যাওয়ার পর বিরোধীদের আর একটা বড় প্রশ্ন দেশে আর নির্বাচন হবে কিনা। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ভোটযন্ত্র নিয়ে আর কোন দুশ্চিন্তাই থাকবে না। এর উৎস অত্যুৎসাহী কিছু বিজেপি নেতা, যারা বলেছেন এবারের নির্বাচনে জিতলে বিজেপি সরকার আগামী পঞ্চাশ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। তবে এতোটা আপাতত না ভাবলেও চলে। দেশের গণতন্ত্র সম্ভবত এখনও ততটা বিপর্যস্ত হয় নি। তবে ডানপন্থী দল হিসেবে পরপর দুবার ক্ষমতায় আসা বিজেপি এবার অবশ্যই কিছু কড়া পদক্ষেপ নেবে, যা বেশ বিপদে ফেলতে পারে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীদের। মোটের ওপর একথা তো সত্যি যে কংগ্রেস রাজত্বের যে গাদা গাদা দুর্নীতির গল্প, তার তুলনায় বিজেপি সরকারের স্বচ্ছতা কিছুটা বেশি মনে করেছেন সাধারণ মানুষ। নোটবাতিল কিংবা জিএসটি লাগু করার সিদ্ধান্তে যথেষ্ট অপরিপক্বতা আছে। তার জন্যে খুব ঝামেলায় পড়েছেন সাধারণ মানুষ। কালো টাকা মোটেও উদ্ধার হয় নি। কিন্তু এই দুই বিষয়ের মধ্যে দিয়ে বিজেপির নেতারা বিপুল দুর্নীতি করেছেন একথা প্রমাণ করা শক্ত।
আরও পড়ুন, বিরোধী পক্ষের ভুলের কারণেই মোদী অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেছেন
রাজত্বের শেষের দিকে উঠেছে রাফাল বিমান কেনা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন। তার মাধ্যমে দেশের এক বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীকে সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার কথা উঠলেও, সরাসরি বিজেপি সেখানে কোন বেআইনি কাজ করেছে সেটা এখনও প্রমাণ হয় নি। বোফর্সের মতই এর সঠিক উত্তর হয়ত কোনদিনই পাওয়া যাবে না। আর দেশের নিম্নবিত্ত মানুষের জন্যে বিজেপির মত একটি ডানপন্থী দল যে খুব বেশি কাজ করবে না সেকথা বুঝতে কষ্ট হয় না। সেই হিসেবেই বামপন্থীদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল তীব্র কৃষক আন্দোলন। কংগ্রেস তার থেকে লাভ করেছিল হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে। কিন্তু এর মধ্যেই কৃষক শ্রমিকদের জন্যে বাজেটে প্রচুর গল্প শুনিয়েছে বিজেপি। ঠিক সেরকমই তিন রাজ্যে গল্প শুনিয়েছিল কংগ্রেস। আদতে কী হবে তা জানা নেই। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে দেশের এক অংশের সাধারণ মানুষ এখনও বিজেপি সরকারের দিক থেকে মুখ ফেরায় নি। হিন্দি বলয়ে কংগ্রেসের দুর্বল প্রচারও তার এক বড় কারণ। এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে উত্তর দিতে পারে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। মধ্যপ্রদেশে কমলনাথের দলবলের ওপর আয়কর দপ্তরের হানাও হয়ত প্রভাব ফেলেছে কিছুটা। উত্তরপ্রদেশের ফলাফলও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
বিজেপি জিতলেও সমীক্ষাগুলোকে খুব বেশি নম্বর দেওয়া যাচ্ছে না। তার কারণ বিজেপি যে জিতবে সেই ধরনের একটা হাওয়া তৈরি করেছিল সংবাদমাধ্যম। পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হানা এবং তারপর বালাকোটে ভারতের প্রত্যাঘাত যে ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলেছে তা তো দেখাই যাচ্ছে। সে কথা প্রচার করায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম। সমীক্ষাগুলোও করেছে তারাই। আর তাদের অনুপ্রেরণায় দেশপ্রেম ভালোভাবেই খেয়েছে দেশের জনগণ। জাতীয়তাবাদের হাওয়ায় তাই পালতোলা নৌকায় চড়ে বিজেপি দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করতে চলেছে। এই হাওয়ার কথা মনে রেখে বিজেপি যদি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণের পথে একটু ঢিমেতালে হাঁটে তাহলে দেশবাসীর মঙ্গল।
আরও পড়ুন, রাজ্যে বিজেপির দারুণ ফল, পশ্চিমবঙ্গে কি শেষ কংগ্রেস-বাম?
দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ এই সমস্ত শব্দের সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলো কাটে ভাল। সেখানে রাফাল চুক্তিতে বেসরকারি মালিকানার ভাগ কমিয়ে সরকারি সংস্থাকে কিছুটা চাঙ্গা করার কথা ভাবতে পারে জনগণতান্ত্রিক মোদী সরকার। সহজ হিসেবে দেশের তিন নামকরা বামপন্থী রাজ্য ত্রিপুরা (গত বিধানসভা ভোটে জিতেছে বিজেপি), পশ্চিমবঙ্গ (বামভোট হয় সোজাসুজি নয়তো বা তৃণমূলের পথ ধরে পৌঁছচ্ছে বিজেপিতে) আর কেরালা (বামভোট বিজেপিতে যাওয়া শুরু হল) থেকে এখনও ভোট ঘুরছে বিজেপির দিকে। এই সমস্ত বাম ভোটারদের খুশি রাখতে গেলে তীব্র বেসরকারিকরণের পথে না হাঁটাই ভালো। কারণ আশা করা যায় এর পরেও ভারতবর্ষে নির্বাচন হবে এবং আরও বেশ কয়েকবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে এ দেশের জনগণ। ভোট শতাংশের বিচারে বিজেপি কতটা ভালো করেছে তা এখনও পরিষ্কার না হলেও, সেখানে যে তাদের বিপুল উন্নতি হয় নি একথা পরিষ্কার। তবে বিরোধী অনৈক্য এবং সে সমস্ত দলের নেতানেত্রীদের আচরণ সম্ভবত ভালো ঠেকে নি দেশের মতদাতাদের।
তবে এই নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে শিক্ষিত সমাজের একাংশে যে শঙ্কার মেঘ তা কাটাতে হবে দুপক্ষকেই। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে ব্যাপক দমননীতি চালাবে বিজেপি, তাহলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে বিদ্বদজনদের — বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রকে রক্ষা করার স্বার্থে। আবার অন্যদিকে বিজেপিকেও মনে রাখতে হবে যে তীব্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী অ্যাজেন্ডা নিয়ে এগোলে লাভের থেকে ক্ষতি হতে পারে বেশি। আর বিজেপি তো এই দেশেরই একটা দল। দেশের বিভিন্ন অংশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রচুর নেতা ডিগবাজি খেয়ে পৌঁছেছেন তাদের আঙিনায়। যেন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অনেক বড় নেতাই তৃণমূল থেকে আগত। আবার এই রাজ্যেই প্রচুর বামপন্থী সমর্থক তৃণমূলের বিরোধিতা করার স্বার্থে সমর্থন করেছেন বিজেপিকে। অদ্ভুত দুই বৈপরীত্য কাজ করেছে বিজেপির পক্ষে। রাজনীতি সত্যি তাই সম্ভাবনার বিজ্ঞান আর সেই কারণেই সেখানে ছোঁয়া যায় আপাত অসম্ভবকে। সে অঙ্কেই বিজেপি এগোতে চাইবে এ রাজ্যে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে, আর রাহুল গান্ধী আড়ামোড়া ভেঙে প্রস্তুতি নিতে পারেন ২০২৪-এর। আশা রাখি এই দুটো নির্বাচন অন্তত সুসম্পন্ন হবে, দেশের সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)