১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পরদিন অর্থাৎ ১৬ অগস্ট লালকেল্লায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেন। তবে থেকে আজ অবধি দেশের প্রতিটি কোণে গর্বের সঙ্গে উঠে চলেছে এই পতাকা। কিন্তু জানেন কি, এই ধারায় একটা ব্যতিক্রমও ছিল। আর তা ছিল আমাদের এই শহরেই, খাস কলকাতায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই কলকাতাতে উড়ত ব্রিটিশদের 'ইউনিয়ন জ্যাক' পতাকা। ঠিক কোথায় এমনটা হয়েছিল? কেনই বা এমন ঘটনার সাক্ষী আমাদের শহর? স্বাধীনতার এই ৭৫ বছর উদযাপনের উপলক্ষে একটু খুঁজে দেখা যাক এই অদ্ভুত ইতিহাসকেও।
কলকাতার মেটিয়াবুরুজে সিব্তৈনাবাদ ইমামবাড়া বা মেটিয়াবুরুজ ইমামবাড়ায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও প্রায় সাতাশ বছর ভারতের তিরঙ্গা পতাকা উত্তোলিত হয়নি। সেখানে উড়ত 'ইউনিয়ন জ্যাক'। আওয়াধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্ (১৮২২-১৮৮৭ খ্রিঃ) এই ইমামবাড়াটা তৈরি করা শুরু করেন ১৮৬০ সালের শুরুর দিকে এবং এর নির্মাণকার্য শেষ হয় ১৮৬৪ সালে। এখানেই ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও উড়ত ব্রিটিশদের 'ইউনিয়ন জ্যাক'।
এই ইমামবাড়ার মধ্যে আছে নবাবের কবর, নবাবের ব্যবহৃত নানা দ্রব্যসামগ্রী, বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদান এবং সে সঙ্গে বিভিন্ন ফলক। এই ফলকগুলোতে নবাব, তাঁর পরিবার, নবাবের বংশপরিচয় ও ইমামবাড়ার ইতিহাস সহ নানা তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। এগুলোর মধ্যে এমনই একটা ফলকে লিপিবদ্ধ আছে 'ইউনিয়ন জ্যাক' সংক্রান্ত এই অদ্ভুত ইতিহাস। সেই ফলকটির ছবি তলায় দেওয়া হল-
এই ফলকে যা লেখা আছে তার অনুলিখন করলে দাঁড়ায়- "NATIONAL FLAG (Replacing the British flag, Union Jack) was unfurled on this monument 27 years after independence on 26 January 1975 by Mr. S.M.Abdullah, Chairman, Garden Reach Municipality, Organized by prince Nayyer Quder, The newly appointed first Nationalist Trustee of king of OUDH's Trust, Amidst great opposition by the removed Trustees and kin, The British-Loyalist Harem Descendants of Wajid Ali Shah." এর বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি আওয়াধের রাজার ট্রাস্টের নবনিযুক্ত প্রথম দেশীয় ট্রাস্টি শাহজাদা নায়ার কাদের ওই স্থানে (মেটিয়াবুরুজ ইমামবাড়ায়) একটা পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেদিন সেই অনুষ্ঠানে তৎকালীন গার্ডেনরিচ পৌরসভার চেয়ারম্যান শ্রী এস. এম. আবদুল্লার হাতে ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা নামিয়ে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। যদিও নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের ব্রিটিশ-অনুগত হারেম বংশধররা এই কাজের ঘোর বিরোধী ছিল।
এই ফলকের ব্যাপারে বিখ্যাত ভেক্সিলোলজিস্ট শ্রী শেখর চক্রবর্তীর মন্তব্য, "এই ফলকটি সিব্তৈনাবাদ ইমামবাড়া বা মেটিয়াবুরুজ ইমামবাড়ার মুখ্যদ্বারের কাছেই একটা দেওয়ালে আছে, যেখানে ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ এর এই পতাকা উত্তোলনের ঘটনাটার উল্লেখ আছে। কিন্তু বর্তমানে এই ফলকটার খুবই দৈন্যদশা। আমি দেখেছি এর চারপাশে এমনভাবেই সাদা রঙ করা হয়েছে যে এটা ভালোভাবে পড়া খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে।"
আরও পড়ুন নকশাকথা: বহুবার পাল্টায় নকশা, জাতীয় পতাকার বিবর্তনের ইতিহাস অবাক করার মতো
তবে তিনি এই পতাকা উত্তোলন ঘটনাটার কারণ হিসাবে কোনো যুক্তি বা ঘটনার ইতিহাস বলতে পারেননি। কেন ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও এতদিন মেটিয়াবুরুজ ইমামবাড়ায় ব্রিটিশ পতাকা উড়েছিল আর কেনই বা সাতাশ বছর পরে সেখানে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন হলো, তার যুক্তিযুক্ত কারণ আজও অধরা।
তবে হ্যাঁ, এর থেকে একটা জিনিস খুবই স্পষ্ট। এখনও সময় আছে। এই ফলকটাকে কালের গর্ভে তলিয়ে যেতে না দিয়ে যদি এর ঠিকঠাক সংরক্ষণ করা হয় তাহলে হয়তো এই অধরা ইতিহাসকে খুঁজে পাওয়া যাবে। অবশ্যই সবশেষের সাদা রঙের প্রলেপের পর ভবিষ্যতের আরও কোনও প্রলেপ পড়ে গিয়ে ফলকটা আরও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠার আগে এর প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। যদিও একথাও ঠিক, শুধু এই ফলকে কাজ হবে না, এই অদ্ভুত ইতিহাসকে আরও বিস্তারে ও সঠিকভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে আনতে আরও অন্যান্য তথ্য ও গভীর গবেষণার দরকার।
আরও পড়ুন ঐতিহ্যের নদিয়া: যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে বাঙালির অভিজাত ইতিহাস
সবশেষে, এই ফলক এবং বিভিন্ন প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে একথা হলফ করে বলাই যায় যে, ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ এর আগে পর্যন্ত খাস কলকাতার বুকে এই 'মেটিয়াবুরুজ ইমামবাড়া'তে ব্রিটিশ পতাকা 'ইউনিয়ন জ্যাক' উড়ত। দেশের স্বাধীনতার পরেও।
সুত্র:
Jones, Llewellyn Rosie, 'The Last King in India: Wajid ‘Ali Shah'
শ্রীপান্থ, ‘গনেশ পাইন চিত্রিত মেটিয়াবুরুজের নবাব’