Advertisment

টেরিটি বাজার: কলকাতার প্রথম চিনে পাড়া কেমন আছে?

দীর্ঘদিন ধরেই টেরিটি বাজার শহরের একমাত্র চায়নাটাউন ছিল। কিন্তু ১৯৫০-এ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
China town, Tiretta Bazar

রবিবার টেরিটিবাজারে ব্রেকফাস্টের আসর বসে (ছবি- শশী ঘোষ)

টেরিটিবাজার হল কলকাতার সর্বপ্রথম চিনেপাড়া। ১৮ শতকের শেষ দিকে এখানেই চিনের মানুষ প্রথম বসবাস করতে শুরু করেন।

Advertisment

স্থানীয় বাসিন্দারা এ জায়গাকে চিনেপাড়া বলে ডাকেন। নিজস্ব স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে এ এলাকার একটি পরিচয় রয়েছে, রয়েছে ইতিহাসও। এলাকায় অনেক আধুনিক ধাঁচা গড়ে উঠেছে, এ কথাও সত্যি। মধ্য কলকাতার টেরিটিবাজারের রাস্তায় এখন প্রতিদিনই অন্য জায়গার মতই টাটকা শাকসব্জি ও ফল বিক্রি হয়।

কিন্তু এখানকার ব্রেকফাস্ট আলাদারকম। স্টিমড বান, গরম ডাম্পলিং, ওয়ানটন ও মোমো বিক্রি হয় মাত্র ৫০ টাকায়। ব্রেকফাস্ট যাঁরা বিক্রি করেন, তাঁরা নিজেদের আস্তিনের সেরা তাসটা রেখে দেন রবিবারের জন্য। রবিবারের বিশেষ প্রাতরাশের ঐতিহ্য চলছে কয়েক দশক ধরে। সপ্তাহের এ দিনটাতে খাবারের রকমফের যেমন বেশি, তেমন ভিড়ও বেশি।

China town, Tiretta Bazar ছবি- শশী ঘোষ

১৭৯০ সালে কলকাতার মানচিত্রে প্রথম টেরিটিবাজারের নাম দেখা যায়। অন্য নানা নথি থেকে জানা যায় এ জায়গার নাম হয়েছিল কলকাতাবাসী এক ইতালিয়- এডওয়ার্ড টেরিটির নামে। এ বাজার সহ কলকাতার বেশ কিছু জায়গা ছিল তাঁর সম্পত্তি। ক্যাথলিন ব্লেচিনদেন নামের এক ব্রিটিশের লেখা ১৯০৫ সালে প্রথম প্রকাশিত পুস্তক ‘Calcutta: Past and Present’-এ এডওয়ার্ড টেরিটির সম্পর্কে যা জানা যায় তা হল, তিনি ছিলেন এক ভাল পরিবারের সদস্য, যিনি রাজনৈতিক কারণে নিজের দেশ থেকে এখানে পালিয়ে আসেন এবং স্থপতি হিসেবে দীর্ঘদিন সরকারি পদে ছিলেন।

টেরিটি জমির মালিক যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন লটারি ব্যবসায়ী। টেরিটির ব্যক্তিগত সম্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পত্তি না হওয়া সত্ত্বেও বাজারের নাম তাঁর নামে রাখার ঘটনা নিয়ম বহির্ভূতই বলা চলে। ১৭৯০ সালের মানচিত্রে এ বাজারকে অন্তর্ভুক্ত করা থেকেই বোঝা যায় এ বাজার কত বড় ছিল এবং তার প্রভাব কত বেশি ছিল।

টেরিটি কলকাতায় অনেক সম্পত্তি অর্জন করলেও তাঁর জীবন সুখের ছিল না। ১৭৯৬ সালে তিনি অষ্টাদশ বর্ষীয়া স্ত্রীকে হারান। নিজের তৈরি করা সমাধিক্ষেত্রেই তাঁকে সমাধিস্থ করেন চেরিটি। এখন যেখানে সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান তার কোণাকুনি উল্টোদিকেই ছিল এই কবরখানা। এর পর টেরিটির কী হয়, তা অজ্ঞাত।

শহরের নথি থেকে দেখা যাচ্ছে ১৭৯১ সালে টেরিটি বাজারের মালিকানা তিনি হস্তান্তরিত করে দেন চার্লস ওয়েস্টনের কাছে। ওয়েস্ট বাজারের উল্টোদিকেই একটি বাড়িতে থাকতেন। ওয়েস্টন বাজার থেকে সংগৃহীত অর্থ নিজের জন্য ব্যয় করলেও বাজারের চরিত্র বদলের চেষ্টা করেননি।

১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে টেরিটি বাজার মূলত চিনেদের জায়গা হয়ে উঠতে শুরু করে। এ সময়ে নদীপথে চিনের বাণিজ্যসফরে বেরিয়ে কলকাতায় থাকতে শুরু করেন। ১৮৫৮ সালের ক্যালকাটা রিভিউতে টেরিটি বাজারকে আফিং ও জুয়ার আড্ডা বলে বর্ণনা করা হয় এবং চিনা অভিবাসীদের শান্তিপ্রিয় ও সামান্য লাভের প্রত্যাশী বলে বর্ণনা করা হয়।

১৮০০-র মাঝামাঝি নাগাদ ক্যান্টনিজ ও হাক্কা অভিবাসীদের মধ্যে বিয়ের প্রচলন শুরু হয়। বিয়ে শুরু হয় চিনেদের সঙ্গে ভারতীয় ও ইউরেশিয়ানদেরও। ক্যালকাটা রিভিউয়ের বর্ণনা অনুযায়ী টেরিটি বাজার হয়ে ওঠে আফিং ব্যবসায়ী, জুতো বিক্রেতা, ছুতোর, আলমারি নির্মাতা, ইত্যাদিদের বাসস্থান।

জয়তী ভট্টাচার্য ও কুনুর কৃপালনি তাঁদের এক গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন কলকাতায় চিনাদের অভিবাসন বাড়তে থাকে ৩ ও ৪-এর দশক জুড়ে। ঐতিহাসিক নথি থেকে দেখা যাচ্ছে চিনের আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ ও জাপানের সঙ্গে চিনের যুদ্ধের ফলে ১৯২৭-১৯৪৯ সময়কালে বহু চিনা দেশ ছেড়েছেন।

চিনের গৃহযুদ্ধ (১৯২৭-১৯৪৯) এবং দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধ (১৯৩৭-১৯৪৫) সে দেশে খাদ্যের অপ্রতুলতা, নিরাপত্তাহীনতা, অস্থির পরিবেশ এবং কর্মহীনতা সৃষ্টি করেছিল। দেশে ছেড়ে চিনারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় যেতে শুরু করেন, কেউ কেউ আরও দক্ষিণ পশ্চিমে, ভারতের উদ্দেশে পাড়ি দেন।

দীর্ঘদিন ধরেই টেরিটি বাজার শহরের একমাত্র চায়নাটাউন ছিল। কিন্তু ১৯৫০-এ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। জয়তী ভট্টাচার্য ও কুনুর কৃপালনির মতে ১৯৬২ সালের চিন ভারত যুদ্ধ টেরিটি বাজারে চিনাদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এ অঞ্চলের বাসিন্দা ক্যান্টনিজরা মূলত ছুতোরের কাজ করতেন কলকাতা বন্দর ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায়। এই যুদ্ধের জেরে তাঁদের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েন এবং এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। কেউ কেউ ফিরে যেতে বাধ্য হন চিনেও।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অনেকে শহরের বাইরে ট্যাংরায় চলে গিয়ে চামড়ার কারখানা ও রেস্তোরাঁ খোলেন। তখন এ জায়গা ছিল মূলত জলাজমি, উন্নয়ন এসে পৌঁছয়নি সেখানে। তবে ৭ ও ৮-এর দশকে ট্যাংরার চিনেদের ভাগ্য খোলে, টেরিটি বাজারের বাসিন্দাদের থেকে অনেকটাই উন্নতি করেন তাঁরা।

এখন টেরিটি বাজারের সে উজ্জ্বল চিনে দিন আর নেই। তবে সকলে এখনও ছেড়ে যাননি। এলাকার তস্যগলিতে এখনও দেখা যায় ইতিউতি চিনে রেস্তোরাঁ। রবিবারের সকালে এখনও বিক্রি হয় চাইনিজ ব্রেকফাস্ট, তবে আগের তুলনায় তার পরিমাণ অনেক কম। সান ইয়াৎ সেন স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় খাঁটি ক্যান্টনিজ বা চিনা খাবারে চেয়ে ইন্দো-চাইনিজ খাবার বেশি মেলে। কয়েকটা চিনা গির্জা ও দোকানে একনও সস ও রান্নার উপকরণ বিক্রি হয়। শহরের আদি চায়নাটাউনের অবশিষ্টটুকু ওখানেই লেগে থাকে।

Advertisment