বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পরই তাঁর পূর্বসূরীদের মতন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী নিয়মের পথে বিশ্ববিদ্যালয়কে চালানো, এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখা, দখলমুক্ত করা এলাকাকে, প্রভৃতি কাজ শুরু করে দিয়েছেন, কিন্তু এই গতি কতদিন থাকবে, এমনটাই প্রশ্ন এলাকার মানুষজনের। ঘরপোড়া গরু আর সিঁদুরে মেঘের বৃত্তান্ত আর কী।
অতীতে বহু উপাচার্য এমন পদক্ষেপ নিলেও কোনটাই স্থায়ী হয় নি, বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বেনিয়ম, দুর্নীতি, বিক্ষোভে, অসন্তোষে বিব্রত হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় সরকারও। ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্বভারতী অধিগ্রহন করার পর থেকেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের কাছের মানুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন, এবং হওয়ার পর প্রত্যেকেই কম বেশী উপলব্ধি করেছেন, যে খুব শিগগিরই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে তাঁরা দায়িত্বমুক্ত হতে পারলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।
উপাচার্যদের ঘিরে এক স্তাবক বলয় গড়ে ওঠে, যার সদস্যরা শুধুমাত্র নিজেদের পেশাগত এবং আর্থিক লাভের লক্ষ্যে উপাচার্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার করান। যার জেরে অপ্রয়োজনীয় ভাবে অবৈধ নিয়োগ থেকে শুরু করে নানা বেনিয়ম শুরু হয়।এবারও সেই বলয় কবে গড়ে ওঠে, তা দেখার অপেক্ষায় সকলে।
১৯৫১ সালের ১৪ মে বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নিশ্চয়ই ভাবতে পারেন নি, সময়ের সাথে বিশ্বভারতী এতটাই বদলে যাবে। তার পরে ক্ষিতিমোহন সেন, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতন ব্যক্তিত্বরা উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। আবার নিমাইসাধন বসু, অম্লান দত্ত, সব্যসাচী ভট্টাচার্য, অসীন দাসগুপ্তরাও কেউ পুরো মেয়াদ, কেউ ভারপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নের চেষ্টার কসুর করেন নি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের মতন গুণীজনদের প্রয়াসও সুবিধেবাদীদের চক্রের কাছে হেরে গেছে।
কিন্তু কী চায় বিশ্বভারতী? এক কথায় প্রবীণরা বলেন, রবীন্দ্রনাথকে জানুন বুঝুন পরিচালকরা, এটা আর পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন নয়, এখানে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা থেকে পরিচালনা করার পেছনে একটি ভাবনা আছে, শুধুমাত্র আইনের বই নিয়ে স্তাবক পরিবৃত হয়ে থাকলে চলবে না। অর্থাৎ রবীন্দ্র ভাবনা ও দর্শন মেনে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাই আসল, কিন্তু সময়ের সাথে শিক্ষারও ধারা বদলাচ্ছে। নতুন নতুন কর্মসংস্থান মুখী বিষয় চলে আসছে, এই সব বিষয় এখানে পড়ানো বাঞ্ছনীয় কিনা, প্রশ্ন আছে তা নিয়েও। তিন হাজার হেক্টর জুড়ে বিশ্বভারতীর সম্পত্তির মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা, তা রক্ষার পাশাপাশি সংস্কার এবং সংরক্ষণের দাবিও উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনের পরিশ্রমের ফসল এই বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু সেখানে পরিকাঠামো উন্নত থাকতে পারছে কই? সঙ্গীত ভবন বা কলা ভবনের উৎকর্ষতা আজও অনস্বীকার্য হলেও অধিকাংশ বিভাগই নানা সমস্যায় জড়িয়ে চলেছে। ছাত্র শিক্ষক অনুপাত গড়ে ১:১৩, প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থীর জন্য স্পষ্টতই আরও শিক্ষক প্রয়োজন। প্রায় ৫৫০ জন শিক্ষক শিক্ষিকা থাকলেও কর্মচারী নিয়োগ প্রসঙ্গে বারবার প্রশ্ন তুলেছে সিএজি (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল) এবং ইউজিসি (ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন)।
১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্বভারতী এমন কিছু বিভাগ চালু করে, যার জন্য ইউজিসির অনুমোদন নেওয়া হয় নি। কোথাও আবার নিছকই কাউকে নিয়োগ করার জন্য পদ তৈরী করে সেই ব্যক্তিকে বেতন দেওয়া হচ্ছে, যে পদের প্রয়োজন নেই। প্রায় ৭৫০ জন কর্মচারী বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের বেতন হার মেনে আকর্ষনীয় তাদের বেতনক্রম, কিন্তু বিশ্বভারতীতে কেউ শোনেন নি কর্মচারী নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছে। তাহলে কিভাবে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে তা জানতে চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। নিয়োগ সংক্রান্ত স্পষ্ট কোন নীতিই নেই।
১০ বছর আগে শিক্ষক কর্মীদের প্রায় আড়াই কোটি টাকা বাড়তি দেয় বিশ্বভারতী, এই বাড়তি টাকার হিসেব চেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চুরি ছিনতাই নিত্যদিনের ঘটনা, ছাত্রাবাসগুলোর অবস্থা সঙ্কটজনক, নিরাপত্তার জন্য কর্মী থেকে সিসিটিভি, হরেক বন্দোবস্ত থাকলেও নোবেল চুরির পরেও অবস্থার হেরফের হয় নি।
হরেক সমস্যায় জর্জরিত বিশ্বভারতীতে উপাচার্য পদ যথার্থই কাঁটার মুকুট। নানা গুনীজন উপাচার্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব যেমন বৃদ্ধি করেছেন, তেমন আবার ১৯৯৫ সালে প্রবীন গণিতজ্ঞ দিলীপ সিনহা উপাচার্যের পদে থেকে নানা অনৈতিক কাজ করে বিশ্বভারতীর সম্মানহানি করে গেছেন বলে আক্ষেপ বহু জনের। শেষ পর্যন্ত জেলে যেতে হয় ঐ উপাচার্যকে। তারপর আসেন সুজিত বসু, যিনি স্তাবক বলয় গড়ে উঠতে দেন নি। ছিলেন স্পষ্টবাদীও, এবং তাঁকে সরাতে মরিয়া হয়ে নেমেছিলেন একদল কর্মী। তাঁর সময়েই নোবেল পদক সহ অন্যান্য সামগ্রী চুরি হয়েছিল রবীন্দ্রভবন থেকে। সুজিতবাবু তাঁর দায়িত্বের সময়সীমা শেষ করার পর তাঁর অবসরের দিন ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসব করার মতন দৃষ্টিকটু ঘটনাও ঘটেছে।
তবে সাম্প্রতিক কালে অধ্যাপিকা সবুজকলি সেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হয়েও নিরলস পরিশ্রম করে অধিকাংশের মনজয় করেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় সুবিধে, তিনি শান্তিনিকেতনের মানুষ, বিশ্বভারতীতেই শিক্ষালাভ, সেখানেই অধ্যাপনা। ফলে তিনি বিশ্বভারতীর স্বতন্ত্রতা বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন।
শিক্ষাবিদ সুপ্রিয় ঠাকুর বলেন, "উপাচার্যকে যেমন আইনের দিকটা ভালো জানতে হবে, তেমনি রবীন্দ্রনাথকেও জানতে হবে।" ২০০৬ সালে বিশ্বভারতীর পরিদর্শক রাজ্যপালকে প্রবীণ শিক্ষক গুণেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেছিলেন, "শান্তিনিকেতন শুধু চোখে দেখার জিনিস নয়, একে অনুভব করতে হয়। এখানে দায়িত্ব নিতে গেলে শুধু ডিগ্রী দিয়ে হয় না, রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে জেনে তাকে আত্মস্থ করতে হয়।" এই সময় নতুন উপাচার্য কি পারবেন ব্রাহ্ম ধর্মের কেন্দ্রভূমিতে দাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের শিক্ষায়তনকে সঠিক পথে চালাতে?