এবারের লোকসভা নির্বাচন বারবার চরিত্র বদলাচ্ছে। পাঁচ বছর আগে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর সাধারণভাবে তারাই বেশিরভাগ রাজ্যের বিধানসভায় ভোটে জিতেছে। তবে শেষ দুবছরে পরিস্থিতি বদলেছে অনেকটা, এবং বিভিন্ন নির্বাচনে বিজেপির সমর্থন কমার ইঙ্গিত মিলেছে। তার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে নোট বাতিলের আপাত ব্যর্থতা, কারণ কালো টাকার তেমন কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। এসেছে জিএসটির বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন। শেষের দিকে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি বিজেপির পালের হাওয়া কেড়ে নিচ্ছিল তা হল দীর্ঘস্থায়ী কৃষক আন্দোলন। কিন্তু তড়িৎ গতিতে রাজনীতির ধারা বদলেছে যুদ্ধ পরিস্থিতির আবহে।
ফেব্রুয়ারির শেষে নাসিক থেকে মুম্বই দ্বিতীয় লং মার্চের খবর ছোট হতে হতে উপসংহারে অদৃশ্য। সরাসরি ভোটের ওপর প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে কৃষক আন্দোলনকে পেছনে সরিয়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছে জাতীয়তাবাদ। সোজা হিসেবে এতে বিজেপির সুবিধে হওয়াই স্বাভাবিক। আবার সীমান্ত উৎকণ্ঠার আগের দিনগুলোতে কিছুটা বেশি ভোটের গন্ধ পাওয়া কংগ্রেসও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়া চেষ্টা করছে। অন্যান্য বিরোধী দলগুলোও বসে নেই।
সাধারণভাবে বিজেপির ক্ষেত্রে জোটের জট কম। শিবসেনার সঙ্গে মন কষাকষি আপাতত মিটে গেছে। বিহারে নীতিশের সঙ্গে জোট নিয়েও সমস্যা নেই। দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিষয়টা ততটা পরিষ্কার না হলেও বিজেপি তার নিজের মতো করে চেষ্টা করছে। বড় দল হিসেবে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার কারণে অন্য ছোট দলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন তাদের কম। তুলনায় অবশ্যই কংগ্রেসের ক্ষেত্রে জোট সামলে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি অনেক বেশি জটিল। তার কারণ বিভিন্ন রাজ্যে এখনও কংগ্রেসের শক্তি বেশ কম, আর সেখানে জোটের নীতিনির্ধারক হওয়া তাদের পক্ষে শক্ত।
এদিকে নির্বাচন যেহেতু এগিয়ে এসেছে, তাই এই শেষের অল্প সময়টুকুতে রক্ষণাত্মক খেলতে চাইছে না কোন দলই, নিজের প্রভাব ভোট শতাংশের সাপেক্ষে যতই কম হোক না কেন। এ যেন নড়বড়ে টেবিলের ওপর কনুই রেখে কবজির জোর পরীক্ষা। আসনের হিসেবে চুলচেরা বিশ্লেষণ আর একই সঙ্গে চূড়ান্ত স্নায়ুযুদ্ধ। গোটা ভারতের বিজেপি বিরোধী বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। লড়াই এখন লম্বা হওয়ার, আবার অন্যদিকে ভারসাম্যের বিষয়টাও মাথায় রাখতে হচ্ছে।
একটা সম্ভাবনার কথা সবাই বলছেন, যে বিজেপির আসন কিছুটা কমতে পারে। বিজেপি যদি কোন কারণে আগের লোকসভার তুলনায় কম আসন পায়, তাহলে অঙ্কের নিয়মে অন্য কয়েকটি দলের আসন বাড়তেই হবে। গত নির্বাচনে কংগ্রেসের আসন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। ফলে তাদের আসন বাড়বেই। তবে কতটা বাড়বে সেটাই এই মুহূর্তে সবথেকে বড় প্রশ্ন। আপাতত যা হিসেব, তাতে সহজেই একশো পেরোতে পারে রাহুল গান্ধীর দল।
মনে রাখতে হবে, হিন্দি বলয়ে তিন রাজ্যের বিধানসভা ভোটে ক্ষমতা দখল করেছে কংগ্রেস। লোকসভা ভোট জমে যাওয়ার একটা বড় কারণ এই ফল। তার নিরিখেই বিরোধী জোটে কংগ্রেস নেতৃত্বে থাকছে কি থাকছে না, এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে বসন্তে ভারত-পাক অশান্তি বেড়েছে অনেকটা, সীমান্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত। বারবার আলোচিত হচ্ছে যে জাতীয়তাবাদ অবশ্যই বিজেপির পালের হাওয়া। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দেশের বীর সৈনিকদের সঙ্গে থেকে তার ভাগ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন রাহুল গান্ধী। কিন্তু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় বিরোধী দলের সুরে এই সংঘাতে সেনাবাহিনীর সাফল্য সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নও তুলতে হয়েছে তাঁকে। এই স্ববিরোধিতা অবশ্যই রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে কিছুটা।
মতের দোদুল্যমানতা সামলে সমর্থন বাড়ানোর কাজটা সবসময়েই জটিল। এর মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হচ্ছে। সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ একেবারে বন্ধ না হলেও দেশজুড়ে উত্তেজনা অবশ্যই স্তিমিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করা কাশ্মীরিদের ওপর জুলুমের সংখ্যা দু-তিন অঙ্ক থেকে এক অঙ্কে নেমেছে। ভোটের দিন ঘোষণা সংক্রান্ত খবর জায়গা করে নিচ্ছে প্রথম পাতায়। আর সেই সঙ্গে শোভা পাচ্ছে পাতাজোড়া রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন। আসলে পাতাজোড়া বললে কম বলা হবে, বলা ভালো গোটা কাগজ ঝেঁপে সরকারি বিজ্ঞাপনের বৃষ্টি। রাজ্যে তৃণমূল আর কেন্দ্রে বিজেপি যে এত উন্নতি করেছে সে খবর অবশ্যই সংবাদপত্রের পাঠক পাঠিকাদের এতদিন জানা ছিল না। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, যে যুদ্ধকে হার মানিয়ে পুনরায় ভোট ঢুকছে মানুষের মনে, মগজের অন্দরে।
আর ঠিক সেই সময়েই কংগ্রেস ঘোষণা করেছে উত্তর প্রদেশের এগারোজন প্রার্থীর নাম। তালিকায় পরিচিত আসন থেকে রাহুল আছেন, আছেন সনিয়া। আছেন কংগ্রেসের নামজাদা নেতা সলমন খুরশিদ। প্রথম নজর রাখার বিষয় যে এই তালিকায় সদ্য সরাসরি রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর নাম নেই। কংগ্রেসের দিক থেকে এ এক বুদ্ধিমান চাল। অন্যান্য পক্ষকে এখন নজর রাখতে হবে উত্তর প্রদেশে কোনো নামজাদা বিজেপি প্রার্থীর (পড়ুন প্রধানমন্ত্রী) বিরুদ্ধে কংগ্রেসের যুবনেত্রী প্রার্থী হন কিনা।
তবে এসব চমক বাদ দিলে দেশের সবথেকে বড় রাজ্যে আসন ভাগাভাগির হিসেবটা মোটামুটি পরিষ্কার। বসপা আটত্রিশ আর সপা সাঁইত্রিশ হলে বাকি থাকে পাঁচ। তার মধ্যে তিন পেয়েছে আরএলডি। বাকি দুই গান্ধী পরিবারের জন্যে। এবার কংগ্রেস এগারো আসনে প্রার্থী দেওয়ায় সেখানে কিছু আসনে সপা-বসপার সঙ্গে কংগ্রেসের লড়াই হবে, সেক্ষেত্রে কিছুটা লাভবান হওয়ার কথা বিজেপির। কিন্তু হিসেব বিশেষ বদলাবে না, তার কারণ কংগ্রেসের ভোট শতাংশ উত্তর প্রদেশে খুব বেশি নয়, এবং অত্যন্ত সাধারণ বুদ্ধিতে তারা নিজেদের ভোট বাড়িয়ে বিজেপির সুবিধে করে দেবে না। গান্ধী পরিবারের সদস্য (দুই থেকে তিন হতে পারে) আর সলমন খুরশিদের মত দুএকজন বড় নেতা মিলিয়ে সর্বোচ্চ পাঁচের মত আসন পেলেই কংগ্রেস খুশি। আপাতত এমনটাই মনে হচ্ছে।
তুলনায় দিল্লীতে কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ভিন্ন। আম আদমি পার্টির সঙ্গে তাদের আঁতাত না হওয়ায় তারা যে কোনো আসন পাবে না, তা প্রায় নিশ্চিত। বরং ত্রিমুখী লড়াইতে এখানে বিজেপির সুবিধে হতেই পারে। তবে উত্তর প্রদেশে আসন সংখ্যা আশি, আর দিল্লীতে সাত। ফলে দিল্লীতে কি হলো না হলো, তা নিয়ে কংগ্রেসের ততটা মাথাব্যথা না থাকাটাই স্বাভাবিক। সে কারণেই হয়ত আপের শর্তে আসন সমঝোতায় না গিয়ে রাজধানীর প্রচার ভাবনায় নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার আভাস দিচ্ছে কংগ্রেস।
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের জোট জটিলতা বামফ্রন্টের সঙ্গে। অবশ্যই বাম এবং কংগ্রেস একসঙ্গে থাকলে তাদের জিতে থাকা ছটি আসনে কিছুটা সুবিধে হতে পারে। তবে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে, এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাম-কংগ্রেসের আসন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম। সুতরাং সেই হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে জোট নিয়ে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের খুব মাথাব্যথার কারণ নেই। ত্রিপুরায় বাম-কংগ্রেস আসন সমঝোতা নিয়েও সামান্য খবর শোনা যাচ্ছে। সেখানে নাকি বামফ্রন্ট কংগ্রেসকে অনুরোধ করেছে প্রার্থী না দাঁড় করাতে। তবে এখানেও মোট আসন মাত্র দুই।
একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, কংগ্রেস যে রাজ্যগুলো থেকে আসন পাবে তুলনায় বেশি, সেখানে কিন্তু খুব বেশি বিশ্লেষণ এখনও শুরু হয় নি। অর্থাৎ সেই সমস্ত ক্ষেত্রে কংগ্রেস তুলনায় ছোট দলগুলোকে খুব একটা আলোচনার জায়গাই দেবে না। এই রাজ্যগুলো মূলত মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্ণাটক, ইত্যাদি। আগে থেকে এই রাজ্যগুলোর আসন সমঝোতা সংক্রান্ত কোন আলোচনা হলে ছোট দলগুলো প্রচার পাবে অনেকটা। সেই সুযোগটা সম্ভবত তাদের দিতে চাইছে না কংগ্রেস। বরং আপাতত তারা সংবাদমাধ্যমের নজর ঘুরিয়ে দতে চাইছে যেখানে তারা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল, সেই রাজ্যগুলোতে।
কৌশল এখানে পরিষ্কার। জোট জটিলতা এবং সেই নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কচকচানি বজায় থাকুক এমন জায়গায়, যেখানে কংগ্রেসের হারানোর কিছু নেই। একই সঙ্গে এটাও নজর রাখা হচ্ছে যে কংগ্রেসের দর কষাকষিতে বা বহুমুখী লড়াইতে যেন খুব বেশি সুবিধে না পায় বিজেপি। উত্তর প্রদেশ বা বিহারের মত বড় রাজ্য হলে জোট ভাবনায় অনেক বেশি সাবধানী হবে কংগ্রেস। উত্তর প্রদেশের ক্ষেত্রে অবশ্যই তা দেখা যাচ্ছে, আর বিহার নিয়েও তাই কংগ্রেস অকারণে খুব বেশি হইচই করছে না। পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি কিংবা ত্রিপুরার মত রাজ্যে আসন আসবে না, ফলে সংবাদের শিরোনামে থেকে সে দিকে নজর ধরে রাখা অবশ্যই যুক্তিপূর্ণ ভাবনা। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের আধিপত্যের কারণে বিজেপির আসন পাওয়ার সম্ভাবনা কম, আর দিল্লি বা ত্রিপুরায় আসনের সংখ্যাই নগণ্য। ফলে তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ভেজাল উত্তেজনার আড়ালে নিঃশব্দে নিজেদের ঘর গোছানোর পরিকল্পনা করছে কংগ্রেস। তাদের নজর সেখানেই, যেখানে তারা একেবারে সামনের সারিতে, এবং প্রতিপক্ষ সরাসরি বিজেপি। সেই রাজ্যগুলোতে ইতিবাচক ফলাফলই কংগ্রেসকে আসন যোগান দেবে।
কলকাতায় ১৯ জানুয়ারির ব্রিগেডে মহাজোটের বার্তা দেওয়া হার্দিক প্যাটেল সম্ভবত লড়বেন কংগ্রেসের টিকিটে। অর্থাৎ যথেষ্ট রাজনৈতিক পরিপক্কতার পরিচয় দিয়ে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ আসন দখলের চেষ্টা করছে তারা। আপাতত দেশজুড়ে আড়াইশো মত সুযোগ্য প্রার্থী বাছাই করে তাতে একশো থেকে দেড়শো আসন জেতার মত অবস্থায় আছে কংগ্রেস। আসন সংখ্যার নিরিখে তারা অবশ্যই বিজেপির পরে থাকবে, কিন্তু একই সঙ্গে অন্যান্য দলগুলোর থেকে এগিয়ে থাকবে অনেকটা। বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তাই বিরোধী জোটকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাটন সম্ভবত কংগ্রেসের হাতেই থাকছে।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)