Advertisment

কোথায় দাঁড়িয়ে কোভিড গবেষণা?

লেখক ডঃ সব্যসাচী সিদ্ধান্ত পদার্থ বিজ্ঞানী। গবেষণার সূত্রে ইতালির ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এবং সুইৎজ্যারল্যান্ডের সার্নের সঙ্গে যুক্ত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

গত কয়েকমাসে আমাদের চেনা পৃথিবীর অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের দাপটে সারা পৃথিবী স্তব্ধ। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি জয় করে এগিয়ে চলার দিশা দিচ্ছে বিজ্ঞান। একদিকে যেমন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা তৈরী করার গবেষণা চলছে, তেমন সংক্রমিতের চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণাও পুরোদমে চলছে। এই যুদ্ধে সামিল হলো সুইজারল্যান্ডের সার্ন (CERN) এবং ইতালির INFN (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স)। আমি ভারতীয়, বঙ্গসন্তান। কর্মসূত্রে ইতালি এবং সুইজারল্যান্ডে থাকি, INFN এবং সার্ন-এ গবেষণা করি। আমার অনেক সহকর্মী এই যুদ্ধে সামিল হয়েছেন।

Advertisment

জেনিভায় অবস্থিত সার্ন কণা-পদার্থবিজ্ঞানের বৃহৎ পীঠস্থান। সার্ন-এর 'লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার'-এই (LHC) আবিষ্কৃত হয়েছিল হিগস-বোসন। সার্নের হাত ধরে হাই-এনার্জি ফিজিক্সের গবেষণাক্ষেত্র থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বেশ কিছু প্রযুক্তিগত হস্তান্তর হয়েছে। ক্যান্সারথেরাপি, মেডিকেল ইমেজিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে। সার্ন-এর সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা WHO) পারস্পরিক সহযোগিতার একটি চুক্তি বিদ্যমান। ভ্যাকসিন তৈরীতে বা এপিডেমিক মডেলিং-এর জটিল সিমুলেশনের জন্য বৃহৎ কম্পিউটিং পরিকাঠামোর দরকার হয়। সার্ন-এর শক্তিশালী কম্পিউটিং পরিকাঠামো, যার নাম ওয়ার্ল্ডওয়াইড LHC কম্পিউটিং গ্রিড, তা ওই গবেষণার কাজে লাগানো হচ্ছে।

করোনা অতিমারীতে অনেকের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন পড়ছে। অনেক দেশেই ভেন্টিলেটরের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। নতুন ভেন্টিলেটরের যোগান দেওয়ার সমস্যাও হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে সার্ন-এ পার্টিকেল ডিটেক্টর (গ্যাস বেসড) প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এক ভেন্টিলেটর তৈরী করা হয়েছে (সঙ্গে ছবি) যার নাম 'হাই-এনার্জি ফিজিক্স কমিউনিটি ভেন্টিলেটর'(HEV)। ইতালির INFN-এর গবেষকরাও 'মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর মিলানো' (MVM) নামক ভেন্টিলেটর তৈরী করেছেন।

এগুলি তৈরির প্রতিটি পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। যন্ত্রগুলি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়ার পরীক্ষা চলছে। এই যন্ত্রগুলি খুব কম খরচে এবং কম সময়ে তৈরী করা সম্ভব। যন্ত্রগুলির খুব কম শক্তির প্রয়োজন, তাই প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে বিদ্যুৎ সমস্যা আছে, সেখানেও ব্যবহার সম্ভব। বর্তমান অতিমারীতে এই যন্ত্রগুলি ব্যবহারের ছাড়পত্র যদি নাও মেলে, তাহলেও এই উন্মুক্ত প্রযুক্তি ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।

publive-image সার্নের ভেন্টিলেটর, সৌজন্যে সার্ন, সুইৎজারল্যান্ড

ইতালি এবং সুইজারল্যান্ডে আমার সহকর্মীদের এই গবেষণার সাক্ষী হতে পেরে আমি গর্বিত। এখানে এই বিপর্যয়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলি বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা সেসব পর্যালোচনা করছেন। যে কোনও সমাজ সচেতন নাগরিকের মতো আমিও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। প্রকাশিত তথ্য থেকে প্রাথমিক কিছু শিক্ষা বিশেষজ্ঞ না হয়েও নেওয়া যায়। একজন সাধারণ জিজ্ঞাসু নাগরিকের দৃষ্টিকোণ থেকে সেরকম কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারি যা ভারতবর্ষে এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রাসঙ্গিক।    

হাসপাতাল হটস্পট: ইউরোপে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী অজস্র চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হয়েছেন। এরকম ঘটনা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে অচল করে দিতে পারে। করোনা হাসপাতালগুলি হয়তো সতর্ক, কিন্তু অন্যান্য হাসপাতালগুলিতেও একইরকম সতর্কতা জরুরি। হাসপাতালে সংক্রমণ আরম্ভ হলে অন্যান্য রোগীরাও সংক্রমিত হতে পারেন। ইতালিতে বয়স্ক এবং অসুস্থ মানুষদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য কিছু বিশেষ প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের বলা হয় 'কাসা দি রিপোসো'। সেসব জায়গায় এই সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তাই অন্যান্য কারণে অসুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।

হোটেল কোয়ারেন্টাইন এবং ট্রেন হাসপাতাল: ইউরোপের হাসপাতালগুলিতে স্থান সংকুলানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। মৃদু উপসর্গ দেখা দিলে রোগীদের হোম কোয়ারান্টিনে থাকতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাড়িতে পরিবারের অন্য সদস্যদের সংক্রমণ হচ্ছে। তাই হাসপাতাল এবং বাড়ির বাইরে একটা বিকল্প ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন হোটেল এবং অতিথিশালা এই কাজে লাগানো যেতে পারে। সেসব জায়গায় তদারকির জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ভ্রাম্যমাণ দল তৈরী করা যেতে পারে।

ভারতে ট্রেন হাসপাতাল একটি দুর্দান্ত উদ্যোগ। এগুলি সম্ভবত আইসোলেশন ওয়ার্ড হিসাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। এই ট্রেনগুলি প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, যেখানে স্বাস্থ্য পরিষেবা অপ্রতুল এবং রোগীদের যত্ন নেওয়া বিলাসিতা। গুরুতর রোগীদের করোনা হাসপাতালে নিয়ে আসতেও এই ট্রেনগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে।  

অত্যাবশ্যক পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল: অত্যাবশ্যক পণ্য সরবরাহের শৃঙ্খলা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের কিছু অংশে কৃষিকাজের জন্য কিছু নিয়ম শিথিল করা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রিত এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা-সম্বলিত পদ্ধতিতে কৃষিক্ষেত্রকে সচল রাখা এবং সরবরাহের শৃঙ্খল বজায় রাখার বিষয়ে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন কৌশল রচনা করছে। বড় সুপারমার্কেটগুলির পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রলম্বিত লকডাউনের ক্ষেত্রে খাদ্যের সংকট এবং তা থেকে উদ্ভুত আইন শৃঙ্খলার সমস্যা এড়াতে এই কৌশলগুলি দ্রুত প্রয়োগ করা দরকার।

হোম ডেলিভারি: লকডাউনের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে অত্যাবশক পণ্যের বিক্রয়/বন্টন ব্যবস্থা। ভারতবর্ষের বাজারগুলি যেভাবে সংগঠিত, এবং যা জনঘনত্ব, তাতে সামাজিক দূরত্ব মেনে বাজার করা অসম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে কিছু জায়গায় সরকার এবং কয়েকটি সংস্থা হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু জনসংখ্যার অনুপাতে সে ব্যবস্থা কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন। যেসব সংস্থা অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমে বাড়িতে বিভিন্ন পণ্য, রেস্তোরাঁর খাবার ইত্যাদি পৌঁছে দেয়, তাদের পরিষেবা পরিকাঠামো সরকার গণবন্টন ব্যবস্থায় ব্যবহার করতে পারে। অ্যাপ ক্যাব সংস্থাগুলিও এগিয়ে আসতে পারে, কিছু ক্ষেত্রে এসেছেও। মানুষজনের চলাচল অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হবে। সেই কর্মীদেরও অর্থনৈতিক সুরাহা হবে।

সময়ের সঙ্গে অত্যাবশ্যক পণ্য এবং পরিষেবার তালিকা দীর্ঘতর হবে। তাই লকডাউন প্রলম্বিত হলে পরিষেবা প্রদানে প্রভূত সমস্যা দেখা দেবে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও আরও বড় আকার ধারণ করবে। তাই বর্তমান লকডাউন সফল করা অত্যন্ত জরুরি।  

লকডাউন-পরবর্তী সময়ে বেশ কিছুদিন আমাদের সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তার জন্য এখন থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে সচেতনতা বাড়িয়ে তুলতে হবে।

অতীতের কিছু মহামারীর মতো এই অতিমারীর সম্ভাব্য কারণ বন্যপ্রাণীর থেকে মানুষের মধ্যে ভাইরাসের 'ক্রসওভার', বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় 'জুনোসিস'। ভবিষ্যতে এই ধরণের জুনোসিস এড়াতে প্রয়োজন মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর প্রকৃতিজাত দূরত্ব বজায় রাখা। বন্যপ্রাণীদের বাসস্থান ধ্বংস শুধুমাত্র পরিবেশের ক্ষতি করছে না, জুনোসিস-এর সম্ভাবনাও বাড়িয়ে তুলছে। আর বলাই বাহুল্য যে বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত সবরকম ব্যবসা চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে।  

এটা অনস্বীকার্য যে আমরা এই বিশাল বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। বিভিন্ন দেশেই স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর প্রভূত উন্নতি দরকার। যা মনে হচ্ছে, সরকারের তরফে বেসরকারি চিকিৎসার বীমার টাকা যোগান দেওয়ার চেয়ে সেই টাকা সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতিসাধনের জন্য বেশি প্রয়োজন। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রেও বরাদ্দ নিয়ে ভাবনাচিন্তা দরকার, যা ভবিষ্যতে এই ধরণের বিপর্যয় থেকে বেরোনোর পথ দেখাবে।

ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর বহু দশক পেরিয়ে গেছে। সময় এসেছে অসংগঠিত ক্ষেত্রকে সংগঠিত করার, শিল্পে, কৃষিতে, সর্বক্ষেত্রে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার সংগ্রাম দেখে আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি। কিন্তু আমরা এত দশকেও তাঁদের ঘরে উন্নয়নের কতটুকু আলো পৌঁছে দিতে পেরেছি? সময় এসেছে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে দেশের উন্নয়নের জন্য রাজনীতি করার। সর্বোপরি সার্বিক শিক্ষার আলো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যা আমরা এখনো সুষ্ঠুভাবে দিতে পারিনি। তাহলে ভবিষ্যতের সেই প্রজন্মের হাতে পৃথিবীর সমস্যা সমাধানের সঠিক দিশা থাকবে।

এই ধরণের বিপর্যয় যখন আসে, তখন গোটা সমাজকে একটা বৃহৎ আয়নার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের খামতিগুলো। স্বাস্থ্যে, শিক্ষায়, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে, মূল্যবোধে, মানবিকতায়। সর্বক্ষেত্রে। উপলব্ধি করতে পারি মানুষ হিসেবে আমাদের স্থান কোথায়। আশা রাখি যে এই বিপর্যয় থেকে সঠিক শিক্ষা নিয়ে আমরা একটা উন্নততর সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাব।

coronavirus
Advertisment