বছর দশেক আগে দক্ষিণ জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলুম। হলভর্তি শ্রোত্রীকুলে একজন মাত্র ভারতীয়, বিশেষত চেহারায়। চোখ গেল তাঁর দিকে। সুশ্রী চেহারা। বয়স পঁচিশের বেশি নয় হয়তো। বক্তৃতা শেষে নিজেই আলাপ করলেন, পরিচয় জানালেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়েছেন, বালিগঞ্জে বাড়ি। স্কলারশিপ নিয়ে দুই বছরের জন্য ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে, পিএইচডি করছেন। কী বিষয়ে পিএইচডি, বলেছিলেন নিশ্চয়, মনে পড়ছে না এখন। নামও বলেছিলেন, ভুলেছি সেই কবেই।
হঠাৎই টেলিফোন: "দাদা, আমি প্রপা ঘোষাল, চিনতে পারছেন? ফ্রাইবুর্গে পরিচয় হয়েছিল। আপনার ফোন নম্বর এখনও ঠিক আছে দেখছি। পিএইচডি'র পরে দেশে যাওয়া হয় নি, অবশ্য গিয়েছি অনেকবারই। গবেষণার সময় ফ্রাঙ্ক-এর সঙ্গে পরিচয়, ওকেই বিয়ে করেছি। আছি ফ্রাইবুর্গেই। আমাদের দুই সন্তান, মেয়ে ও ছেলে।"
বিস্তারিত জিজ্ঞেস করি নি, দরকারও নেই। প্রপার প্রশ্ন, "কেমন আছেন? সাবধানে থাকবেন, ঘরের বাইরে যাবেন না। গেলে মাস্ক পরবেন। আপনার বয়স হয়েছে, উপরন্তু হার্ট এবং ডায়াবেটিসের রোগী আপনি। আমাদের এখানে দুজন বাঙালি করোনায় আক্রান্ত, দুজনেই বয়স্ক। দুজনই গৃহবন্দি।"
জানতে চাই, আমার রোগের কথা কী করে জানলে? প্রপার উত্তর, "দশ বছর আগে আপনিই আমাকে বলেছিলেন।" কুশলাদি জানার জন্য ধন্যবাদ জানাই।
না বললেও চলে, তিনজন বাঙালি একত্র হলেই একটি রাজনৈতিক পার্টি। অতঃপর ঝগড়া। বিচ্ছেদ। পাঁচজন বাঙালির সম্মিলন মানেই আড্ডা, পরনিন্দা। বিদেশে আরও বেশি। কার কত টাকাকড়ি, দেশে বাড়ি করেছে, ইত্যাদি গল্প। সত্যমিথ্যা যাচাই দুষ্কর। একথা ঠিক, পুজোয়, ঈদে, বাংলা নববর্ষে কিংবা বাঙালির কালচারাল অনুষ্ঠানে সমবেত। একাত্ম। যেন ঘরোয়া। দুই বাংলার বঙ্গীয়কুল আপন, নির্ভেজাল, অসাম্প্রদায়িক।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কারোর সঙ্গে কারোর দেখাসাক্ষাৎ না হলেও, নিত্যদিন ফোন করছে, কুশলাদির সংবাদ নিচ্ছে। সুবিধে-অসুবিধের কথা বলছে। কেবল বার্লিনেই নয়, গোটা জার্মানির বাঙালি (পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ) যেন দেশভাগ ভুলে গেছে। ধর্ম ভুলে গেছে। হিন্দু-মুসলিমের বালাই নেই। আসল কথা, বিভূঁইয়ে, "বাঙালি ছাড়া বাঙালিদের কে দেখিবে? কে সহচর সুখেদুঃখে?" আরও বড় বিষয়, ভাষা। "মাতৃভাষার মতো আপন কিচ্ছু নেই।" ধর্ম বাহুল্য।
জার্মানির যে রাজ্যেই বাঙালির বাস, একে-অপরের খবর নিচ্ছে। ছড়িয়ে দিচ্ছে বন্ধুদের। বন্ধুরা আরেক বন্ধুকে জানাচ্ছে। বন্ধু থেকে ছড়াচ্ছে খবরাখবর।
বার্লিনের যে অঞ্চলে বাস করি, কয়েকঘর হিন্দিভাষী (উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান), পাঞ্জাবি, তামিল-শ্রীলঙ্কান মুখচেনা। পরিচিত অনেকে। ওদের কয়েকজনের মুখে শুনলুম, "করোনায় প্রত্যেকেই গৃহবন্দি, কিন্তু আমরা এর-ওর খবর নিচ্ছি।" কেবল বার্লিনে নয়, জার্মানির যে যেখানে আছে। বিদেশে ভারত, ভারতীয় আজ এক। দেশে যতই ঝুটঝামেলা থাকুক। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াক। বিভাজন করুক। 'ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া'র কালচার, মানবিকতা এখানেই, এই জার্মানিতে এক, তফাৎ নেই।
জার্মানিতে করোনায় আক্রান্ত ভারতীয়ের সংখ্যা দুই ডজনও নয়। তিনজন বাঙালি, বয়স সত্তরের বেশি, মারা যান নি। বাংলাদেশি ১২ জন আক্রান্ত, জার্মানির নানা শহরে। বার্লিনে দুইজন, এবং দুইজনই যুবতী। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। দুজনেই হাসপাতালে কোয়ারান্টিনে। এগারো দিন পরে মুক্ত। মুর্শিদাবাদের নবনীতা সরকার ফোনে বললেন, "আমরা এতটাই ভেজাল খেয়ে অভ্যস্ত, করোনাভাইরাসও দিশেহারা। কাবু করতে পারছে না।"
করোনার দাপটে বাংলাদেশি/ভারতীয় বাঙালির মন খারাপ অন্য কারণে। ভারতীয় 'গ্রোসারি' (ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কান)-তে ভারতীয় শাকসবজি, মালমসলার সাপ্লাই নেই। "কিনতে পারছি না, এমনকি কাঁচালঙ্কাও নেই, খাব কী? কাঁচালঙ্কা ছাড়া রান্না? বিস্বাদ! মুখে রোচে না। করোনা আমাদের খাদ্যাভ্যাস, খাদ্য কালচারও পাল্টাচ্ছে," বললেন ঢাকার রেহানা বেগম। আবার কলকাতার কোয়েলি সেনের কথা, "বাংলা নববর্ষ গেল, সেজেগুজে কাউকে দেখতে-দেখাতে পারলুম না, করোনা নিশ্চয়ই স্ত্রীলিঙ্গ, হিংসুটে!"
করোনায় ভারতীয় সব দোকান বন্ধ, 'বেঙ্গল শপ'-এর মালিক সুফিয়ান বললেন, "বাঙালিরা আসছে না, পটল, ইলিশের দাম হাফ-প্রাইসেরও হাফ-প্রাইস, কিনুন, আরও হাফ-প্রাইস। এই হালার করুনা (করোনা), আমাগো পথে বসিয়েছে, হালার জার্মান সরকারও করুনা মারতে পারে না। আরেকটা বিয়া করুম। বউকে কমু, ঘরে থাকো, ডবল সন্তানের মা হইবা।" একই কথা ভারতীয়র। "জনসংখ্যা বাড়াতে হবে, জার্মান সরকার চায়," বললেন দিল্লির গীতা-অজিত দম্পতি। বাংলাদেশের মাঈন-সুফিয়ার বয়ান, "করোনায় আমরা আরেক সন্তানের জনক-জননী হব, ইনশাল্লাহ।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন