কলকাতার লা মার্টিনিয়ার ফর বয়েজ স্কুলে পড়তে পড়তে অরিঞ্জয় ব্যানার্জী ছেলেবেলায় বন্ধুদের একটা কথা খুব বলতেন। বলতেন, "আমি বড় হয়ে সেই ব্যক্তি হতে চাই, যাকে পৃথিবীর যে কোনো মহামারীর ক্ষেত্রে যেন প্রথমেই ডাকা হয়।"
আজ মাত্র ৩০ বছর বয়সে হয়তো পূরণ হতে চলেছে অরিঞ্জয়ের এই কিঞ্চিৎ অদ্ভুত আকাঙ্খা। মারাত্মক বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকাতে এই বাঙালি গবেষকের হাত ধরেই বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে ক্যানাডা।
সানিব্রুক হাসপাতাল, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় এবং হ্যামিল্টনের ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষকরা COVID-19 ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের গবেষক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন ডাঃ রবার্ট কোজাক, ডাঃ সামিরা মুবারেকা, এবং আদতে কলকাতার ডাঃ অরিঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। গবেষণারত তিনটি দল প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ ভাইরাসের সূত্র আলাদা করতে পেরেছেন, যা এটির বিরুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জয়লাভ, এবং যা গবেষকদের ভ্যাকসিন তৈরি করতে সহায়তা করবে।
আরও পড়ুন: করোনা ভীতি: স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী
ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো অরিঞ্জয় বলছেন, তিন গবেষক দলের মধ্যে সহযোগিতাই হলো তাদের শক্তির মূল উৎস। এইভাবে যত বেশি ভাইরাসটির চরিত্র পৃথক করা যাবে, তত সেই তথ্য বিশ্বের অন্যান্য গবেষকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে এর ভ্যাকসিন তৈরি করা যাবে বলে অরিঞ্জয়ের বিশ্বাস।
"দীর্ঘ পরিশ্রম, প্রচুর পরিকল্পনা, এবং কাজ সবে শুরু হয়েছে। অনেক কিছু করা বাকি। প্রত্যেকে খুব পরিশ্রম করছেন!” তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে লিখেছেন অরিঞ্জয়। স্কাইপে আমাদের কথোপকথনের সময় তিনি বলেন, "ভ্যাকসিন বানানো তো মুখের কথা নয়। ওষুধ বানানো আর ভ্যাকসিন বা টিকা বানানো এক ব্যাপার নয়।"
তাহলে কীভাবে এগোলেন অরিঞ্জয়রা? “প্রথম কাজ ছিল ভাইরাসটি পাওয়া, সেটিকে পৃথক করা। ভাইরাসই না পেলে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র বানাব কী করে? তাই আমরা মানুষের শরীর থেকে 'সেল' নিয়ে একটা পেট্রি-ডিশে ছাড়তেই দেখা গেল, হু হু করে বাড়ছে ভাইরাস। ভাইরাসটা পেয়ে যেতে আমদের টিকা বানানোয়, বা ওষুধ বানানোয় বা রোগীর চিকিৎসায় অনেকটা সাহায্য হলো। এবার আমাদের ভ্যাকসিন টিম তাদের কাজ শুরু করে দেবে।"
আরও পড়ুন: হাত ধোয়ার কথা যে চিকিৎসক প্রথমবার বলেছিলেন
গত ছ’বছর ধরে অরিঞ্জয়ের গবেষণার বিষয় ছিল, কেন বাদুড়ের শরীরে করোনাভাইরাস বাসা বাঁধলেও বাদুড় তা সহ্য করতে পারে, কিন্তু মানুষ পারে না। দেখা গেল, বাদুড়ের 'ইম্যুন সিস্টেম' বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মানুষের চেয়ে ঢের বেশি। তার জন্য দায়ী বাদুড়দের শরীরে উপস্থিত IRF3 নামক এক শক্তিশালী প্রোটিন। এই IRF3 মানুষের শরীরের প্রোটিনে মেশালে অ্যান্টি-ভাইরাল প্রোটিনের সম্ভাবনা দেখা যায়। "এই পরীক্ষানিরীক্ষা যদিও এখনও ল্যাবেই সীমিত, তাই জিন-থেরাপিতে এটা কতদিনে প্রযোজ্য হবে তা বলা মুশকিল," বলছেন অরিঞ্জয়।
ব্যক্তিগত জীবনে অরিঞ্জয়ের বাবা হলদিবাড়ির চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার। মা শিক্ষিকা। "বাবার বদলির চাকরির দৌলতে আমি সাতটা স্কুলে ঘুরে ঘুরে পড়াশোনা করেছি, কলকাতায় থাকাকালীন লামার্টসে পড়ি। তারপর মুম্বইয়ে সেন্ট জেভিয়ার্সে এবং বম্বে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি," বলছেন অরিঞ্জয়।
তাঁর রিসার্চ চলাকালীন বার্লিনে ক্যানাডার এক প্রফেসরের সঙ্গে আলাপ হয় অরিঞ্জয়ের। বাদুড় নিয়ে তাঁর কাজের কথা শুনে সেই প্রফেসর তাঁকে ডেকে নিয়ে আসেন ক্যানাডায়। সেটা ২০১৪ সাল, অরিঞ্জয় তাঁর থিসিস করতে চলে আসেন এখানে। আজ অরিঞ্জয়কে ডাকছে সারা বিশ্ব, মানবতার কল্যাণে। তাঁর ছোটবেলার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে।
এদিকে, সোমবার সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটেলে এক সুস্থ স্বেচ্ছাসেবী পরীক্ষামূলকভাবে MRNA-1273 নামক করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়েছেন। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য ৪৫ জন স্বেচ্ছাসেবীকে প্রায় ২৮ দিন বাদে বাদে দুটি ডোজ দেওয়া হবে। যদি সেগুলি সফল হয়, তবে সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে কিনা তা প্রমাণ করার জন্য বৃহত্তর সাবজেক্ট গ্রুপের উপর আরও বেশ কয়েকটি পরীক্ষার প্রয়োজন হবে।
সুকুমার রায়ের সেই অমর কবিতার আজ সম্পূর্ণ নতুন তাৎপর্য পাওয়া যাচ্ছেঃ
'বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু,
আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু...'