‘নেশন’-কে রাষ্ট্র (বা state)-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা, সরকার-কে (government) রাষ্ট্রের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা, সাধারণ মানুষের বড়ো ভ্রান্তি। অ্যান্টনি কিং তাঁর ‘ডিসট্রাস্ট অভ গভর্নমেন্ট: এক্সপ্লেনিং অ্যামেরিক্যান এক্সসেপ্শন্যালিজম’ প্রবন্ধে (যত্র, সুসান যে ফার এবং রবার্ট ডি পাটন্যাম, ডিসঅ্যাফেক্টেড ডিমক্রেসিজ হোয়াটস ট্রাবলিং দ্য ট্রাইল্যাটারাল কান্ট্রিজ, ২০০০) দেখিয়েছেন যে কোনো ইউরোপীয়কে government নিয়ে কথা বলতে বললে তিনি শূন্য, বিভ্রান্ত চোখে তাকাবেন। সেটা আবার কী? ইউরোপীয়রা the government বললে বোঝেন, টোনি ব্লেয়ারের লেবার অথবা লায়োনেল জসপাঁ-র সোশ্যালিস্ট গভর্নমেন্ট। ব্রিটিশ এবং আইরিশ ছাড়া ইউরোপীয়রা আইনগতভাবে গঠিত কর্তৃত্বসমূহ হিসেবে the state-এর ধারণা বোঝেন না। সেটা খুব অমূর্ত ব্যাপার; অভৌত, বায়বীয় অস্তিত্ব। আবার এই the government-কে তাঁরা সমাজ ও সরকারের পার্থক্য ও বিরোধিতার প্রসঙ্গে আলাদা কোনো অস্তিত্ব হিসেবে বোঝেন না। তাঁদের কাছে দিনের সরকারটির মানে হলো ডাক-পাসপোর্ট-পেনশন অফিস। রাষ্ট্রিক ও অরাষ্ট্রিকের পার্থক্যও তাঁদের কাছে হারিয়ে গেছে, বিশেষ যখন এযুগে ইউরোপে রেল, ডাক প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ গণ উপযোগিতা কোনো দেশে সরকারের, কোথাও বেসরকারি। প্রতিতুলনায় মার্কিনীরা যখন the government-এর কথা বলেন, তখন তাঁরা বুশ বা ক্লিন্টন প্রশাসনের কথা ভাবেন না, ভাবেন ওয়াশিংটন বা ফেডার্যাল আমলাতন্ত্রের, ‘the feds’-এর কথা। প্রতি সরকারি এজেন্সি তাদেরই প্রতিভূ, অবিশ্বাসযোগ্য, ১৯৩০-এর দশকে ‘the reds’-দের মতো।
আরও পড়ুন, ‘ওরা যুদ্ধবাজ’! মিডিয়া কি নন্দ ঘোষ?
কিন্তু আর্নেস্ট বার্কার-এর মতো রাষ্ট্রতাত্ত্বিকও ১৯৫১ সালে তাঁর প্রিন্সিপ্ল্স অভ সোশ্যাল অ্যাণ্ড পলিটিক্যাল থিওরি বইতে বলেছিলেন রাষ্ট্র আইনিভাবে (juridically) সংগঠিত নেশন। আসলে ষোড়শ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যে রাষ্ট্র থেকে সাম্রাজ্য হয়ে ওঠার গতিপথে ব্রিটেনের স্কচ, ওয়েল্স, আইরিশ জাতিসত্তাগুলি একসময়ে ব্রিটিশ জাতিধারণার মধ্যে ক্ষতিপূরণমূলক আত্তীকরণ খুঁজেছিল। সেটাই হয়তো বার্কারের বক্তব্যের মূলে ছিল। কিন্তু নেশন তো জাতি নয়! কোনো কথা রবীন্দ্রনাথের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিলে বাঙালি খুশি হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথও যখন আত্মশক্তি প্রবন্ধগ্রন্থে ‘নেশন কী’ প্রবন্ধে বলেন “স্বীকার করিতে হইবে বাংলায় ‘নেশন’ কথার প্রতিশব্দ নাই। চলিত ভাষায় সাধারণত জাতি বলিতে বর্ণ বুঝায় এবং জাতি বলিতে ইংরাজিতে-যাহাকে race বলে তাহাও বুঝাইয়া থাকে। আমরা ‘জাতি’ শব্দ ইংরাজি ‘রেস’ শব্দের প্রতিশব্দরূপেই ব্যবহার করিব, এবং নেশনকে নেশনই বলিব। নেশন ও ন্যাশনাল শব্দ বাংলায় চলিয়া গেলে অনেক অর্থদ্বৈধ-ভাবদ্বৈধের হাত এড়ানো যায়”, তখন বাঙালি তাঁকেও খুব একটা মানে না।
কিন্তু এই নেশনকে জাতি বলা যাবে না, অথচ রাষ্ট্র বা দেশের সঙ্গে গোলানো উচিত নয় কেন? রাষ্ট্র তবে কী? জোয়েল গার্নারের বলা রাষ্ট্রের যে পঞ্চলক্ষণ সারা দেশে কৈশোর মুখস্থ করে, যথা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, স্থায়িত্ব, সরকার, সার্বভৌমিকতা, তা যে রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় যথেষ্ট নয়, তা অনেক দিন থেকেই বিভিন্ন কারণে সমাজবিজ্ঞানে স্বীকৃত। প্রথমত সংজ্ঞাদানের ভিত্তি হলো পারস্পরিকভাবে বর্জক, একচেটে শ্রেণিবিভাজক মাপকাঠিসমূহের প্রয়োগ যার সাহায্যে বলা যাবে, ‘ক’ মেয়ে/দেশ/নেশন, ‘খ’ ছেলে/রাষ্ট্র, ‘গ’ এলজিবিটি/রাষ্ট্রহীনতা। তদনুযায়ী উপরের পঞ্চলক্ষণের প্রথম চারটি কোনো গ্রাম-মহকুমা-জেলা, অথবা কোনো কর্পোরেট সংস্থা, আমার থাকার ও কাজের জায়গার, আছে। তাদের কেবল সার্বভৌমিকতা নেই। কিন্তু আভ্যন্তরিক আর বাহ্যিক দুই অর্থে সার্বভৌমিকতা পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রেরও আছে নাকি; যেকালে আজকের পৃথিবী কতকটা বৃন্দাবনপ্রতিম, যথায় ‘একা কৃষ্ণ, ষোলশ গোপিনী’? দ্বিতীয়ত অনেকদিন আগেই ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এমিল দুর্খেইম কেবল নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অভাবে যাযাবর জনসমাজগুলিকে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা না দেওয়ায় আপত্তি করেছিলেন। তৃতীয়ত যে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আমি থাকি, যেটা আমার দেশ, সেটা যে রাষ্ট্রহীন হতে পারে, সেটাও আমরা অনেকেই জানি। চতুর্থত আমরা যেখানে দেখেছি যে কার্যগত, যেমন নাগরিকের সুখস্বাচ্ছন্দ্যবিধানের, দিক থেকেসমিতি হিসেবে, রাষ্ট্রগুলো দারুণ আলাদা (তুলনা করুন নরওয়ে/সুইডেন আর পাকিস্তান/আফগানিস্থানের)। এর পর যেহেতু বাহ্যিক অর্থে সার্বভৌমিকতা একটিদুটি রাষ্ট্র ছাড়া কারুর নেই, সেখানে রাষ্ট্রের একমাত্র সংজ্ঞা আসতে পারে আভ্যন্তরিক সার্বভৌমিকতার দিক থেকে।
আরও পড়ুন, শিশু ও সৈনিক
এই অর্থেই দুর্খেইম যাযাবর জনসমাজগুলিকে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা না দেওয়ায় আপত্তি করেছিলেন আর ম্যাক্স হ্বেবার রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তাকে বলেছিলেন, “মানবিক জনসমাজ, যেটি কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সফলভাবে হিংসার (violence) বৈধ ব্যবহারের একচেটিয়া দাবি করে”; আর রাষ্ট্রকে খুঁজেছিলেন “কেবলমাত্র কোনো আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনের তরফে বৈধ হিংসার একচেটিয়াকরণের” মধ্যে। উদারনীতিতে এই হ্বেবারীয় রাষ্ট্রের দোসর নেশন যে আমার দেশ, এমনকি আমার জাতি নয়, তার প্রমাণ হলো বিখ্যাত আধুনিক সমাজতত্ত্ববিদ অ্যান্টনি গিডেন্স নেশনকে একটি ‘সীমানাবেষ্টিত ক্ষমতাধারক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। বলেছেন যে “তাঁর ব্যবহৃত অর্থে নেশন অস্তিত্বে থাকে কেবল যখন যে ভূখণ্ডের উপর একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক নাগাল থাকে সেটি তার সমস্তটার উপরে সার্বভৌমিকতা দাবি করে”, আর নেশন-স্টেট বলতে বোঝেন “নির্ধারিত সীমানাসমূহের (সীমান্তের)উপরে প্রশাসনিক একচেটিয়া বজায় রাখা শাসনক্রিয়ার (violence) প্রাতিষ্ঠানিক আঙ্গিকগুলির একটি গুচ্ছ, যেখানে তার শাসনটি আইন আর আভ্যন্তরিক ও বাহ্যিক হিংসার উপায়গুলির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের দ্বারা অনুমোদিত”।
স্পষ্টতই এখানে নেশন আর নেশন-স্টেটের পার্থক্য গিডেন্সের কাছেও গুলিয়ে গেছে, আর সেটা যে তাঁর বিখ্যাত কলমের বিচ্যুতিমাত্র নয়, তার প্রমাণ দুশো বছর ধরে নেশন আর স্টেটের মধ্যেকার প্রায় অদৃশ্য হাইফেন, যার অধঃশায়ী ভাবনাটা হলো আধুনিক রাষ্ট্রে সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক এই দুটি এত নিকটভাবে সম্পর্কিত হয়ে গেছে যে এখন নেশন আর স্টেট প্রায় সমার্থক। হাইফেনটির বৈধতার আরেকটি পূর্বানুমান এই যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বারা শাসিত মানুষরা মোটামুটিভাবে একটি জোরালো এবং সাধারণ ভাষাগত, ধর্মীয় এবং প্রতীকী আত্মপরিচয়ের অধিকারের কারণে সাংস্কৃতিকভাবে সমসত্ত্ব বা সমজাতীয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিকের এই তালমিল যেখানে সমস্যায়িত, যেখানে বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ভাষায় ‘হাইফেনের আসন্ন সঙ্কট’ ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যেখানে আধুনিক নেশনতাত্ত্বিক ওয়াকার কোনর বলছেন তথাকথিত নেশন-স্টেটগুলির মাত্র কয়েকটিই আসলে তাই (১৯৭১ সালে দশ শতাংশেরও কম), আর ঐতিহাসিক-সমাজতত্ত্ববিদ চার্লস টিলি নেশন-স্টেট আর ন্যাশন্যাল-স্টেটের মধ্যেও পৃথকীকরণে সচেষ্ট, সেখানে দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রের পার্থক্য ছাড়াও নেশন আর নেশন-স্টেটের পার্থক্যও আরো স্বপ্রকাশ হয়ে ওঠে। টিলি দেখিয়েছেন খুব কম ইউরোপীয় রাষ্ট্রই (হয়তো সুইডেন আর আয়ারল্যাণ্ড ছাড়া) নেশন-স্টেটের মাপকাঠি তুষ্ট করতে পারে, আর গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি আর ফ্রান্সের মতো রাষ্ট্রও নির্যাসগতভাবে ন্যাশন্যাল-স্টেটই, নেশন-স্টেট নয়। উপরন্তু এখন পৃথিবীতে অনেক ‘রেস’ বা জাতি আছে, যারা নিজেদের ‘stateless nation’ মনে করে।
আরও পড়ুন, এক দিনের এক বিয়ে
এই অবস্থায় দেশপ্রেম কি কিছুতেই রাষ্ট্র-সরকার-নেশনপ্রেম হতে পারে? বৈধ হিংসার একচেটিয়াকরণের প্রকরণ, বা নির্ধারিত সীমানার সীমান্তের উপরে প্রশাসনিক একচেটিয়ার জন্য রাখা আভ্যন্তরিক ও বাহ্যিক হিংসার উপায়গুলির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের প্রতি আনুগত্য, বশ্যতা, ভীতি, তাদের স্বীকরণ সব হতে পারে, কিন্তু ‘মেরেছো কলসির কানা, তাবলে কি প্রেম দিব না’ বলা যায় কি? সে ভালোবাসা হতে গেলে নেশনের সংজ্ঞাকে পাল্টে নিতে হবে, ঐচ্ছিকতাবাদী পথে। সেটার দুটি ধরণ একশো বছরের ব্যবধানে দুজন চিন্তাবিদ দেখিয়েছিলেন। ‘What is a Nation’ নামের ১৮৮২ সালের এক বিখ্যাত বক্তৃতায়, যেটি সে বছরই প্রকাশিত হয়, আর্নেস্ট রেনাঁ বলেছিলেন, নেশনের অর্থ একটি “বিশাল ঐক্য, যা গঠিত একজন এতদিন কী কী আত্মত্যাগ করেছে, আর এখনও করতে প্রস্তুত আছে তা দিয়ে। এটা তাই এক অতীতকে পূর্বানুমানে নেয়; কিন্তু এটি বর্তমানের একটি স্পর্শসহ ঘটনার মধ্যে চুম্বকায়িত: সম্মতি, একসঙ্গে একটি সাধারণ জীবন যাপন করে যেতে আমাদের অঙ্গীকার। নেশনের অস্তিত্ব (যদি আপনি এই উপমা মার্জনা করেন) এক দৈনিক/প্রাতহিক গণভোট, ঠিক যেমন কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব প্রাণের শাশ্বত উচ্চারণ”। আর একশো এক বছরে গঙ্গায়, রাইনে, সাঁতে, ভোলগায় অনেক জল বয়ে যাওয়ার পর বেনেডিক্ট অ্যাণ্ডারসন ১৯৮৩ সালে ইমাজিন্ড কমিউনিটিজ রিফ্লেকশনস অন দ্য অরিজিন অ্যাণ্ড স্প্রেড অফ ন্যাশনালিজ্ম গ্রন্থে বললেন, নেশন চার অর্থে কল্পিত: (ক)কল্পিত, কারণ এমনকি ক্ষুদ্রতম নেশনের সদস্যরাও কোনোদিন অন্য সদস্যদের জানবে না, সাক্ষাৎ পাবে না, অথবা গলা শুনবে না; (খ) সীমিত হিসেবে কল্পিত, কারণ কোটি জীবন্ত মানুষদের ধারক বৃহত্তম নেশনগুলিরও স্থিতিস্থাপক হলেও সসীম সীমা আছে, যার বাইরে আছে অন্যান্য নেশন; (গ) সার্বভৌম হিসেবে কল্পিত, কারণ এই ধারণাটির জন্ম সেই যুগে যেখানে আলোকোদ্ভাস এবং ফরাসি বিপ্লব দৈবাদিষ্ট, ক্রমোচ্চবিন্যস্ত রাজবংশগুলির বৈধতা নষ্ট করে দিচ্ছে; (ঘ) লোকসমাজ হিসেবে কল্পিত, কারণ তাদের মধ্যে বিদ্যমান বাস্তব অসাম্য এবং শোষণ সত্ত্বেও নেশনকে সবসময় ভাবা হয় এক গভীর, আনুভূমিক সংহতি বা ঐক্য।
দেশপ্রেমের অর্থ যদি করতে হয় রেনাঁর অর্থে, তবে মনে রাখতে হবে তাঁর কথা যে এই দৈনিক গণভোটের ধারণা “ঐশ্বরিক অধিকারের চেয়ে অনেক কম আধিবিদ্যক, ঐতিহাসিক অধিকারের চেয়ে অনেক কম পাশবিক। যে চিন্তাকাঠামো আমি আপনাদের কাছে রাখছি তাতে কোনো নেশনের কোনো রাজার চেয়ে বেশি অধিকার নেই কোনো প্রদেশকে একথা বলার, যে ‘তুমি আমার, আমি তোমাকে অধিকার করছি’। আমাদের কাছে কোনো প্রদেশ তার অধিবাসীরা। যদি কারুর এই ব্যাপারে পরামৃষ্ট হবার অধিকার থাকে, সে তবে প্রদেশের অধিবাসীরা।” এই বাক্যকটির পুরো বাচ্যার্থ খুঁটিয়ে দেখার সাহস বর্তমান ভারতে আমার নেই, আপনারা ভেবে দেখতে পারেন। আমি কেবল এইটুকু বলবো যে রেনাঁ এবং অ্যাণ্ডারসনের ঐচ্ছিকতাবাদী নেশনতত্ত্বে নেশনপ্রেম মানে কল্পিত লোকসমাজের মানুষদের সবাইকে না চিনেই, না দেখে বা শুনেও তাঁদের প্রতি “এক গভীর, আনুভূমিক সংহতি বা ঐক্য”-র বোধ।
এই দেশপ্রেম যতটা লোকসামাজিক (communitarian), ততটা ভৌখণ্ডিক (territorial) নয়। আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত, উত্তরে তুষারকিরীটে আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর কর্তৃক বিধৌত চরণে দীপ্যমান ভারতের ভৌগোলিক তথ্যগুলিকে বিশ্বাসতন্ত্রের সামগ্রীতে বানিয়ে ফেলার যে ধারা ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছিল, তার প্রধান আশ্রয়স্থল ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম্’ স্তোত্র। সেখানেও সুজলা, সুফলা, মলয়জশীতলা, শস্যশ্যামলা, শুভ্রজ্যোৎস্নাপুলকিতযামিনী, ফুল্লকুসুমিতদ্রুমদলশোভিনী, সুহাসিনী, সুমধুরভাষিণী, দেশমাতার ভৌত রূপ থেকে বেরিয়ে এসে, তাতে সপ্তকোটি কণ্ঠকলকলনিনাদকরাল, দ্বিসপ্তকোটিভূজৈর্ধৃতখরকরবাল নররূপায়ণের পরেই বঙ্কিম “তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে” বলেছেন। ফলে দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসায় গড়া স্বদেশ অর্জনের পথেই আসে দেশপ্রেম। তার জন্য এই ভূখণ্ডে কোনো আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনের তরফে বৈধ হিংসার একচেটিয়াকরণের প্রয়াস যে পরিমাণে দেশের মানুষের প্রতি বঙ্কিমী স্বাজাত্যবোধের অনুসারী, অনুবর্তী হবে সেই পরিমাণেই সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতি আমার প্রীতি জন্মাতে পারে। অন্য যে কোনো রাষ্ট্রভক্তি বিপজ্জনক।
এর বিপদের কথা রবীন্দ্রনাথ বহু জায়গায় বলেছেন। আমি কেবল, ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ নামে তাঁর ... বক্তৃতা থেকে কটা লাইন তুলে দিলাম
“আমাদের প্রথমবয়সে ভারতমাতা, ভারতলক্ষ্মী প্রভৃতি শব্দগুলি বৃহদায়তন লাভ করিয়া আমাদের কল্পনাকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল। কিন্তু মাতা যে কোথায় প্রত্যক্ষ আছেন তাহা কখনো স্পষ্ট করিয়া ভাবি নাই। ... আইডিয়া যত বড়োই হউক, তাহাকে উপলব্ধি করিতে হইলে একটা নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ জায়গায় প্রথম হস্তক্ষেপ করিতে হইবে। … ভারতমাতা যে হিমালয়ের দুর্গম চূড়ার উপরে শিলাসনে বসিয়া কেবলই করুণ সুরে বীণা বাজাইতেছেন, এ কথা ধ্যান করা নেশা করা মাত্র — কিন্তু, ভারতমাতা যে আমাদের পল্লীতেই পঙ্কশেষ পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিয়াজীর্ণ প্লীহারোগীকে কোলে লইয়া তাহার পথ্যের জন্য আপন শূন্য ভাণ্ডারের দিকে হতাশদৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন, ইহা দেখাই যথার্থ দেখা। যে ভারতমাতা ব্যাস-বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের তপোবনে শমীবৃক্ষমূলে আলবালে জলসেচন করিয়া বেড়াইতেছেন তাঁহাকে করজোড়ে প্রণাম করিলেই যথেষ্ট, কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে যে জীর্ণচীরধারিণী ভারতমাতা ছেলেটাকে ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিখাইয়া কেরানিগিরির বিড়ম্বনার মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া দিবার জন্য অর্ধাশনে পরের পাকশালে রাঁধিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহাকে তো অমন কেবলমাত্র প্রণাম করিয়া সারা যায় না।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় দেবেশ রায়ের কলামের সব কটি পর্ব পড়ুন এই লিংকে
এটা না শিখলে যে “যে ভারতলক্ষ্মী কেবল সাহিত্যের ইন্দ্রধনুবাষ্পে রচিত, যাহা পরানুসরণের মৃগতৃষ্ণিকার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত”, তার দুষক অনন্তবৃত্তে আমরা আটকে থাকবো, এই কথা কবি বুঝেছিলেন। তাঁর এই উপলব্ধি আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যে “স্বদেশকে মুখ্যভাবে সম্পূর্ণভাবে আমাদের জ্ঞানের আয়ত্ত না করিবার একটা দোষ এই যে, স্বদেশের সেবা করিবার জন্য আমরা কেহ যথার্থভাবে যোগ্য হইতে পারি না। আর-একটা কথা এই, জ্ঞানশিক্ষা নিকট হইতে দূরে, পরিচিত হইতে অপরিচিতের দিকে গেলেই তাহার ভিত্তি পাকা হইতে পারে।” আমাদের এই বিশাল দেশের বিপুল বৈচিত্র্যকে কাছ থেকে দেখে পাওয়া প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে তার সব থেকে পিছিয়ে পড়া অংশের সেবাই যে প্রকৃত দেশপ্রেম, এটা আমরা আজকেও বুঝেছি তো? আমরা যারা ইউরোপীয়দের মতোই রাষ্ট্রের, সরকারের, সমাজের পার্থক্য গুলিয়ে ফেলে রাষ্ট্রভক্তিকে, এমনকি সরকারভক্তিকেই দেশপ্রেম বলে চেঁচাচ্ছি!
(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত)