Advertisment

কোভিডে ছারখার উন্নত দেশের শয়ে শয়ে বৃদ্ধাশ্রম, যেন অনন্ত মৃত্যু মিছিল

নার্স বা সেবিকারা ভয়ে কাজে আসেন নি দিনের পর দিন, কেউ খেতে দেয়নি, কেউ স্নান করিয়ে দেয়নি। না ওষুধ, না খাবার, না ডায়াপার বদল। ক্যানাডা থেকে লিখছেন কাবেরী দত্ত চট্টোপাধ্যায়

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus elderly

প্রতীকী ছবি। অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

'নিজে হাতে ভাত খেতে পারত না কো খোকা

বলতাম, "আমি না থাকলে রে কী করবি বোকা?"

ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদত খোকা আমার কথা শুনে

খোকা বোধহয় আর কাঁদে না, নেই বুঝি আর মনে

ছোট্টবেলায় স্বপ্ন দেখে উঠত খোকা কেঁদে

দু'হাত দিয়ে বুকের কাছে রেখে দিতাম বেঁধে

দু'হাত আজও খোঁজে, ভুলে যায় যে একদম

আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম…'

Advertisment

ক্যানাডায় কোভিডের সবচেয়ে মারাত্মক কোপ পড়েছে শয়ে শয়ে বৃদ্ধাশ্রমের ওপর। দেশে মৃতের সংখ্যার অর্ধেকই এই 'কেয়ার হোম'-এর অশীতিপর, জরাজীর্ণ, জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যাঁদের সন্তানেরা তাঁদের ত্যাগ করেছেন আগেই। এই মহামারীর সময় অধিকাংশকেই পাওয়া গিয়েছে তাঁদের বিছানায়, পরিত্যক্ত, মল-মূত্রে ঢাকা অবস্থায় মৃত। নার্স বা সেবিকারা ভয়ে কাজে আসেন নি দিনের পর দিন, কেউ খেতে দেয়নি, কেউ স্নান করিয়ে দেয়নি। না ওষুধ, না খাবার, না ডায়াপার বদল। অবহেলায়, অনাদরে তাঁদের সদ্গতি হয়েছে একে একে। বাইরে থেকে আঙ্গুল দিয়ে 'হার্ট' বানিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন তাঁদের সন্তানেরা। কেউ কেউ জানেনই না, তাঁদের বাবা-মা বা অন্যান্য আত্মীয় বেঁচে আছেন কি না। বা তাঁদের মৃতদেহ কোথায়। বা দেহের সৎকার হয়েছে কী না।

নচিকেতার সেই বিখ্যাত গান, 'বৃদ্ধাশ্রম', যেন নতুন করে ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে ক্যানাডার মতন উন্নত দেশে। তাই ওই গান দিয়েই শুরু করলাম এই লেখা।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের লীনভ্যালী কেয়ার সেন্টারে প্রথম মৃত্যু। তারপর নিঃসাড়ে Covid-19 নামক অদৃশ্য শত্রু এই বৃহৎ দেশ জুড়ে একের পর এক বৃদ্ধাশ্রম ছারখার করে দিয়েছে। 'কোস্ট-টু-কোস্ট', বলছে সমস্ত সংবাদমাধ্যম। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে ওন্টারিও, এবং কিউবেক, যথাক্রমে প্রায় ২,৩০০ ও ৫,০০০ কিমি দূরত্বে, একই ছাঁদে একের পর এক বৃদ্ধাশ্রমে হাজার হাজার অসহায়, পরিত্যক্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জীবনে থাবা বসিয়েছে এই ভাইরাস।

আরও পড়ুন: করোনাভাইরাস কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে?

শুধু তাই নয়, তাঁরা মৃত অবস্থায় পড়ে থেকেছেন দিনের পর দিন। এক ছেলে তাঁর বাবাকে তিন সপ্তাহ ধরে খুঁজে যখন অবশেষে পেলেন, বাবা তখন শুধুই একটি মৃতদেহ। মন্ট্রিয়ালের এক বৃদ্ধাশ্রমে সমস্ত সেবক-সেবিকা পলাতক, কেউ কাজে আসছেন না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তাঁদের বিছানায় অসহায়ভাবে শয্যাগত। একজন ডাক্তার পর্যবেক্ষণ করতে এসে এই বীভৎস অবস্থা দেখে মরিয়া হয়ে তাঁর স্বামী এবং কিশোর ছেলে-মেয়েকে ডাকতে বাধ্য হয়েছেন সাহায্যের জন্য।

ক্যানাডায় (২৭ এপ্রিল পর্যন্ত) ৪৬,৮৯৫ জন করোনা আক্রান্তের মধ্যে ২,৫৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে হাজারের কাছাকাছি মৃত্যু হয়েছে শুধু বৃদ্ধাশ্রমে। কেন এই অবস্থা? ওয়াকিবহাল মহল মনে করছেন, বৃদ্ধাশ্রমের নার্স বা সেবিকারা যেহেতু প্রায় সকলেই অস্থায়ী কর্মী, সেহেতু জীবিকা-অর্জনের জন্য তাঁরা একাধিক সেন্টারে কাজ করেন। তাঁদের বেতন বা সুযোগ-সুবিধে দুইই নগণ্য, যে কারণে ভালো হাসপাতালে চাকরি পেলেই তাঁরা ছেড়ে চলে যান। যে পরিমাণ পরিশ্রম এঁরা করেন, সেই তুলনায় পারিশ্রমিক পান না। ২০০৪ সালের SARS-MERS প্রাদুর্ভাবের সময় ক্যানাডা সরকার এই বিষয় নিয়ে খুব চর্চা করেছিল, কিন্তু সব ঠিক হয়ে যেতে, সময়ের নিয়মে আর কোনও কাজের কাজ করা হয়ে ওঠে নি।

মাঝখান থেকে জীবনের অপরাহ্নে জরাগ্রস্ত অবস্থায় শয়ে শয়ে মানুষ পরমুখাপেক্ষী হয়ে, অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকতে থাকতে অসহায়ভাবে মরছেন। কেননা, তাঁদের ছেলেমেয়েদের তাঁদের দেখার সময় নেই, বাড়িতে রাখার জায়গা নেই। 'বৃদ্ধাশ্রম' নামক গন্তব্যস্থল থেকে ছাড়ান নেই তাঁদের। বয়স হলে, অসুখ হলে, অথর্ব হয়ে গেলে একটাই ভরশা এই দেশে - বা আজকের পৃথিবীতে যে কোনও 'সভ্য' দেশেই - বৃদ্ধাশ্রম।

আরও পড়ুন: করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ক্যানাডার বাঙালি গবেষকের

এদেশে জীবনে উন্নতিলাভে আগ্রহী অনেক মহিলা তাঁদের উন্নতিশীল কেরিয়ার ছেড়ে দেন সন্তান মানুষ করার জন্য। তার ফলে সরকারের কাছ থেকে অনেক সহায়তাও পাওয়া যায়। কিন্তু আমার এক বন্ধু তার সফল কেরিয়ার ছেড়ে দিয়েছিল তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখার জন্য। সেই বাবদ কিন্তু সরকারের কাছ থেকে বা তার অফিস থেকে কোন সহায়তাই সে পায়নি।

আমরা খুব সহজেই এ দেশের সমাজকে দোষ দিতে পারি, যে এ কেমন সমাজ? এ সমাজে বৃদ্ধাশ্রমই কি সকলের অবধারিত গন্তব্যস্থল? বৃদ্ধ, অশীতিপর, জরাগ্রস্ত বাবা-মায়েদের কাছে রাখে না কেন এই সমাজ? তাঁরা কী করেছেন যে তাঁদের ছেলেমেয়ের বিশাল বিশাল বাড়িতে একটা ঘর জোটে না তাঁদের থাকার জন্য? এই নয় যে এই সমস্ত বৃদ্ধাশ্রম খুব একটা সস্তা। এক-একটা ঘরের জন্য হাজার হাজার ডলার দিতে হয়। তাই যদি হয়, তো নিজেদের বাড়িতে কেন রাখেন না সন্তানেরা? এটাই যদি নিয়ম হয়ে থাকে এই সমাজের, তবে তার মূল গলদটা কোথায়?

সন্তান মানুষ করা এবং বৃদ্ধ বাবা-মা'কে দেখার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। দুজনেই অসহায়। দুজনেরই সাহায্য লাগে চলতে, বসতে, হাঁটতে, খেতে, বাথরুম যেতে। নার্স, আয়া লাগে। এই অবস্থায় যদি সরকার কিছু ব্যবস্থা করে, যে যাঁরা তাঁদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে বাড়িতে রেখে দেখাশোনা করবেন, তাঁদের মাসে মাসে এত টাকা করে ভর্তুকি দেওয়া হবে, আমার মনে হয়, তাতে সমাজের এই বিষাক্ত সমস্যা সমূলে উৎপাটিত হবে। অন্তত মানুষ দু’বার ভাববেন বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর আগে। অন্তত বৃদ্ধাশ্রমটা মানুষের অবশ্যম্ভাবী শেষ বয়সের গন্তব্যস্থল হবে না। অন্তত শেষ জীবনে যে ছেলেমেয়েদের বুকে করে মানুষ করেছেন, তাঁদের দয়া-দাক্ষিণ্য পাওয়ার আশায় বসে থাকতে হবে না। মাথা উঁচু করে বাঁচবেন।

আবার অন্য দিকটাও আছে। আমি এখানকার এক রিটায়ার্ড সার্জনকে চিনি, বাঙালি, ৮৯ বছর বয়েস, বিপত্নীক, সাস্কাচুনে নিজের বিশাল সম্পত্তি বেচে এক কেয়ার হোমে নিজের ইচ্ছেয় আছেন। দুই ছেলের কারোর কাছেই থাকবেন না, তাঁদের অনুরোধ সত্ত্বেও। ছেলেদের বিদেশীনি স্ত্রীরা নাকি তাঁর পছন্দের নয়। অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি নিজের হোম ছাড়বেন না।

আরও পড়ুন: করোনা চিনিয়ে দিচ্ছে ভারতের অনেক গোপন মহামারী

আবার সেদিন চোখে পড়ল 'কোরা' নামক ওয়েবসাইটে একটা প্রশ্ন। একজন লিখেছে, "আমাকে আমার মা এবং তার নতুন স্বামী বাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। আমার ১৮ বছর বয়স, এখনো চাকরি করি না। পড়াশোনা কী করে শেষ করব জানি না। কী করব?" ধাঁ করে উত্তরটা সামনে এসে গেল। যে সমাজে এমন মা-বাবা আছেন যাঁরা ছেলেমেয়েদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন স্বাধীন করার জন্য, যে সমাজে আঁতুড়বেলা থেকেই আলাদা ঘরে রাখা হয় বহু সদ্যোজাতকে, সেই সমাজে বৃদ্ধ বয়সে ছেলেমেয়ে আদর করে, কোলে করে বাড়িতে রাখবেন, এটা আশা করাই বোধহয় অবাস্তব। 'কোল' কথাটাই তাঁরা জানেন না। তবুও তো অনেক ছেলেমেয়ে দেখতে আসছেন, অনেকে টাকাপয়সা দিয়ে দেখছেন। মা-বাবার একাধিক স্বামী-স্ত্রীকে মেনে নিয়ে তবুও তো চোখের জল ফেলছেন বাবা অথবা মাকে হারিয়ে ।

কিন্তু এইসব ব্যাখ্যা-বিবেচনার কোনোটাই ধোপে টেকে না যখন দেখা যায় যে ক্যানাডার মতন উন্নত দেশে বৃদ্ধাশ্রমে অসহায় মানুষগুলো বিছানায় শুয়ে, বিনা চিকিৎসায় মরছেন হাজারে হাজারে। অবস্থা এতটাই গুরুতর যে এখন সেনা নামাতে হয়েছে কিউবেক এবং ওন্টারিও-তে। সেনাকর্মীরাই বাকি যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁদের দেখাশোনা করছেন। যাঁরা এখনও কোভিড আক্রান্ত হন নি, তাঁদের কয়েকজনকে ছেলেমেয়ে বাড়ি ফেরত নিয়ে যাচ্ছেন, কিছু ছেলেমেয়ে জানালার বাইরে থেকে আঙুলের মুদ্রা করে 'হার্ট' দেখাচ্ছেন মাকে, বাবাকে। বাকিরা গর্ব করে বলছেন, তাঁদের বাবা-মা যে কেয়ার হোমে থাকেন, সেটা অতটাও বাজে নয়। তাঁরা ভালো আছেন।

তাই কি? 'ভালো থাকা' কোনটা? নচিকেতার সেই বিখ্যাত গান কি সত্যের কাছে আজ নেহাতই অবান্তর?

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

coronavirus
Advertisment