Advertisment

সারা দেশে কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া সিপিএমের, ভোটের পর জোট, বাংলায় পদ্ম রুখতে ঘাসফুলে নয়

মতাদর্শ বাদে কিছু ব‍্যাপারে এই দুই নীলকমল আর লালকমলে বেশ মিল। কারণ, পার্টি কংগ্রেস মোদ্দা কৌশলের রূপরেখাটুকু ছকে দিয়েছে। যা একনজরে দেখলে কারাট আর ইয়েচুরিতে বড় একটা তফাৎ করা যাবে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ফাইল ফোটো

ওপর ওপর দেখলে মনে হবে, সিপিএমের এটা ডাইকোটমি। বাংলায় আর ত্রিপুরায় কংগ্রেস আর কোনও উল্লেখযোগ্য শক্তি নয়। কিন্তু কেরলে কংগ্রেসই তো মূল শুধু নয়, একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলা, ত্রিপুরায় নাহয় জোট করা গেল তৃণমূল আর বিজেপির বিরুদ্ধে। কিন্তু, কেরলে পৌঁছে সেকুলার জোটের কী হবে? কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলে লড়বে কার সঙ্গে? বিরোধী শক্তির শূন্যতা পূর্ণ করতে শূন্য পাওয়া বিজেপিকে বাম ও কংগ্রেসের কট্টর বিরোধী ভোটাররা তো জাতে তুলবেন। ফলে বিনা শ্রমেই পদ্ম ফুটবে কেরলে।

Advertisment

সুতরাং রণনীতিগত ভাবেই সবটুকু জমি দখলে রাখতে চায় বাম ও কংগ্রেস। মানুষকে দুপক্ষই ফিলার দেয় চরম বিরোধিতার। অতীতে বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে মারাত্মক সংঘাত ছিল সিপিএম-এর। ত্রিপুরাতেও তাই। কেরলে কংগ্রেসই দক্ষিণপন্থী স্পেস দখল করে রয়েছে। তাই বাম-ডান মেরুবিন‍্যাস হয়েই আছে। অনেকটা স্থায়ী ভাবে। এখানে দাঁত ফোটাতে হলে যতটা জবরদস্ত দাঁত চাই তা বিজেপির নেই। আসলে, আরএসএস বিজেপির কেরল শাখার দাঁত-ই ওঠেনি সেভাবে। শবরীমালা নিয়ে উগ্র দক্ষিণপন্থী অবস্থানে গিয়েও হালে পানি পায় নি কংগ্রেস। বিজেপির মহিলা বিরোধী কট্টর পুরুষ তান্ত্রিক অবস্থানের অনুসারী কংগ্রেসকেও দাম দিতে হয়েছে।

আসলে বাম বিরোধী সমর্থনের জমি বাঁচানোই ছিল কংগ্রেসের উদ্দেশ্য‌। কিন্তু এই লাইন নিয়ে তাদের জাতও গেল পেটও ভরলো না। প্রদেশ কংগ্রেসকে ভর্ৎসিত হতে হল রাহুল গান্ধীর কাছে। কংগ্রেস হাইকম‍্যান্ড সিপিএম মুখ‍্যমন্ত্রীর অবস্থানকেই সমর্থন করল। তৎসত্ত্বেও রাজ‍্য কংগ্রেসের নেতারা মনে মনে বামবিরোধী অবস্থান আঁকড়ে থেকে পুরনো রাজনৈতিক মেরুকরণকেই বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই মেরু বিচিত্র ভাবে অটুট থেকেছে অতীতে কেন্দ্রে জোট রাজনীতির বাধ্যতায়। বাম সমর্থিত ইউপিএ-১ সরকারে থেকেও কেরলে কংগ্রেসের জমি এতটুকুও কমেনি। তার পরেও কংগ্রেস সরকারে থেকেছে দীর্ঘদিন।

একইভাবে কেন্দ্রে বারবার বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করার পরেও কেরলে সিপিএমের দুর্গ অটুট। এই দলেরই কেরল লাইন আগাগোড়া কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের বিরোধিতা করে এসেছে। এবং বারবারই প্রমাণ হয়েছে, কেরল লাইনের বাস্তব ভিত্তি নেই। প্রমাণ হয়েছে, সিপিএমের কেরলের নেতাদের চেয়ে মানুষের বাস্তববোধ ও শত্রু-মিত্র চেনার ক্ষমতা অনেক বেশি। সেজন্যই ১৯৮৯-এর রাষ্ট্রীয় মোর্চার সরকারে কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমর্থন ছিল সিপিএমের। পাশাপাশি বিজেপিও বাইরে থেকেই সমর্থন করেছিল বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের ওই সরকারকে। বাবরি বিরোধী আন্দোলন, আডবাণীর অযোধ্যা রথের তাড়নায় সেই সরকার থেকে সরে এসে বিজেপিই ভাঙন ধরালো বিরোধী মহাজোটের ভেতর। পথ প্রশস্ত করল সম্মুখ সমরের। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় অঘটনের পর ৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হল ধর্মের রাজনীতি আর রাজনীতির ধর্মের সমান্তরাল পথচলা।

১৯৯১-তে মোটের ওপর বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই লোকসভা ভোটে লড়েছিল অ-বিজেপি বিরোধীরা। ১৯৯২ সীলমোহর দেয় তার ওপর। জাতীয় আ্যজেন্ডা থেকে কার্যত 'অ্যান্টি কংগ্রেসিজম' বাদ পড়ে। জোট রাজনীতির পুরোধা এদেশে সমাজবাদী ও বামপন্থীরা। বিজেপি জাতীয় দল হিসেবে জোট সরকারের বাস্তবতা মেনে নেয় কংগ্রেসের আগে। একক সরকার গড়ার অহংকার ছাড়তে সময় নেয় কংগ্রেস। কিন্তু জোটযুগে এছাড়া যে পথ নেই ক্ষমতায় আসার।

আরও পড়ুন, রাম রুখতে রাহুলই বাম(ন) অবতার, লক্ষ‍্য দিল্লিতে সেকুলার সরকার

কোয়ালিশনের কাল শুরুর আগে থেকেই বামেরা তাদের অকর্ষিত এলাকায় মন্দের ভালো হিসেবে কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার সুপারিশ করত। সেই ধারা চলে আসছে সিপিএমে, আবহমান কাল ধরে। আজও সেই ট্র‍্যাডিশন সমানে চলেছে। শুক্রবার যে ভোটগ্রহণ পর্ব হল রাজস্থানে, সেই রাজ‍্যে কৃষক ও ছাত্র সংগঠন বেড়েছে বলেই এবার বেশ কিছু বিধানসভা আসনে প্রার্থী দিয়েছে সিপিএম। মোট ২৮টি আসনে। অন্যগুলোতে কংগ্রেসের পক্ষেই প্রচারে বেজার নয় তারা। এখন প্রকৃত ধর্মসংকট সীকর জেলার মত এলাকায়। যেখানে বাম বীজ অঙ্কুরিত হয়ে উঠছে। সীকর কংগ্রেসের জোরদার ঘাঁটি। ধনী কৃষকরা এখানে ভূমিহীনদেরও সঙ্গে নিয়ে চলেন। এবং জোত জমির মালিক জাঠেরা এতটাই প্রভাবশালী যে ছোট চাষীরা তাদের মুষ্টি এড়াতে পারেন না।  অতীতে পঞ্জাব থেকে কার্যত নির্বাসিত বলরাম জাখরের কেন্দ্র হিসেবে সারাদেশে পরিচিত কংগ্রেসের ঘাঁটি। তবু এই সীকরেই শিকড় ছড়িয়েছেন সিপিএমের কৃষকনেতা আমড়া রাম।

শ্রেণি বা জাত এবং রাজনীতি অর্থনীতির দারুণ বাম প‍্যাকেজ তিনি, চলতি বাজার অর্থনীতির পরিভাষায়। আসলে ক্লাস লিডার হওয়ার ক্ষমতা আছে আমড়া রামের। বারকয়েক বিধানসভায় জিতেছেন কংগ্রেসকে হারিয়ে। নিজের সঙ্গে আরও দুই কমরেডকেও জিতিয়েছেন। আকালের কালে এমন এক আবিষ্কার সিপিএমকে রাজস্থানের মরুভূমিতে মরুবিজয়ের কেতন ওড়ানোর আশা জুগিয়েছে। যা আর কিছু না হলেও, অহংকারী কংগ্রেসকে কিছুটা স্পেস ছাড়তে বাধ্য করে। ধনী চাষীর দল জমিহীনকে কি বাধ্য না হলে পাত্তা দেয়? কংগ্রেস যদি বোঝে এটুকু জমি ছাড়লে আখেরে তাদেরই লাভ, তাহলে নিশ্চয়ই ছাড়বে। অবশ্য বিষয়টি বৈষয়িক। পারস্পরিক আস্থা ও মতাদর্শের নৈকট্য জরুরি।

কংগ্রেসকে অর্থনীতির উদারতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ঔদার্য দেখাতে হবে নিজেরই স্বার্থে। নাহলে গোরক্ষকের গোল আটকানো যাবে না। রামগরুড় রুখতে সীতারামকে সঙ্গে নিলে কতটা লাভ, সেই অঙ্ক কষতে হবে। মরুপথে মিল হলে সুজলা সুফলা বাংলাতেও হাতে হাত থাকবে। এটা যত না কংগ্রেসি কৌশল ও শিরঃপীড়ার বিষয় তার চেয়ে অনেক বেশি বাম রাজনীতি। সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটিকেই সেজন্য সর্বাগ্রে কেরলের লক্ষ্মণরেখা ডিঙোতে হবে। এবং মার্কেট নিয়ে মারমুখী হয়ে জমি ছেড়ে দিলে পাঁচ সিকের ছাগলে খেয়ে যাবে হাজার টাকার বাগান। কেরলে কৌশলে জয়, মতাদর্শে কতটুকু, সিপিএমের প্রাজ্ঞ নেতারা জানেন। মোদ্দা কথা মেরুকরণ, এবং দ্বিদলীয় বাস্তবতা।

বাংলার হাল হলে হালে পানি পাবেন কিনা পরীক্ষিত নয়। এতদিনে শবরীমালায় কিছুটা সম্বিৎ ফেরালেন কি মাননীয় মোদী? সিপিএমের ভেতরেই এই খরস্রোত বইছে। ব্রিগেডে সিপিএমের অধুনা ব্রিগেডিয়ার বিজয়নকে বেছে নিয়েছেন মমতা। বাংলার বিমান-সূর্য ব্রাত্য হয়ে বোধহয় বাঁচলেন। জানা নেই মাননীয়া মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা কি শুধু মুখ‍্যমন্ত্রীদেরই ডাকছেন? তাহলে তেজস্বী, অখিলেশ, মায়া এবং দুই শরদের কী হবে? সোনিয়া রাহুলকে নাহয় নাই ধরা গেল।

তবে সিপিএমও কম যায়না। মতাদর্শ বাদে কিছু ব‍্যাপারে এই দুই নীলকমল আর লালকমলে বেশ মিল। কারণ, পার্টি কংগ্রেস মোদ্দা কৌশলের রূপরেখাটুকু ছকে দিয়েছে। যা একনজরে দেখলে কারাট আর ইয়েচুরিতে বড় একটা তফাৎ করা যাবে না। তাছাড়া প্রশ্নও জাগবে, নেতা যেই হোক, কেন্দ্রীয় কমিটি, পলিটব্যুরোয় এখনও কারাট এবং কেরল লাইনই গরিষ্ঠ। তার ফাঁক দিয়ে একটা জোটের জোড়াতালির অঙ্ক স্মাগলড্ হল কী করে? এই উত্তর জানতে হলে সিপিএমেরই কুশলী নেতাদের শরণ নিতে হবে।

আসলে বিশাখাপত্তনমে লাইন নিয়ে লেগে থাকার অবকাশ কম ছিল। সেটা ছিল নেতৃত্ব বদলের কংগ্রেস। দলের ব‍্যাটন হস্তান্তর পর্বেই ছিল দলের ফোকাস। তিন বছর পর হায়দরাবাদে নেতৃত্বের প্রশ্নে গরিষ্ঠ অংশের অবস্থান নিয়ে সংশয় থাকলেও সীতারাম দলের রণনীতি, রণকৌশলের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার লক্ষ্যেই সচেষ্ট ছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত যে বয়ান চূড়ান্ত হল তাতে দুপক্ষই মনে করল তাদের কৌশলগত জয়। দলের ঐক্য রক্ষার আর কোনও উপায় না থাকায় কেন্দ্রীয় কমিটি ও আরও বেশি করে রাজ‍্য কমিটিগুলোকেই অবস্থা বুঝে ব‍্যবস্থা নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হল। ইয়েচুরি লাইনের কৌশলগত চুরিটি কারাটের নজর না এড়ালেও তিনি কিছুটা অনাগ্রহের সঙ্গেই ছাড় দেন। কারণ শেষ কথা বলবেন তো তিনিই।

গৃহীত সূত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির শেষ বৈঠকে, সেকুলার ফ্রন্ট বা একমঞ্চের প্রশ্নে বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে থাকার সম্ভাবনা নস্যাৎ করা হয়। বলা হয়, সারা দেশে বিজেপির আচরণের সঙ্গে বাংলায় তৃণমূলের কোনও মৌলিক ফারাক নেই। একপক্ষ গরিষ্ঠের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ঢাক পেটাচ্ছে, এবং আরেকপক্ষ সংখ্যালঘু মৌলবাদকে মদত দিয়ে দু ধরনের সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই পুষ্ট করছে। অন্য রাজ‍্যে রাজ‍্য নেতৃত্বকেই শেষ কথা বলার ভার দিয়েছে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি। আর সব কথার সার কথা হল, লোকসভায় প্রাক নির্বাচনী জোটের অবকাশ নেই। অবকাশ আছে ভোটের পর জোটের। রামবাণের পাল্টা এটাই বাম টোটকা।

CONGRESS editorial Cpm
Advertisment