মে দিবসের প্রাক্কালে রাজ্য সিপিএমের সর্বোচ্চ নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মহাশয় মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তির্যক ইঙ্গিত করেছেন ইংরিজি উচ্চারণে ‘আর’ এর ব্যবহার নিয়ে। একথা সত্যি যে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ভোট কমা নিয়ে অনেক শিক্ষিত এবং সংবেদনশীল মানুষ চিন্তিত। সহজ হিসেবে রাজনীতি অবক্ষয়ের পথে। কোন সন্দেহই নেই যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ রাজ্যে নেতানেত্রীদের দলবদলের হার বেড়েছে অনেক। অবশ্যই তৃণমূল অন্যদলের ক্ষমতাশালীদের নিজের দলে নিয়েছে। বামফ্রন্ট রাজত্বে যে মধ্যমানের নেতারা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তাদের একটা বড় অংশ আজকে তৃণমূলে, এবং সেখান থেকে আবার কিছু মানুষ চলে যাচ্ছেন বিজেপিতে। এই সব লোকেরা নীতি কিংবা গণতন্ত্রের ধার ধারেন না। অন্যের ভোট নিজের বলে মনে করেন। ফলে একথা বিভিন্ন আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে যে এই সমস্ত নেতারা দল ছাড়ায় বামফ্রন্টের ভোট কমলেও, সঙ্গে দলের মেদও কমেছে অনেক। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে বামেদের ব্রিগেড সমাবেশে ভোট করানো নেতারা ছিলেন না, ছিলেন অনেক বেশি সাধারণ মানুষ। তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি কলকাতা শহরের একটা বিরাট অংশ ঢেকেছিল লাল পতাকায়। মুশকিল হল ভোটপ্রচারে সিপিএমের শীর্ষ নেতা সেই লালের ‘ল’ হারানোয় ততটা চিন্তিত হন নি, যতটা তিনি ভেবেছেন রেড ফ্ল্যাগের ‘আর’ ফেরানো নিয়ে। সেইখানেই প্রশ্ন উঠবে যে ট্যুইটারে তাঁর এলিটিস্ট মন্তব্য বামফ্রন্টের ভোট কতটা বাড়াবে।
আরও পড়ুন, ইংরেজি উচ্চারণ শুধরাতে গিয়ে সোশাল ট্রোলিং-এর মুখে সূর্যকান্ত মিশ্র
একথা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই যে বামফ্রন্টের প্রার্থী তালিকায় শিক্ষিত এবং রাজনীতি সচেতন মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট। কিন্তু মূল প্রশ্ন যেটা আসছে তা হল তাঁরা সেখানে নির্বাচনে জিতবেন কি? ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম হল যিনি বেশি ভোট পাবেন তিনিই নির্বাচিত। সেখানে কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সততার আলাদাভাবে কোন মূল্য নেই। দেশের নব্বুই কোটি ভোটারের মধ্যে অবশ্যই সত্তর কোটি স্বচ্ছল নন। এ রাজ্যেও দুটাকা কিলো চালের সুবিধা যত মানুষ নেন তাতে প্রমাণ হয় যে প্রায় আশি শতাংশ ভোটার নিম্নবিত্ত। তাদের মধ্যে অভিজাত মানুষের সংখ্যা বেশি না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। অর্থাৎ আমাদের রাজ্যে বা দেশে যেহেতু অভিজাত এবং অতি উচ্চশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা মোট ভোটারের অত্যন্ত অল্প শতাংশ, তাই বিরোধী পক্ষের আভিজাত্যের অভাব, উচ্চারণের ত্রুটি এগুলিকে ব্যবহার করে সাধারণভাবে ভোট বৃদ্ধি করা শক্ত। সেই অঙ্কে মিশ্র মহাশয়ের বক্তব্য উচ্চমার্গের মতদানে ইতিবাচক না নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তার অপেক্ষায় থাকবেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে সামগ্রিক ভোটফলে সে খড়ের গাদায় সূচের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন।
অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এখানে উঠে আসবেই। তা হল বামফ্রন্ট নেতা বিরোধী পক্ষের সমালোচনায় ইংরিজি উচ্চারণের অসম্পূর্ণতা নিয়ে এতো চিন্তিত কেন? সেটাকে কি নেত্রীর দুর্বলতা বা দোষ বলে ধরা যেতে পারে? তৃণমূলের তীব্র বিরোধীরাও উত্তর দেবেন “না” এবং উত্তরটা দেবেন অনেক জোর গলায়। উচ্চারণে অসম্পূর্ণতা মোটেও কোন বিপজ্জনক রাজনীতির চিহ্ন নয়। মিশ্র সাহেবের গাঁথা শব্দমালায় গাদা গাদা ‘আর’ বিহীন ইংরিজি শব্দ বলতে না পারলেও সেরকম ব্যক্তিরা আজকের দিনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন অনেক বেশি। সে রাজনীতি যদি রাজ্যের পক্ষে ভালো না মনে হয় তার বিরুদ্ধে লড়াই করার অধিকার বামেদের অবশ্যই আছে। কিন্তু নেত্রী মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছেন বলেই তাঁর দলের ভোটের হার বাড়ছে, আর সাংগাঠনিক দুর্বলতায় অঙ্কের নিয়মেই ভোট কমছে বাম দলের। ধরে নেওয়া যাক কেন্দ্রে বিজেপি আর রাজ্যে তৃণমূলের গোপন আঁতাতে বাম সমর্থকরা আজকাল ভোট দিতেই পারছেন না। ২০০৮ পঞ্চায়েত, ২০০৯ লোকসভা আর ২০১১ বিধানসভাতেও কি কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে চুক্তি করে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে রিগিং করে ভোটে এসেছিল? তখন কি ‘আর’ এর উচ্চারণ ঠিক ছিল? পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষিত এবং অভিজাতদের মধ্যে বামেদের প্রভাব যে গত পঞ্চাশ বছর ধরে অত্যন্ত কম তার প্রমাণ দেওয়ার জন্যে পরিসংখ্যান খুঁজতে হয় না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে আজকের দিনে ভোটের ভাগ সামান্য বাড়তেই পারে বামেদের। কোন জাদুবলে হয়ত সেই ভোটেই জিতে সংসদে পৌঁছলেন সিপিএমের নেতানেত্রীরা। কিন্তু জয়ী বামেরা কি উপরোক্ত ‘আর’ উচ্চারণে পারদর্শী এডুকেটেড এবং এলিটিস্ট সমাজের প্রতিনিধি হতে চান? সেখানেও কিন্তু বাম সমর্থক শিক্ষিত এবং অভিজাত ভোটারকুল আবার ‘না’ বলে চিৎকার করে উঠবেন।
আসলে উচ্চারণ নিয়ে সমস্যা হলে সেটা তো আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝা যায় না। তার জন্যে নিজের ভাষণের রেকর্ডিং শুনতে হয়। ইংরিজিতে ‘আর’ এর পরে আসে ‘এস’। সেখানে আবার আমাদের অনেকেরই ‘স’-এর দোষ। পুরনো কলকাতার ঘটি কিংবা পশ্চিম পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হলে ‘শশীবাবু’-র ‘স’ পিছলে যায়, পূর্বদিকের কোথাও আবার তা ‘সময়’-এর ‘সারণি-তে ’শ’ শুনিয়ে ঠোঁটে আঙুল দিতে বাধ্য করে। তবে ‘সৎ’ উদ্দেশ্যে ‘কৃষক’-‘শ্রমিকের’ জন্যে কাজ করার সময় “স, ষ, শ” নিয়ে বিশেষ ভাবার অবকাশ থাকে না। সর্বহারা-র শুরু আর শেষের ব্যঞ্জনবর্ণে ‘স’ কিংবা ‘র’ এর উচ্চারণ নিয়ে বাম তাত্ত্বিক প্রবন্ধে খুব বেশি কিছু লেখা হয়েছে বলে জানা নেই। আর মাতৃভাষাই যদি বাম আমলের মাতৃদুগ্ধ হয়, তাহলে অন্তত ইংরিজি শব্দগুলো সরিয়ে কিছু উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ খোঁজার জন্যে সময় দেওয়া উচিত ছিল বাম নেতার।
ভাষার মূল প্রয়োজন হল ভাবের আদানপ্রদান। বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সেই কাজটুকু সফলভাবে করছেন। বাম নেতারা সেটা পারছেন কি? চতুর্থ দফা ভোটের পরের দিন টেলিভিশনে খবর আসছে যে নির্বাচনোত্তর সংঘাতে ঘর পুড়ছে বাম সমর্থকেরও। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী হিংসার ‘সমস্যা’ (ইংরিজি অনুবাদে ‘আর’ থাকুক কি না থাকুক) গত চৌত্রিশ বছরেও মেটেনি, মেটেনি শেষ আট বছরেও। মাটির বাড়ির ছাদে খড় জ্বলছে লাল শিখায়। রাঙা মেঘ সত্ত্বেও ক্ষ্যাপা নিশান হাতে নিয়ে যে সব প্রান্তিক সমর্থকরা লড়ছেন তাদের প্রতি মনযোগ দিয়ে ইংরিজি অক্ষরের অনুপ্রাস সংক্রান্ত ভাবনা কি একটু কম ভাবলে চলত না কমরেড? লাল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অন্যান্য বর্ণের থেকে অনেক বেশি। ফলে তাকে বাংলাতেই দেখুন আর ইংরিজিতে, সে ঝাণ্ডা চোখে পড়ে দূর-দূরান্ত থেকে। সেটা মে দিবসের দিনেও সত্যি, আবার বছরের বাকি দিনগুলোতেও মিথ্যে নয়। প্রচারের ধরন বদলে সেই লাল পতাকা আবার নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিলে স্বাভাবিক নিয়মেই ভোট শতাংশ বাড়বে। নইলে বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ নিয়েই চলে যাবেন ‘আর’ ফসকানো নেত্রী। ঔপনিবেশিক পরাধীনতার শ্লাঘা মিশ্রিত বামপন্থী ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কাজে তো লাগবেই না, বরং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে অপারদর্শিতায় তা প্রত্যাঘাত করতে পারে বুম্যেরাং হয়ে।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)