Advertisment

দার্জিলিং, আজও এক শিহরিত সফর...

দার্জিলিং আপনাকে হারিয়ে যাওয়া প্রেমের মানুষের সঙ্গে চুম্বনের আনন্দ এনে দেবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

পাহাড়ের রানি- দার্জিলিং। ছবি- প্রতিবেদক



নীলার্ণব চক্রবর্তী: দার্জিলিংয়ের অনেক নিন্দামন্দ করা হয়ে থাকে। বহু ড্রাইভারের মুখে শুনেছি-- গ্যাংটক মহান, দার্জিলিং মূর্তিমান শয়তান। আরও অনেকেই রয়েছেন এই সমালোচকের তালিকায়। তাঁদের পাল্লায় পড়ে অনেক দিন দার্জিলিং যাই-ইনি আমি। এমনকি কাছে গিয়েও তাকে এড়িয়ে গিয়েছিলাম বেশ কয়েক বার। কিন্তু এবার সব দ্বিধায় চাক্কু চালিয়ে আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম এবার পাহাড়ি শহরটিতে। আর গিয়েই বুঝলাম কত বড় ভুল আমি করেছি এখানে না এসে, এত দিন, বার বার করে গিয়েছি কত বড় ভুল! বুঝতে পেরেছি দার্জিলিং না দেখলে দৃষ্টি আমার গরিব হয়ে থাকত কতটা!

Advertisment

ফেরার পর, সেখানে বরফ পড়ার খবর পেলাম। ছবিতেও দেখলাম। মনে হল, দার্জিলিংয়ের রূপ আরও খোলতাই হয়ে উঠেছে তাতে। একটু হাহুতাশ হচ্ছে এই বরফপতনের ছবি নিজ-নয়নে না দেখার জন্য। এটাও ভাবছি, সেই সঙ্গে, সান্ত্বনার সুবাতাসেই-- বরফে সৌন্দর্যের চেয়ে বিঘ্ন বেশি। রাস্তা আটকে যায়, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়, জলের লাইনে বরফ জমে বিপর্যয় ঘটে-- ইত্যাদি। যদিও বলে দিতে হয় না, দার্জিলিং বরফের সাদা পোশাক ছাড়াও জমকালো। তার ম্যাল, ম্যালের দু'পাশের রাস্তার নজরানা, পাশ দিয়ে পুট করে নেমে যাওয়া ভুটিয়াবস্তির পথ--সেই পথে এগিয়ে যেতে যেতে মনাস্ট্রি, এই সবই… অপার এক মনোরমের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে রয়েছে সৃষ্টির সেই শুরু থেকে যেন, এমনকি যদি সাইট সিইংয়ে কোত্থাও নাও যান, তাও দার্জিলিং আপনাকে হারিয়ে যাওয়া প্রেমের মানুষের সঙ্গে চুম্বনের আনন্দ এনে দেবে। অন্তরের রূপকে দেখতে পাবেন নখদর্পণে।

আছে সেই শৈল-ঈশ্বরের টান। কাঞ্চনজঙ্ঘা যার নাম। ২৮ হাজার ১৫০ ফুট উঁচু। দার্জিলিং থেকে যার দূরত্ব ৫০ মাইল। উজ্জ্বল কাঞ্চনশৃঙ্গ শৃঙ্গ উচ্চতর। অনেকেই শুনেছি দার্জিলিংয়ে গিয়ে দেখতে পান না তাকে। মেঘের আড়ালে তিনি ঢাকা পড়ে গিয়ে ভাগ্যের আকাশে সহজে জাগরূক হন না মোটেই, হবেনই বা কেন, ঈশ্বরকে নজরাধীন করা সহজ নাকি! আমি সেই দুর্ভাগ্যের শিকার মোটেই হইনি। যাওয়ার পর দিন হোটেলের বিশাল কাচের জানালা থেকে পর্দা টানতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দু'-হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। দার্জিলিংয়ের শাসক এই শৃঙ্গ। আমি গিয়ে-ইস্তক শাসকের সামনে বার বার মাথা ঝুঁকিয়েছি। যেমন হোটেল থেকে, তেমনই কেভেন্টার্সের ছাদশূন্য খাদ্যালয়ে বসে দার্জিলিং-টি এবং পোর্ক প্ল্যাটার খেতে খেতে তাকে দেখার যে আনন্দ, আমি ভোগ করে নিয়েছি। আহা! আমার দু'চোখে তার পর থেকেই জন্মদাগ, তারা এত দিনে বোধ হয় পৃথিবীর আসল আলোটাকে চিনতে পেরেছে! চেতনা জ্ঞানত জানে, পান্নার দিকে আপনি না তাকালে পান্নাবর্ণ সবুজ হয় না, সূর্যের দিকে না তাকালে সূর্যদেব অগ্নিবর্ষণ করেন না। সে সবের ছবি দেখে, কিংবা গল্প শুনে প্রেমে পড়ার মানে দৃশ্যের সঙ্গে কিংবা দৃষ্টির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।

publive-image
দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত কেভেন্টার্স রেস্তরাঁ। ছবি- প্রতিবেদক

দার্জিলিং এককালে ছিল সিকিমের অধীন। তারও আগে ছিল নেপালের হাতে। সিকিমের বড় অংশ জবরদখল করে রেখেছিল নেপাল। ব্রিটিশরা নেপাল দেশে সেনা পাঠায় দু'বার। ১৮১৬ সালে দ্বিতীয় বার সেনা পাঠানোর পর, তারা সাড়ে চার হাজার বর্গমাইল সিকিমকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশরা কিন্তু সিকিমকে দখল না করে স্বাধীন রাজ্যের স্বীকৃতি দিয়ে নিজেদের বশবর্তী করে রেখেছিল। সেই চুক্তি হয়েছিল ১৮১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, সেগৌলিতে। কিন্তু দার্জিলিং যে ব্রিটিশদের চাই। কারণ সেখানকার আবহাওয়া তাদের বড়ই আরামের মনে হয়েছে। তো, শুরু হল সিকিম রাজার সঙ্গে দার্জিলিংয়ের ফুল তোলার জন্য আলোচনা। রাজা সিকিমপুত্তির বয়স হয়েছে। তার উপর ইংরেজের শক্তির ঝঙ্কার রয়েছে। তবুও আলোচনা হল দীর্ঘ। ইংরেজরা বলেছিল, দার্জিলিংয়ের বদলে সিকিমপুত্তি বিকল্প জমি নিন, না হয় বছর বছর টাকা গুনে নিন। তা, দ্বিতীয়টিতে রাজা রাজি হয়েছিলেন। ১৮৩৫ সালে বছরে তিন হাজার টাকা দেবার শর্তে ২৪ মাইল লম্বা এবং ৫-৬ মাইল চওড়া দার্জিলিং-ভূমি সিকিমের কাছ থেকে নিল ইংরেজরা। চুক্তিটি হয় ১৮৩৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি।

দার্জিলিংয়ের মনোরম আবহাওয়ায় স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের। তাদের রাজধানী কলকাতা থেকে কাছাকাছি এমন একটা জায়গার দরকার হয়ে পড়েছিল, যেখানে লন্ডনের শীতলতা রয়েছে, কলকাতার পেঁচাপেঁচি গরম থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, দিনে মশা, রাতে মাছির উৎপাত থেকে মুক্তি রয়েছে। দার্জিলিং তাদের হাতের কাছে সেই আনন্দ-মাখা। ফলে একটা অজগ্রাম ধীরে ধীরে সুন্দরের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠল। ক্রমে জনবসতির স্রোত এসে আছড়ালও। তবে, এসব সহজে হয়নি মোটেই। সময়, শ্রম এবং বুদ্ধির মিশেল লেগেছে এর জন্য অনেক।

১৮৪০ সালের ৮ এপ্রিল। দার্জিলিংয়ে প্রথম হোটেলের খবর জানা গেল। কলকাতার খবরের কাগজে তার সূচনার খবর প্রকাশিত হয়েছিল নিখুঁত। নাম-- দার্জিলিং হোটেল। কেক কাটা হল হোটেলের উদ্বোধনে। রকমারি খাবারের স্রোতে হল পার্টি। কিন্তু অতঃ কিম? পথ তো অগম্য, যতই পাহাড় তার রূপের বিহ্বলতা সাজিয়ে বসে থাকুক না কেন, যাবেটা কে! সকল নিয়ে বসে থাকা দার্জিলিংয়ে ১৮৪০ সালের ১৪ মে পর্যন্ত গেলেন মাত্র এক জন পর্যটক।

সেই পথ তৈরি হল ক্রমে। রেললাইন পাতা হল। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে টয়ট্রেনও চালু হল দার্জিলিংয়ে পাহাড়ের কোলে পৌঁছতে। ১৮৭৮ সালের ১৯ অগস্ট খবরের কাগজে ছাপা হল টয়ট্রেনের প্রোপোজাল-সংবাদ। খরচ ধরা হয়েছিল মাইল পিছু তিন হাজার পাউন্ড। টয়ট্রেনের প্রথম ইঞ্জিন তৈরিও হল। ১৮৭৮-এর শেষে, জামালপুর ওয়ার্কশপে, নাম-- টাইনি। টয়ট্রেনের পথ তৈরির বরাত পেয়েছিল কলকাতার সি মিটেল অ্যান্ড রামসে কোম্পানি। ধাপে ধাপে টয়ট্রেনের কাজ হতে লাগল তার পর। ১৮৮১ সালের ৮ জুলাই ছোট রেলপথটি ঝিকঝিকিয়ে পৌঁছাল দার্জিলিং।

না, এখন আর কেউ টয়ট্রেনে দার্জিলিং যান না। চার চাকার জন্তুতে সওয়ার হয়ে পৌঁছন শিখরশহরে। কিন্তু খেলনার চেয়ে কিছু বড় সেই ট্রেনে চেপে চারদিকের রূপসাগরে অরূপ পুষ্প চয়ন করে গলার হার গড়তে গড়তে দার্জিলিং যাওয়া, অনেকের লেখা পড়ে বুঝেছি, সব আলুথালু করে দেয়। তবে কড়কড়ে নোট দিয়ে পর্যটকের দল টয়ট্রেনে ঘুম পর্যন্ত জয়রাইড করেন। হতে পারে তা মাতৃদুগ্ধের বদলে ন্যান পান করার সামিল, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই যে! এখানে বলে নিই, নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং পৌঁছতে টয়ট্রেনে যেতে হয় ৮৮ কিলোমিটার। সময় লাগে ৭ ঘণ্টা।

ট্রেন থেকে নেমে ম্য়ালে পৌঁছে যাই একটু। ঘুরতে ঘুরতে মাঝ-ম্যালের ডান দিকে, সরু পথ, নেমে যেতে হয়, নেমেই যেতে হয়, আরও নামতে হয়, নামতেই হয়। যেতে যেতে যেতে যেতে তার পর দেখা হয় একটা পুরোন মনাস্ট্রির সঙ্গে। হ্যাঁ, ভুটিয়াবস্তি মনাস্ট্রি-- একেই বলে। যে ছিল আগে-- উপরে, ম্যালের পিছনে খাড়াই শিখরে, মহাকাল মন্দির যেখানে, সেইখানে। কিন্তু লামাদের ড্রামবাজানোয় ব্রিটিশরা উত্যক্ত হল, মনাস্ট্রিটাই ওখান থেকে সরিয়ে পাঠিয়ে দিল নীচে। তবে মহাকাল মন্দিরের পূজাস্থানে এখনও বুদ্ধ এবং কালী দুয়ের আরাধনাই হয়, দুই ধর্মের পুরোহিত হাজির থাকেন সেখানে, পাশাপাশি। এমনটা আর কোথাও হয় কিনা জানা নেই, হয় কি! ভুটিয়াবস্তি মনাস্ট্রি সিকিম সরকারের অধীনে, সেখান থেকেই গ্রান্ট আসে এর, এখানকার লামাসাহেবও সিকিমের বাসিন্দা।

শান্ত, নিস্তরঙ্গ মনাস্ট্রির রেলিং। দূরে, নিচুতে লেবং। উপরে কাঞ্চনজঙ্ঘা। দার্জিলিংয়ের শাসক। তুষারশুভ্র চূড়ার সাজ নিয়ে সে বলছে, নীচে কেন উপরে এসো ভাইটি, বাঁকে বাঁকে আমার রোমহর্ষক ঘুমিয়ে রয়েছে, তুমি জাগিয়ে তোলো, পথে পাহাড়ের পিঠে পিঠে কত ফুল ফুটে হয়ে রয়েছে চুপ, তুমি তুলে নাও, আমার গর্জন শান্ত করো… এসো… ধবল ধবল গিরি উচ্চ অতিশয়,/ করিতেছে সুধা পান চন্দ্রমা আলয়,… দার্জিলিং, সব কিছু ভেদ করে উপরে উঠে গিয়েছে, এই ভাবে, সবার উপরে, কুইন অফ হিলস সে, সভ্যতা আর প্রকৃতি, বিনয় আর অহং এক সঙ্গে পাশাপাশি স্রোতে দুরন্ত বেগে এখানে ফোয়ারা হয়ে উড়ন্ত, আগুনে। রং এবং সফেদ এখানে মিলে গিয়ে শিহরিত। দার্জিলিং, না এলে তোমাকে বোঝা যেত না, অপার হয়ে বসেছিলাম, দয়াময় দার্জিলিং, আমাকে পাড়ে টেনে তুলল। এত দিনে।

darjeeling
Advertisment