(রাজনীতি ও নৈতিকতা সবসময়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটে না, এমন আক্ষেপ শোনা যায় অনেকেরই মুখে। দৈনন্দিনতায়, ভাষণে, বয়ানে, চিন্তনে – ঠিক কোন কোন সময়ে সে দুইয়ের পথ আলাদা হয়ে যায়? এই কলামে সেই তফাৎ ঘটে যাওয়া মুহূর্তগুলি খুঁজছেন কৌশিক দত্ত।)
কাশীর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ অনভিজাত বঙ্গভূমি থেকে আগত এক তরুণ শাস্ত্রজ্ঞ, যাঁর আবার একটি চক্ষু রোগগ্রস্ত। লোকে বলে কানা ভট্ট। কাশীধামের সারস্বত সমাজকে অবাক করে সেই তরুণ প্রবীণ পণ্ডিতশ্রেষ্ঠকে যুক্তিজালে আচ্ছন্ন করে ফেললেন। কোণঠাসা হয়ে মেজাজ হারালেন প্রবীণ চ্যাম্পিয়ন৷ চ্যালেঞ্জারের চোখ সম্বন্ধে একটি তির্যক ইঙ্গিত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তর্কযুদ্ধের বিচারক তরুণ চ্যালেঞ্জারকে বিজয়ী ঘোষণা করে প্রাক্তন চ্যাম্পিয়নকে জানালেন, যে মুহূর্তে তিনি ব্যক্তিগত কুৎসা করেছেন, সেই মুহূর্তে তিনি স্বীকার করেছেন যে তাঁর যুক্তির ভাণ্ডার নিঃশেষিত।
ন্যায়শাস্ত্রের দেশ ভারতবর্ষে তর্ক একপ্রকার গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এবং তর্কযুদ্ধের নীতিমালা কঠোরভাবে নির্দিষ্ট। যুক্তি কেমন হবে, প্রমাণ কাকে বলা হবে, সেসব বিষয়ে এমন চর্চা এদেশে হয়েছে, যা প্রায় অতুলনীয়। বিশদ আলোচনার অবকাশ নেই, কিন্তু এটুকু এক কথায় বলা চলে যে ব্যক্তি আক্রমণ সর্বদাই "নেগেটিভ মার্কস" পাওয়ার নিশ্চিত পদ্ধতি হিসেবে গণ্য হত। আমাদের দুর্ভাগ্য, আজ সেই দেশে আমরা ব্যক্তি আক্রমণে ভর করে নির্বাচনে জেতার কথা ভাবি। আমাদের চেতনার দৈন্য আর আদর্শগত দেউলিয়াপনার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী আছে?
স্বাধীন ভারতের রাজনীতিতে ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কটূক্তি নতুন কিছু নয়। দক্ষিণ বাম নির্বিশেষে সকলেরই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যক্তি আক্রমণ সহজভাবে অন্তর্ভুক্ত। অতুল্য ঘোষ আর প্রফুল্ল সেনের নাম যাঁদের মনে আছে, তাঁরা নিশ্চয় "কানা বেগুন" আর "কাঁচকলা" ডাকদুটির সঙ্গে পরিচিত। বাঙলা সংস্কৃতির স্বর্ণযুগে শহরের পাড়ায় পাড়ায় যে প্রাক-নির্বাচনী রাজনৈতিক নাটকগুলো অভিনীত হত, তাদের শিল্প-গুণ নিয়ে প্রশ্ন নেই, কিন্তু অনেকগুলোতেই নিজেদের নীতি বা দর্শন বিষয়ক বক্তব্যের বদলে থাকত বিপক্ষের নেতাদের ক্যারিকেচার। এই পথেই এগোতে এগোতে আমরা পৌঁছেছি ২০১৯ সালে, সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ময়দানে। সেখানে যখন কান পাতলেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির চেয়েও বেশি করে শোনা যাচ্ছে চটুল রসিকতা আর গালিগালাজ, তখন "এ কী হইল" বলে আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গিমা করার কোনো মানে হয় না। আমরাই এই রাজনৈতিক বাচন পদ্ধতিকে বাড়তে দিয়েছি।
ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষ হবার পর সদ্য রামায়িত তৃণমূলের প্রাক্তনী শ্রী অর্জুন সিংহ ও অকৃত্রিম তৃণমূলী শ্রী মদন মিত্রের বাগযুদ্ধ একটি টিভি চ্যানেলে শোনার ও দেখার দুর্ভাগ্য হল। আঁচড় কামড় সহযোগে "স্ট্রিট ফাইট"-এর বাচিক উপস্থাপনা বলা চলে। একবার দেখার পর যখন ভাবি যে এঁদের মতোই কিছু মানুষ নির্বাচিত হবেন, তখন সংসদের ওপরেই বিশ্বাস টলে যায়। তা এঁরা নাহয় বদনামধারী নেতা, তথাকথিত ভদ্র উচ্চশিক্ষিত নেতাদের কাছ থেকেই বা অন্যতর কী পেলাম? সিপিআইএমের বরিষ্ঠ নেতা চিকিৎসক সূর্যকান্ত মিশ্র মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইংরেজি উচ্চারণকে বিদ্রূপ করে ভোট চাইলেন? কার ভোট চাইলেন? তরতরিয়ে ইংরেজি বলা স্যুট-টাই শোভিত সর্বহারার? যেন আর কোনো সমাজতান্ত্রিক দাবিদাওয়া ছিল না, যেন সব অর্থনৈতিক যুক্তি আর স্বপ্ন দেখানো স্লোগান ফুরিয়ে গেছে! যেন ভোটার হতে গেলে স্পষ্ট উচ্চারণে "গভর্নমেন্ট" বলতে হবে ফুটপাতবাসী বৃদ্ধকেও! তিনি বুঝলেন না যে এই মেঠো উচ্চারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি শক্তি। যে প্রান্তিক মানুষেরা কোলকাতাকেন্দ্রিক অভিজাততন্ত্রের কাছে চিরকাল "বাহিরী", তাঁরা এই রাগী, অশুদ্ধ উচ্চারণে চিৎকার করা মহিলার মধ্যে নিজেদের খুঁজে পান, তাঁকে নিজেদের প্রতিনিধি মনে করেন তিনি এরকম বলেই। অথচ কমিউনিস্ট পার্টির তো এলিট হওয়ার কথা ছিল না। এসবের বদলে "গবমেন্ট" যখন যেখানে "গোবরমেন্ট"-এর মতো কাজ করে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ, সংশোধনী প্রচেষ্টা বা প্রতিবাদ প্রতিরোধে অক্লান্ত থাকার রাজনীতি তাঁদের অনেক বেশি এগিয়ে দিতে পারত।
সূর্যবাবুর ক্ষেত্রে তাও দেখলাম সোশাল মিডিয়ার শিক্ষিত ব্যক্তিরা বেশ নিন্দা করছেন, কিন্তু কংগ্রেসের সাংসদ শ্রী অধীর চৌধুরী যে বহুদিন ধরে মুখ্যমন্ত্রীকে "উন্মাদ" বলে চলেছেন, তার প্রতিবাদ করতে প্রায় সকলেই ভুলে গেছেন। এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রের আন্দোলনকারীরাও "উন্মাদ" শব্দটির এহেন অপব্যবহারের বিরুদ্ধে তেমন সরব হননি। আসলে কংগ্রেস নেতার কাছ থেকে যেন এটাই প্রত্যাশিত ছিল। সূর্যবাবুর বাবুয়ানিটা তাঁর দলের ঘোষিত রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে বেমানান বলেই চোখে লেগেছে।
নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধীর "চৌকিদার চোর হ্যায়" স্লোগান কিছুটা অসংসদীয় হলেও ছাড় পেতে পারে এই যুক্তিতে যে মোদীবাবুই নিজেকে চৌকিদার বলে সততার প্রতীক সাজতে চেয়েছিলেন। সুতরাং সেই যোগ্যতা তাঁর আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। অসততা প্রমাণ হলে তাঁর চৌকিদারত্ব নিয়ে কথাও হতে পারে। স্লোগানটি নির্দিষ্টভাবে অর্থনৈতিক অসততা নিয়েই কথা বলে, সুতরাং চারিত্রিকভাবে রাজনৈতিক, নিছক পরনিন্দা নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে শৌচাগারের চৌকিদার বলাটা সমর্থনযোগ্য ছিল না। নিন্দনীয় ছিল ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে শ্রী মণিশঙ্কর আয়ারের "চায়েওয়ালা" বলে মোদিবাবুকে অপমান করার চেষ্টা। ধুরন্ধর নরেন্দ্র মোদী সেই বিদ্রূপকে নিজের কাজে লাগিয়েছেন চমৎকার উপায়ে। তা থেকে বাকিদের শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল যে ছুঁড়ে দেওয়া অস্ত্রটি বল্লমের বদলে বুমেরাং হতে পারে, যা ফিরে এসে শিকারীর মাথায় গাঁট্টা মারে।
মোদীসাহেব স্বয়ং যে ভাষায় কথা বলেন, তা প্রধানমন্ত্রীর মুখে বেমানান। তাঁর অনৃতভাষণের কথা ধরছি না, ব্যক্তি আক্রমণটুকুই আজকের বিবেচ্য। রাহুল গান্ধীকে "পাপ্পু" নামে তাচ্ছিল্য করে তাঁর দল। রাহুলের পিতা প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে মৃত মানুষকে অযথা অপমান না করার সামাজিক প্রথাটিরও ইতি টানলেন মোদিসাহেব। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে কংগ্রেস নেতা শশী থারুরের (প্রয়াত) স্ত্রী সুনন্দা পুষ্কর সম্বন্ধে তাঁর কটাক্ষ (পচাশ করোড় কি গার্লফ্রেন্ড) বেশি গুরুত্ব পায়নি শ্রী থারুরের স্বল্প গুরুত্বের কারণে। তাঁর দল প্রাক্তন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী সম্বন্ধে নিয়মিত কুকথা বলে থাকে।
এরকম অজস্র উদাহরণ। মহিলাদের আক্রমণ করা এক বিশেষ উপভোগ্য রাজনৈতিক কাজ অনেকের কাছেই। এটা প্রত্যাশিত। আমাদের দৈনন্দিন খিস্তিখেউড় অনেকাংশে যৌনগন্ধী। কাউকে গালি দিতে চাইলে প্রধানত তার ঘনিষ্ঠ মহিলা আত্মীয়দের সম্বন্ধে যৌন কুকথা বলাই দস্তুর। সেই সংস্কৃতিরই প্রতিনিধি আমাদের নেতা ও ভোটাররা। একদিকে তৃণমূল প্রার্থী মিমি চক্রবর্তী ও নুসরাত জাহানকে নিয়ে অজস্র মিম, অন্যদিকে বাম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে কলকাতার মেয়রের মুখে চটুল গানের কলি (কে তুমি নন্দিনী)... এ হল সবচেয়ে নিরীহ অভব্যতার নিদর্শন। বিজেপি প্রার্থী অভিনেত্রী জয়া প্রদার লাস্য ও অন্তর্বাস বিষয়ে সমাজবাদী পার্টির খান সাহেবদের একের পর এক অশ্লীল মন্তব্য, স্মৃতি ইরানির টিপের মাপ থেকে তাঁর যৌন সঙ্গীর সংখ্যা গণনার আজব গণিত পার হয়ে আম আদমি পার্টির প্রার্থী আতিশি মারলেনার চরিত্র ও জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে বিজেপির গৌতম গম্ভীরের সমর্থকদের বিলি করা অবিশ্বাস্য কুৎসিত এক লিফলেট… এভাবে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছাল এবারের ভোটের প্রচার। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের ছবিটি সেন্সর বোর্ডে আটকে যাওয়ার মত। এ আমাদের অগৌরব।
এইভাবে যাঁরা শেষ অবধি সাংসদ হবেন, তাঁদের কাছে কী প্রত্যাশা করব? যাঁরা নিজেরা ব্যক্তি আক্রমণ করেননি, তাঁরাও তো এসব কথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি, নিজের দলের নোংরা জিভ সাফ করার চেষ্টা করেননি। ভবিষ্যতে এই সংস্কৃতিকেই তাঁরা সবাই মিলে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এটাই ধরে নেওয়া যায়। এঁদের কাছে গঠনমূলক কিছু পাওয়ার প্রত্যাশাও নেই। যুক্তি আর স্বপ্ন শেষ হলেই তো নোংরামি শুরু হয়। যাঁদের নিজেদের মনে সুস্থ স্বপ্ন নেই, তাঁরা আমাদের কী দেবেন?
সূর্যবাবুর বক্তব্যকে সকলে বলছেন এলিটিজম। সেই মনোভাব থেকেই মায়াকভস্কি অনুবাদ করা মুখ্যমন্ত্রী পেতে অভ্যস্ত আমরা গত কয়েক বছর ধরে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক সমালোচনা ছেড়ে তাঁর ছড়া নিয়ে চুটকি বানিয়ে খুশি থেকেছি। মহিলাদের গালি দেওয়ার ব্যাখ্যা হল পিতৃতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষী মনোভাব। কেউ বলেন এ হল দক্ষিণপন্থী সংস্কৃতি, আবার কেউ ব্যক্তি আক্রমণকে বাম রাজনীতির অংশ বলতে চেষ্টা করেন। একটা অপকর্মের এতরকম আলাদা ব্যাখ্যা! এতরকম গালিগালাজের "সামান্য লক্ষ্মণ" হল মরিয়া হয়ে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীকে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আক্রমণ করা। কেন এমন করছেন সবাই? যখন কেউ অপরকে অবজ্ঞা করেন, আমরা তাকে আত্মম্ভরিতার প্রকাশ ভাবি। কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তির আচরণে অপরের প্রতি নীরব উপেক্ষা থাকে। এরকম হিংস্র আক্রমণ সূচিত করে আত্মবিশ্বাসের অভাবকে।
আজকের রাজনীতির প্রায় সব খেলোয়াড় আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন। তাঁরা জানেন যে মানুষের জন্য তাঁরা উল্লেখযোগ্য কিছু করেননি। জনমানসে যে শ্রদ্ধার আসন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাকে নিষ্কণ্টক করতে পারে, তাও তাঁরা অর্জন করতে পারেননি। অতএব পঙ্কে নিবাস, কাদা নিয়ে খেলাধুলো। যাঁরা নিজেদেরই ভরসা করেন না, তাঁদের ওপর কতটুকু ভরসা রাখব আমরা?