Advertisment

দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব-২১)

মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর দরজার সামনে মমতা যখন সত্যাগ্রহ করছিলেন, তখন তাঁকে সেখান থেকে সরানোর জন্য পুলিশ যে-ব্যবহার করেছিল তাও সভ্য তো নয়ই, গণতান্ত্রিকও নয়...

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধরন তা হলে কেমন হবে, সেটাও কি সেই সরকারই ঠিক করে দেবে? কোন রাস্তা দিয়ে মিছিল কদ্দুর পর্যন্ত যেতে পারবে, কোথায় মিটিং করা যাবে বা যাবে না, এগুলি কি সবই পুলিশ ঠিক করে দেবে। তা হলে তো আমাদের দাঁড়ায় সরকার বিরোধী সব আন্দোলনই পুলিশ কর্তৃক অনুমোদিত।

Advertisment

পুলিশকে এই ক্ষমতা দিয়েছে পুলিশ কোড। ব্রিটিশ আমলে। পুলিশ কোড বেশ পুরনো। ব্রিটিশ আমলেই তাতে নতুন-নতুন ধারা যুক্ত হয়েছে। আমি অন্তত জানি না কোনো ধারা কখনো বাতিল হয়েছে কী না। ব্রিটিশ আমলে দন্ডমুন্ডের কর্তা তো ছোট লাট অর্থাৎ বাংলার গভর্নর। তাঁর আদেশেই পুলিশ কোডে পুলিশের অধিকার বাড়তে থাকে, দুই অর্থেই। পুলিশের অধিকারের পরিধিও বাড়তে থাকে ও ক্ষমতার গভীরতাও বাড়তে থাকে। রবীন্দ্রনাথের দুটি-একটি গল্পে এই পুলিশি ক্ষমতার কথা আছে।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ২০)

ভারতের মত বড় দেশে, সব প্রদেশে পুলিশের অধিকার তো এক রকম হতে পারে না। এক-এক জায়গায় এক-এক ধরনের অপরাধের অধিক্য ও সেই অপরাধ দমনের জন্য পুলিশের এক-এক রকম ক্ষমতা।

১৯৪৮-এর ৪ নভেম্বর গণ পরিষদে ডক্টর আম্বেদকর খশড়া সংবিধান নিয়ে যে-সব প্রশ্ন উঠেছে, তার উত্তর দিচ্ছিলেন। সেই সময় সংবিধানের দুটি বিষয় নিয়ে কথা ওঠে। আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের যে-মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে সে-অধিকার কি সার্বভৌম, নাকি শর্তাধীন।

তার উত্তর ডক্টর আম্বেদকর আমেরিকার সংবিধানের তুলনা দিয়ে বলেন যে কোনো রাষ্ট্রে কোনো অধিকারই সার্বভৌম হতে পারে না, মৌলিক অধিকারও নয়। মৌলিক অধিকারের সুযোগ নিয়ে কেউ যদি সাধারণ জীবনযাত্রা বিঘ্নিত করতে চায় তা হলে নিশ্চয়ই তাকে তা করতে দেয়া হবে না ও প্রত্যেক রাজ্যের নিজস্ব পুলিশ বিধি (পুলিশ কোড) অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিতে পারে।

আবার, কোনো প্রশাসন যাতে নিজের খুশি মত চলতে না পারে ও নিজের পার্টিকেই স্থায়ী ভাবে ক্ষমতায় রাখার জন্য চেষ্টা না করে সেই জন্য ভারতের সংবিধানে ‘ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপ্‌লস’ বলে একটি অধ্যায় আছে। এমন অধ্যায় পৃথিবীর কোনো সংবিধানে নেই, একমাত্র আইরিশ ফ্রি স্টেটের সংবিধানে আছে।

এত ইতিহাস-ভূগোল বলতে হচ্ছে এই কারণে যে এ-রাজ্যের পুলিশ তার অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে বারবার সংবিধানের ‘ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপ্‌লস’ লঙ্ঘন করছে। শুধু এ-রাজ্যের পুলিশ নয়। সব রাজ্যের পুলিশই। মহারাষ্ট্রের পুলিশ এই ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপ্‌লস লঙ্ঘন করেই অন্ধ্র থেকে কবি ভারভারা রাওকে ও দিল্লি থেকে আরো পাঁচ জন সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবীকে গ্রেপ্তার করে। পরে, সুপ্রিম কোর্টে গ্রেপ্তারের এই পদ্ধতি নিন্দিত হয় ও তাঁদের নজরবন্দি করে রাখার আদেশ দেয়া হয়। তাঁদের জামিনের জন্য বিশিষ্ট ব্যাক্তির আবেদন নাকচ করে তৎকালীন প্রধান বিচারক মন্তব্য করেন, তিনি এঁদের সম্পর্কে উপস্থাপিত কাগজপত্র দেখে বুঝেছেন যে এদের রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠনগুলির সংযোগ আছে। সুতরাং পুলিশের কথা শুনতে হবে।

কদ্দুর পর্যন্ত শোনা হবে? সংবিধানের ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপ্‌লস অতিক্রম করেও?

ইসলামপুরে দু-ই ছাত্রের গুলিতে মৃত্যুর প্রতিবাদে এস-এফ-আই-এর মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সুকৃতি আশ। সেই মিছিলে নাকি মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর প্রাণনাশের চেষ্টার অভিযোগে পুলিশ সুকৃতিকে খুঁজতে থাকে ও শেষে হাওড়া থেকে গ্রেপ্তার করে শিলিগুড়ির মহিলা থানায় এনে রাখা হয়েছে। প্রতিবাদ ১৩ তারিখে তো হয়েছেই, ১৪ তারিখ রোববার পঞ্চমীর দিন এস-এফ-আই সারা বাংলায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছে।

পুলিশের সক্রিয়তায় অভিসন্ধি আছে। এখন সমস্ত কোর্ট পুজোর ছুটিতে বন্ধ থাকে ও সেই সময়ে মেয়েটিকে পুলিশ হাজতে রেখে শাস্তি দেওয়ার অভিসন্ধি। কারণ, পুলিশের চাইতে আর-কেউ এটা বেশি জানে না যে, যে মামলা তারা সাজিয়েছে তা একদিনের শুনানির বেশি টিঁকবে না। এই জায়গাতেই সংবিধানের ‘ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপ্‌লস’ লঙ্ঘন করছে পুলিশ। পুলিশ তার ক্ষমতা অসংবিধানিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করে মেয়েটিকে কয়েক দিনের জন্য একটু হাজত খাটাল।

হাজত থাকলেই খাটানো যায়?

আমার পরিষ্কার মনে আছে সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় ধর্মতলার মোড়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সভা করছিলেন। সেই সভায় বুদ্ধদেব বাবুর কুশপুত্তলিকা বেশ আয়োজন করে পোড়ানো হয়েছিল কিন্তু কারো বিরুদ্ধে কোনো পুলিশি ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।

একই সঙ্গে এ-কথাও উল্লেখ করতে হয়—মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর দরজার সামনে মমতা যখন সত্যাগ্রহ করছিলেন, তখন তাঁকে সেখান থেকে সরানোর জন্য পুলিশ যে-ব্যবহার করেছিল তাও সভ্য তো নয়ই, গণতান্ত্রিকও নয় ও আমাদের ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপিলসের বিরোধী।

এ লেখাটি লেখার পর খবর পেলাম পাঁচ দিন হাজত খেটে অসুস্থ হওয়ার পর আদালত থেকে ১৪ তারিখেই সুকৃতিকে জামিন দেয়া হয়েছে। তবু ভাল। কিন্তু সরকারকে তুষ্ট করতে পুলিশের এত দূর যাওয়ার সাহস হবে কেন?

দু-দুটো ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা তো সত্যি শোকাবহ। এমন মৃত্যু ঘটলে তার প্রতিবাদ হবে না? তা হলে তো বলতে হয় আমরা নিঃসাড় হয়ে যাচ্ছি। সি-আই-ডি তদন্তে কী করে আস্থা থাকবে—সি-আইডি তো পুলিশেরই একটা শাখা। আর যে বহিরাগতদের অন্তর্ঘাতের কথা উঠেছে, সেটার জন্যও তো সি-বি-আই তদন্তই ঠিক হত। পুলিশকে দিয়ে সরকার এত ভয় দেখাতে চাইছে কেন। সুকৃতির মুক্তি চাই।

west bengal politics Nirajniti Debes Ray
Advertisment