অনেকেই ভাবছেন, ভোট মানে বুঝি নাটক। তাঁদের দোষ দিই না। নাটক শব্দটা ভোটের সময়ে অনেক বার উল্লিখিত হচ্ছে। রাস্তাঘাটেও দেখা যাচ্ছে অনেক নাটকীয় ছবি। বলা হচ্ছে এসবই নাকি নাটক!
আমরা জানতুম ভোটের জন্য কিছু নাটক তৈরি করা হয়, কিন্তু ভোট ঘটনাটাই, নির্বাচন ব্যাপারটাই নাটকীয় প্রহসন হয়ে দাঁড়াল, এরকম অনেকে বলছেন।
যদিও আমি বিশ্বাস করি জীবনের যে নাটক, তা হল একটি মিথ্যেকে বা একটি অপরাধকে বা একটি অপরাধকে ঢাকার জন্য যেটা আমরা করি, যাকে লোকে দেখে বা শুনে বলে নাটক। কিন্তু মঞ্চের ওপর আমরা যেটা করি, সেটা শেষমেষ একটি সত্যকে প্রকাশ করে। আমার নিজের মত করে সত্য। সেই সত্যতে আপনি সায় দিতে পারেন, না-ও দিতে পারেন, কিন্তু সেটা একটি সত্য। মঞ্চের ওপর যেটা ঘটে অনেক বেশি সত্য, জীবনের থেকে। তাই জীবনের নাটক বলে যেটা চালানো হয়, বা বলা ভাল অবহেলা করা হয়, মঞ্চের নাটক তার থেকে আমার বিশ্বাস অনুযায়ী তা থেকে বড় কিছু। আজকে যখন নাটক হিসেবে চারপাশে এগুলো দেখি, তখন একজন নাটক-করিয়ে হিসেবে একটু আহতও বোধ করি। কিন্তু এসব নিয়েই তো আমাদের চলতে হয়, আমাদের ভাবনাগুলোকেও ওরই মধ্যে বিকশিত করতে হয়, জল দিতে হয়, তাই বলা যেতে পারে যে এই নাটকীয় অভিঘাতগুলোর মধ্যে থেকে আমরা বুঝতে চাই আমাদের সময়কে, আমাদের রাজনীতিকে, আজকের বেঁচে থাকাকে।
একসময়ে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় গণনাট্য সংঘের নির্বাচনী প্রচার নিয়ে একটা তর্ক হয়েছিল। সেই আলোচনায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন, প্রমোদ দাশগুপ্ত ছিলেন, উৎপল দত্ত বাইরে বসেছিলেন। এ লেখার ভাবনাটাকে ওখান থেকে একটু সংগ্রহ করতে চাই।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে যখন প্রস্তাব দেওয়া হয় যে নির্বাচনী প্রচারের জন্য নাটক তৈরি করতে হবে। যাকে বলে নির্বাচনী প্রচার নাটক। উৎপল দত্ত যেটায় বিশ্বাস করতেন। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বলেছিলেন, এ কথার প্রমাণও বোধহয় পাওয়া যাবে, যে উনি এই নির্বাচনী প্রচারের নাটক করবেন না। সকলে তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'কেন করবেন না!' তিনি বলেছিলেন, 'আমি বিশ্বাস করি না যে পাড়ার ওই একজন এমএলএ-কে ভেঙিয়ে, তাকে ভাঁড় বানিয়ে তা নিয়ে নাটক তৈরি করার মানে খুব একটা কিছু প্রতিবাদ করা। আমি ওটায় বিশ্বাস করি না। পলিটিক্স তার চেয়ে আরও বড় কিছু।' তখন অনেকে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলবার চেষ্টা করেছিলেন যে 'তাহলে কি আপনি ওই ভোটের দিনে গিয়ে, বুথে বসে থাকবেন বা রিক্সা করে ভোট দিতে যাবেন! তাহলে আপনি কমিউনিস্ট পার্টি করে করছেনটা কী!' তখন উনি বলেছিলেন, 'আমি পার্টির যা কাজ করার তা করব, কিন্তু আমি যে থিয়েটারটা করি, সেটা আরেকটু বেশি মানে দেয়, বড় বেশি মানে দিতে পারে, এবং আমি তাৎক্ষণিক, চটক দেওয়া বিরোধিতায় বিশ্বাস করি না।' এই কথাটার মধ্যে একটা সত্য আছে। আবার এর বিপ্রতীপে উৎপল দত্তের যুক্তি ছিল, 'আমি কমিউনিস্ট পার্টি করি, আমি বিশ্বাস করি যে পার্টিকে চোখের মণির মত রক্ষা করতে হয়, তাই আমি পার্টির সব কাজ করব, দরকার হলে পার্টির হয়ে নির্বাচনী নাটকও করব। কেননা আমরা তো একটা বিশেষ দলের বিরুদ্ধে লড়ছি, দেশকে বাঁচানোর জন্য লড়ছি।'
আমার কম বয়সে আমি মাঝে মাঝে এরকম নাটক দেখেছি রাস্তা ঘাটে হচ্ছে। সবসময়ে যে ওই নাটকগুলি আমাকে আকর্ষণ করেছে তেমনও নয়। বেশ কিছু নাটককে একবগগা মনে হয়েছে, যেটা বলছেন ওঁরা, তার সবটা সত্য নয়, আবার কিছু কিছু জিনিস মনে ধরেওছিল। এই যে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নাটক শুরু করে দিলেন কিছু লোক, কোথাও কোনও আড়াল নেই, আবডাল নেই, সোজা কথা একেবারে সোজা করে বলে দিচ্ছেন, এবং তার একটা ভঙ্গিমাও তৈরি হচ্ছে, অনেকে মিলে এক তালে এক ছন্দে গান করছে, এটা একটা দেখবার বিষয় ছিল। কিন্তু ওই জায়গাগুলো ধরে ধরে যেখানটায় ওঁরা পৌঁছে দিতেন আমাদের, একটা বিশেষ মতবাদে, বা একটা ভাবনায়, সেটা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত সংশয়ও ছিল। পরবর্তী কালে যখন আমি থিয়েটার করছি, থিয়েটারে এসে গেছি, তখন এই নির্বাচনী প্রচারের নাটক আমাকে কোনওদিনই টানেনি। বরং আমার মনে হয়েছে, নাটকে যা শক্তি, তাকে সর্বাত্মক ভাবে ওখানে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। তাই বলে স্ট্রিট থিয়েটার বা থার্ড ফর্মের থিয়েটার আমাকে আকৃষ্ট করেনি এমনটা কিন্তু নয়। বরং মারাত্মক আকর্ষণই করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তার কথা বলার ভঙ্গিমায় কোনও নির্বাচনকেন্দ্রিক বিষয় ছিল না। তাদের শৈলী তাঁদের ফর্ম সবই ভিন্ন মাত্রার। এ ধরনের এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার দেখতে আমার ভাল লেগেছে।
কিন্তু আমি য়ে প্রসিনিয়ম থিয়েটারের মানুষ হয়ে গেলাম, সেটা একটা অন্যরকম ব্যাপার। আমি বিশ্বাস করি যে মঞ্চ একটা মায়া তৈরি করে। সেই মায়াটা সবসময়েই একটু বেশি মানুষকে ছোঁয় বলে আমার মনে হয়। আমি জানি যে এ প্রসঙ্গে মানুষকে আফিং খাওয়ানো বা নেশাচ্ছন্ন করে দেওয়া উচিত কি না, সে নিয়ে বিশাল বিশাল তর্ক রয়েছে। বার্টোল্ট ব্রেখটের ধ্যানধারণা এবং স্তানিস্লাভস্কির পদ্ধতি নিয়ে বিরাট দ্বন্দ্ব আছে। পরবর্তীকালে জানতে পেরেছি যে বার্টোল্ট ব্রেখটও প্রসিনিয়ম থিয়েটারে এমন মায়াই তৈরি করেছেন, আবার সেই মায়াটাকে ভেঙেও দিচ্ছেন। আমার কাছে এইটা অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং যে মায়া বা আচ্ছন্নতা তৈরি করা, সেই আচ্ছন্নতা কিন্তু আমাকে ধরে আমার মধ্যে দিয়ে কতকগুলো শব্দকে, কতকগুলো ভাবনাকে চালান করে দিচ্ছে। সেটা এত তীব্রতার সঙ্গে করছে, এত আবেগের সঙ্গে করছে যে আমি পরে সেটা নিয়ে ভাবতেও বসছি। সেটাকে ফেলে দিচ্ছি না।
এরকম একটা পরস্পর বিরোধী ভাবনা আমার মনের মধ্যে আজও আছে। ফলত আমি প্রসিনিয়ম থিয়েটারে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। কিন্তু এ কথাও আাবর ঠিক যে আমরা প্রসিনিয়ম থিয়েটার যখন করি, তখন সেটার জন্য আমরা তো একটা মঞ্চকে ব্যবহার করি। সেই মঞ্চটা তো একটা খালি জায়গা। সেই খালি জায়গাটায় আমরা আমাদের শরীর দিয়ে, আমাদের মন দিয়ে আমাদের আবেগ দিয়ে সেই জায়গাটাকে ব্যবহার করি, সেই জায়গাটাকে পাল্টে দিই।
একটা কথা এখানে বলার। আমরা থিয়েটারে যে পাল্টানোর কথা বলি, সেখানে আমরা একটা সত্য বা একটা ভাল আর ওটা মন্দ- এরকম একটা জায়গায় পৌঁছাই। এ কাজটা ঠিক বা ওকাজটা বেঠিক, সেটা আমরা একটা গল্প দিয়ে দেখাই। আমরা বলি না, যে তোমাকে এটাই বিশ্বাস করতে হবে। দর্শক নিজের মত করে এ ব্য়াপারে সিদ্ধান্ত নেন।
এই যে পাল্টে ফেলা, থার্ড থিয়েটার ফর্মের মধ্যে বা রাস্তায় যে থিয়েটার করা হয়, সেখানেও ওই জায়গাটাকে পাল্টে দেবার খেলাই ওঁরা খেলেন। কিন্তু তবু আমার মনে হয় যে, এই যে একটা লোক দেখতে দেখতে হঠাৎ চলে গেল- কিম্বা একটি লোক মাঝপথে এসে দাঁড়াল- আমি সেই লোকটিকে সম্পূর্ণভাবে পাচ্ছি না বলেই আমার মনে হয়। যে চিন্তাটা আমি শুরু করেছি, সেই চিন্তাটা কোথায় পৌঁছচ্ছে এইটা পুরোটা দেখানোর সুযোগ পাচ্ছি না অনেক সময়ে। যদি এরমক হয় যে সবাই মিলে বসেই দেখছেন, তাহলে আমি বলব যে আমার এটা নিয়ে কোনও বিরোধ নেই।
কিন্তু বিশেষ করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যখন আমরা এই নাটকগুলি তৈরি হতে দেখেছি বা এখনও হচ্ছে, সেগুলো ভাল-মন্দ পরের কথা, আমার ওগুলো শ্লোগানের মতই লাগে। শ্লোগান, আমি জানি যে অনেক আগে এক কবি লিখেছিলেন যে আমার কবিতাগুলো শ্লোগান হয়ে গেল বলে তুমি খুব কষ্ট পেলে, কিন্তু শ্লোগানগুলো কবিতা হল না বলে তুমি কষ্ট পেলে না। আমাদের যদি সত্যিই এরকম হত যে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের শ্লোগানগুলি যদি কবিতা হত, তাহলে খুব খুশি হতাম। তেমনি শ্লোগান নাটক হবে, নাটকগুলি শ্লোগান হয়ে যাবে - এমন হলে ভাল হত। কিন্তু দুটোর মধ্যে কোথাও একটা দূরত্ব আছে, সে দূরত্বটা এত তাড়াতাড়ি আমরা চিৎকার করে ঘুচিয়ে দিতে পারব না। কিন্তু আমরা সেই দূরত্বটাকে কমাতে পারি। মাঝেমাঝে কমাইও।আমরা যখন প্রেক্ষাগৃহে নাটক করি তখন তো আমার কষ্টে যখন সামনের দর্শক কষ্ট পান, তখন তো দূরত্বটা ঘুচেই যায়। তেমনটা যে ওখানে হয় না, তা বলছি না।
এই তর্কটা চলবে। আমরা সবাই চাইব, শ্লোগান কবিতা হবে নাকি কবিতা শ্লোগান হবে, নাটক শ্লোগান হবে নাকি শ্লোগান নাটক হবে- সে নিয়ে তর্ক থাকবেই, আমরা সে নিয়ে ভাবব। আমরা আমাদের পদ্ধতিগুলো পাল্টাব, জানতে চাইব। কিন্তু যখনই আমি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিছু বলব, তখন তা আমায় কিছু কিছু ব্যাপারে বিশেষ সীমাবদ্ধতা দেবে। সে সীমাবদ্ধতা কি নাটকের জন্য জরুরি! প্রশ্নটা এইখানে।
আসলে আমরা কতকগুলি প্রশ্ন বা সিদ্ধান্তের কাছাকাছি মানুষকে পৌঁছে দিতে চাই। আর নির্বাচনের হোতারা সবসময়েই একটা এন্ড প্রোডাক্ট দিতে চান। ওঁরা বলেন, এটা পেলেই তোমার সর্বসুখ। থিয়েটারের সঙ্গে নির্বাচনের এই-ই ফারাক।