Advertisment

রবীন্দ্রনাথের নাটক ও সমসময়

রবীন্দ্র পণ্ডিতেরা হয়ত ভাল বলবেন, কিন্তু আমার মনে হয়েছে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ হলেন খোলা মন, খোলা চিন্তা, শিক্ষা এবং সে শিক্ষার শিল্পিত প্রকাশ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

আমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাটকের যে যোগাযোগ সেটা যদি ধরা যায়, তাহলে দেখতে হবে যে, বেশ কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বুক বাজিয়ে বলতে পারতাম না যে আমি রবীন্দ্রনাথের কোনও নাটকে অভিনয় করেছি। অনেক রকমের নাটক করেছি, অনুবাদ নাটক, পৌরাণিক নাটক, জীবনীমূলক নাটক, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নাটক, মানে যে নাটকগুলি পাওয়া যায় বা কোনও নাট্য়রূপ - সেরকমটা আমার ক্ষেত্রে খুব কম ঘটেছে। কিছুদিন আগে অবশ্য তেমন কিছু নাটক করেছি।

Advertisment

প্রথম যে নাটকটায় অভিনয় করেছি, সেটার নাম হচ্ছে 'গোরা', ২০১১ সালে করেছিলাম। সেই সময়কালটা - পরিবর্তন, নানাবিধ রাজনৈতিক টানাপোড়েন, এসবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ধর্ম, ইতিহাস, মূল্যবোধ, প্রেম - এই সমস্ত কথাগুলো নিয়ে সে সময়ে আলোড়ন চলছিল। যেমন ধর্ম, এ কথাটা নিয়ে আজ যেভাবে চারদিক আলোড়িত হয়, ঠিক তেমনটা না হলেও ২০১১ সালে সেটাও ছিল। সে সময়ে আভাস নামের এক নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে শেখর সমাদ্দারের নাট্যরূপে ওই কাজটা করেছিলাম, আমি গোরার ভূমিকায় অভিনয় করি। কাজটা করতে গিয়ে 'গোরা' উপন্যাসটা যখন নতুন করে পড়েছি, কখনও কখনও মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ এই কথাটা আগে বলেছেন, আবার নতুন করে বলছেন। যেন তাঁর মনে হয়েছে আগে বলে যাওয়া একই কথা এবার একটু বিস্তারে বলি।

তা ছাড়াও গোটা উপন্যাসটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। নাটকটা করে আমি খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম। যদিও উপন্য়াসটা এত বড়, যে ওটাকে দু'ঘন্টার পরিসরে ধরানো যায় না বলেই আমার বিশ্বাস। ফলে যা যা অসুবিধে হওয়ার তাই হয়েছে। কখনও কখনও দু'ঘন্টাটা আড়াই ঘন্টা হয়ে গেছে, প্রথম যখন নাটকটা শুরু হয়, তখন প্রায় তিন ঘন্টার ওপরে ছিল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তিন ঘন্টার নাটক দেখার অভ্যেস চলে গেছে লোকের। নটা বাজলেই লোকে উসখুস করেন এবং দু'ঘন্টার বেশি হলে সহ্যসীমা অতিক্রম করতে থাকে।

গোরা করার সময়েই আমি জানতে পারলাম যে সে সময়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ধর্মের যে সম্পর্ক,  সেই সম্পর্কের প্রতিফলনও কিন্তু এখানে ঘটেছে। কেউ বলেন গোরাকে রবীন্দ্রনাথ নরেনের আদলে খানিকটা গড়েছেন, কেউ বলেন শুধু নরেন নয়, নরেন, নিবেদিতা এবং অরবিন্দ ঘোষের আদলে গড়া। অরবিন্দ ঘোষের কথাটা তেমন স্পষ্ট করে কেউ বলেন না। নিবেদিতা তো তখন জগদীশ চন্দ্র বসুর কাছে যাচ্ছেন, অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন বা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও যে যোগাযোগ হচ্ছে - সেটা অনেকে বলেন যে বিবেকানন্দ নাকি ভাল চোখে দেখতেন না। তিনি মনে করতেন, নিবেদিতা যে সেবাকার্য করতে এসেছেন, এসবের ফলে তাতে ব্যাঘাত ঘটছে। এবার সে কাজটা করতে গিয়ে যখন এসব খুঁজে পাচ্ছি, তখন ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও নিজের অবস্থান ঝালিয়ে নিতে পারছি।

এই নাটকটা করার সময়ে মনে হয়েছে যে নাটকগুলি রবীন্দ্রনাথ নাটক হিসেবেই লিখেছেন, 'রক্তকরবী' বা 'রাজা' - সেগুলি এমন সব মাইলস্টোন প্রোডাকশন হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে আছে, সেগুলোর কাছে কি ফিরে যাওয়ার দরকার আছে? কিছুদিন আগে আমি 'চার অধ্যায়' করতাম। সে নাটকের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ব্রাত্য বসু, প্রযোজনা করেছিল সন্দর্ভ নামের একটি দল, পরিচালনা করেছিলেন দেবাশিস রায়। সে প্রযোজনার মধ্যে আধুনিকতা ছিল, সেট লাইটের ক্ষেত্রেও সে আধুনিকতা দৃশ্যমান ছিল। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে, এই যে উগ্রপন্থা, বিপ্লব এবং প্রেম - এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও দলদাসত্ব, এই ব্যাপারগুলোর সবকটাই 'চার অধ্যায়'-এর মধ্যে আছে - সেগুলো সবই ধরার চেষ্টা হয়েছিল এবং অভিনেতা হিসেবে এ নাটকে অভিনয় আজকের সময়টাকে বুঝতে সাহায্য করেছিল।

কিন্তু যদি আমি 'রাজা' বা 'রক্তকরবী'র কথা বলি - তাহলে আমার কীরকম একটা বোধ হয় 'রাজায়' যে কিশোরের চরিত্র বা 'ডাকঘরে' যে অমলের চরিত্র - বিশেষ করে 'রক্তকরবীর' কথা বলছি, সেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকটি চরিত্র - সে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রজ্ঞা নিয়ে কিশোর। কিশোর সেখানে রবীন্দ্রনাথের কথা বলছে। পুরোটা কিশোর বলছে না। ফলে একজন অভিনেতার কাছে এটা একটা দারুণ চ্যালেঞ্জ। আমি অবয়বে কিশোর, কিন্তু প্রজ্ঞায় রবীন্দ্রনাথ। সে যে অনুভবের কথা বলছে, তার ভাষা-শৈলী সব রবীন্দ্রনাথের। সেটা একটা দারুণ চ্যালেঞ্জ, ফলে বিফল হওয়ার বা ব্যর্থ হওয়ার একটা রাস্তাও বটে। সে কারণে অনেকে ভাষাটাকে পাল্টে নিয়েছেন, ভঙ্গিমাটাকে পাল্টে নিয়েছেন। কিন্তু মূলটাতে থেকে করতে পারলে সবচেয়ে ভাল হতো, যেটা শম্ভু মিত্র করেছেন এবং পেরেওছেন। সেটা পারার জন্য যে মেধা, অনুশীলন, শিক্ষা ও বুদ্ধি লাগে, আমার বোধহয় তার থেকে একটু কম।

আবার একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাটক কিন্তু ব্যাকরণ মানে না। মানে এ বেরিয়ে গেল, ও ওদিক দিয়ে ঢুকল - এসব স্থানকালের ব্যাকরণ নেই। তার মানে গোটা ব্যাপারটার মধ্যে একটা নৈর্ব্যক্তিক চেহারা আছে। ওর মধ্যে অ্যালিয়েনেশন, ব্রেখটের যে ধারণা, তাও আছে। সেটাকে বোঝা এবং সেই প্রযোজনাটা করা, আজকের দর্শকের সামনে যথাযথভাবে তুলে ধরা - একটা কঠিন কাজ। কিন্তু সেই শ্রমের পথে যদি হাঁটা যায়, তাহলে উপায় একটা বেরোবে বলেই আমার মনে হয়, কখনও কখনও বেরিয়েওছে। সেই দিক থেকে আমার মনে হয় যে আমাদের একটা অমনোযোগ কখনও কখনও ওই কারণেই তৈরি হয়। আবার উপন্যাস বা ছোট গল্প থেকে বেশি নাটক করার ইচ্ছে, সেটা কিন্তু একই কারণে হতে পারে।

একমাত্র রবীন্দ্রনাথ আজও মনে হয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই, সে রাজনীতি হোক কী ধর্মনীতি, সমাজনীতি, মূল্যবোধ, পারিবারিক সম্পর্ক, দাম্পত্য, সমস্ত ক্ষেত্রেই একেবারেই প্রাসঙ্গিক। একটা সংশয় হয়তো তৈরি হয় যে কোনও একটা জায়গায় উনি যেটা বলেছেন, অন্য জায়গায় তার বিরোধী কোনও কথা বলেছেন। আবার তখনই মনে হয়, এটাই তো একজন মানুষের কাজ। একটা গল্পের পরিপ্রেক্ষিতে একটা কিছু বলেছিলেন, আবার পরবর্তীকালে সেটাকেই নস্যাৎ করেছেন। রবীন্দ্র পণ্ডিতেরা হয়ত ভাল বলবেন, কিন্তু আমার মনে হয়েছে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ হলেন খোলা মন, খোলা চিন্তা, শিক্ষা এবং সে শিক্ষার শিল্পিত প্রকাশ। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে ওঁর নিজের সমসময়ে দাঁড়িয়ে সেই সব মহীরূহদের পাশে দাঁড়িয়ে ওঁর যে লড়াই, মেধার লড়াইয়ের কথা বলছি, সেটাও কিন্তু খুব আশ্চর্য ব্যাপার।

এই যে বিবেকানন্দ, ওঁর মত মেধাবী, প্রাজ্ঞ এবং আবেগপ্রবণ মানুষ তো বিরল। আমি বিবেকানন্দকে বিপ্লবীও মনে করি এক অর্থে। নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে অনেকগুলো বেড়া ভাঙতে হচ্ছিল ওঁকে। সেই মানুষটির সঙ্গে এই মানুষটির প্রথম দিকে কিন্তু বন্ধুত্ব ছিল না। দুটো আলাদা পথ দুজনের। কিন্তু ওঁদের পরস্পর বিরোধী হ্যাঁচকা টানে পরস্পরকে একটা জড়িয়ে ধরা ছিল, যে জড়িয়ে ধরাটা আমরা খোলা চোখে দেখতে পাই না। বিরোধিতাটা দেখতে পাই। কিন্তু ওঁদের পারস্পরিক আলিঙ্গনটা ছিল। যে কারণে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন ভাবে বিবেকানন্দকে স্বীকার করছেন। বিবেকানন্দ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গানই গাইছেন। সেই সময়টার মধ্যে শিক্ষা এবং ঔদার্য মানুষগুলোর মধ্যে ছিল। ছিল একটা তীব্র দহন এবং একই সঙ্গে প্রাপ্তি, ফলত এঁরা জ্বলতে জ্বলতেও পরস্পরকে মান্যতা দিতে পেরেছেন।

Mancha Theke Rabindranath Tagore
Advertisment