/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/05/IMG-20190502-WA0002.jpg)
এদেশে মেয়েদের পোশাক বিতর্ক নতুন নয়। এটাও নতুন নয়, যখনই নারী ধর্ষণ বা ইভ টিজিং-এর মতো ঘটনা ঘটেছে, একদল লোক এর জন্য মেয়েদের তথাকথিত খোলামেলা পোশাক পরার বিষয়টাকেই ধর্ষণের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে খাড়া করেছে। কিন্তু সেই সব বিতর্ক, কুযুক্তি বা নেতিবাচক রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে পিছনে ফেলে এখন খবরের শিরোনামে দিল্লি, গুরগাঁওয়ের 'সমাজ সংস্কারক আন্টি'।
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে প্রথম খবরটি জনসমক্ষে আসে। প্রবল পরিমাণে ভাইরাল হয়। তারপর মেনস্ট্রিম মিডিয়াও খবরটি প্রকাশ করে। তাই খবরের বিস্তারে না গিয়ে সংক্ষেপে বলা যায়, বুধবার গুরগাঁওয়ের এক রেস্তোরাঁয় একদল মেয়ের পোশাক নিয়ে নাকি আচমকাই হইচই শুরু করেন ওই মধ্যবয়স্ক মহিলা - "তোমাদের লজ্জা করে না, এইরকম ছোট পোশাক পরে ছেলেদের সামনে আসতে? তোমরা এটাই চাও, না, ছেলেরা লুব্ধ হোক এবং তোমাদের ধর্ষণ করুক?" হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে মহিলা যা বলেছেন, তার বাংলা তর্জমা করলে মোটামুটি এটাই দাঁড়ায়। মেয়েদের দলটি প্রতিবাদ করায় মহিলাটি রেস্তোরাঁয় উপস্থিত ছেলেদের উদ্দেশ্য করে বলেন, "তোমরা এদের ধর্ষণ করো। এটাই এদের শাস্তি!!"
রেস্তোরাঁয় শেষ হয় না নাটক। মেয়েদের দলটি শুরু থেকেই মহিলার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে। তারা ওঁকে অনুসরণ করে পার্শ্ববর্তী একটি শপিং মলে আসে এবং ক্ষমা চাইতে বলে। ক্ষমা চাওয়া বা লজ্জিত হওয়া দূরের কথা, মহিলা দ্বিগুণ উত্তেজনায় নিজের পক্ষে যুক্তি খাড়া করেন। মলে উপস্থিত আর একজন মহিলা এগিয়ে আসেন তখনই। তিনি মেয়েদের সমর্থন করেন ও বলেন 'আন্টি'র ক্ষমা চাওয়াই উচিত। এরই সঙ্গে বলেন, "আমার মেয়ে যদি এমন কোনও পোশাক পরে বাইরে যায়, যেটাতে সে স্বচ্ছন্দ, আমি তো তাকে আটকাব না। আপনি আপনার নিজের বাড়ির মেয়েদের বলুন। অন্যকে বলার আপনি কে?"
নাহ, এই যুক্তিও থামাতে পারেনি ওই 'আন্টি'কে। মলে শুরু থেকেই মেয়েদের দলটির একজন গোটা ঘটনার ভিডিও করছিল। এবার সে বলে, "আমি কিন্তু এটা ভিডিও করছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছি। দেখবেন কী হয় আপনার!!" এতে প্রবল উৎসাহে 'আন্টি', "করো। করো। এই যে পুরুষরা, আপনারা সবাই দেখছেন (এটা ক্যামেরার দিকে মুখ করে), বুঝতে পারছেন তো, এই মেয়েরা শরীর দেখানো পোশাক পরে ধর্ষিত হওয়ার জন্যই...!!"
বলা বাহুল্য, ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা মাত্রই ভাইরাল হয় এবং সোশ্যাল মিডিয়া যথানিয়মে বিভক্ত হয়ে যায়। মেয়েদের পক্ষে যেমন অনেকেই মন্তব্য করেন, উল্টোভাবে 'আন্টি'র সমর্থনেও কথা বলেন অনেকেই। এটা অবশ্য নতুন কোনও ঘটনা নয়। যে কোনও ইস্যুতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পক্ষে বা বিপক্ষে বলার লোকের অভাব হয় না। সবাই যে খুব ভেবে ও যুক্তি সহকারে মন্তব্য করেন, তাও নয়। বরং বলা ভাল, মহিলা বিষয়ক কিছু হলে, লোকজনের জিভ সুড়সুড় করে। এক্ষেত্রে যে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য চোখে পড়ে, তাও এক একটি ধর্ষণের ঘটনার অনুরূপ। মানবচরিত্র খুব পরিষ্কার ধরা পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
যাই হোক, অন্তত এই পোস্টটির ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটে। অধিকাংশ মানুষই এই ঘটনায় তীব্র ভাবে প্রতিক্রিয়া জানান। মেয়েদের ওই দলটির বন্ধুরা বা তাদের চেনাজানারা, পরে আরও ফেসবুক সদস্য একমুখী হয়ে যান। তাঁরা ওই মহিলা তাঁর স্বামীর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নিজেদের বক্তব্য জানিয়ে মন্তব্য করেন। প্রতিবাদ, সমালোচনা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ঝড় ওঠে। শেষে এই দম্পতি তাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
বিষয়টি কিন্তু নিছক এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। এ শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার ইস্যু নয়। এখানে একজন মাতৃস্থানীয় মহিলা প্রকাশ্যে, নির্ভয়ে রীতিমতো ঘোষণা করে পুরুষদের আহ্বান জানাচ্ছেন, "এসো। এইসব মেয়েদের ধর্ষণ করো, এরা তোমাদের জন্যই শরীর দেখানো পোশাক পরে!" ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মেয়েরা ও তাদের সমর্থক মহিলা যখন প্রশ্ন তুলেছেন, একটি সদ্যোজাত শিশুকন্যা, একটি বছর দুয়েকের বালিকা বা আশি বছরের বৃদ্ধা কেন ধর্ষিত হয়? জবাবে কোনও যুক্তি দেখাতে পারেন নি ওই মহান 'আন্টি'। যুক্তি তো নেই। এটা আমরা সবাই জানি। তবু, যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা হয়। তথাকথিত সমাজ সংস্কারক, যাঁরা আজকাল হঠাৎ করে খুব সক্রিয়, একটু লক্ষ্য করে দেখবেন, তাঁরাই দায়িত্ব নিয়ে মেয়েদের পোশাক-আচরণ ইত্যাদি বিষয়গুলিকে ধর্ষণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে খাড়া করেন।
কিন্তু এই 'দিল্লি আন্টি'? এঁর আচরণ কি এই সবেরই অন্তর্ভুক্ত আর একটি ঘটনা মাত্র? নাকি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না,₩₩ একেবারেই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আবার 'এমনই তো হয়ে চলেছে' বলে উড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ও নয়। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। একবার কলকাতা দূরদর্শনের একটি অনুষ্ঠানের 'মেয়েদের পোশাক' সংক্রান্ত এক আলোচনায় এক দর্শক বলেছিলেন, আপনারা, এই মিডিয়া, মেয়েদের খোলামেলা পোশাকের ছবি ছেপেই সমাজকে নষ্ট করছেন। তার উত্তরে আমি যা বলি, সেটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঘটনার উল্লেখের উদ্দেশ্য, এটা না হোক বছর কুড়ির আগের কথা। অর্থাৎ গত দু'দশকে কিচ্ছু বদলায়নি।
কে কী পোশাক পরবেন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত রুচি ও অধিকার নির্ভর। এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কার কতটা অধিকারের সীমা। গুরগাঁওয়ের ওই 'আন্টি'র কি অধিকার আছে, তাঁর পরিবারের বাইরের কোনও সদস্যকে উচিত-অনুচিতের পাঠ পড়ানোর? আর তাও ধর্ষণের মতো মারাত্মক এক অপরাধে উদ্বুদ্ধ করে! এখানেই উনি বা ওঁর মতো করে যাঁরা ভাবেন বা বলেন তাঁরা আসলে একটা অপরাধকে পরোক্ষে আমন্ত্রণ জানান। হ্যাঁ, এটা আসলে একটা অপরাধ। আরও ভালো করে বলা যায়, জ্ঞানত বা অজ্ঞানত এভাবেই এক অপরাধের পরিবেশ বা চক্র আমাদের চারপাশে তৈরি হচ্ছে।
এই 'সমাজ শুধারক আন্টি'কে যদি কোনও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়, তবে সঠিকভাবে উঠে আসবে আদতে কী ভাবেন উনি এই নারী-পুরুষ, পোশাক-আচরণবিধি ও ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গে। উনি মহিলা না পুরুষ, মা না পিসিমা, আধুনিক না প্রাচীনপন্থী - এসব অপ্রাসঙ্গিক। উনি এখানে সমাজের মুখ। উনি একটা বৃহৎ অংশের প্রতিভূ, যারা ধর্ষকের শাস্তি নয়, ধর্ষিত নারীর চরিত্র, আচরণ, জীবনযাপন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে অধিক উদ্যোগী।
এটা একটা ভয়াবহ ট্রেন্ড। এ অসুখকে মহামারীর সঙ্গে তুলনা করলে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। অপরাধ হাত-পা নয়, অপরাধ করে আমাদের মন। মেয়েরা ঘরে-বাইরে চলতে ফিরতে আশৈশব, নাকি বার্ধক্যে পৌঁছনো পর্যন্ত কতবার যে ধর্ষক-মনের মুখোমুখি হয়, সেটা যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন।
প্রতিদিন গড়ে ক'টি নারী ধর্ষনের ঘটনা ঘটে, সেই সব নারীর বয়সের রেঞ্জ, অপরাধ প্রমাণিত হয় কিনা, হলে শাস্তি পায় কিনা - এসব পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। পরিসংখ্যানে অপরাধ কমে না। কমবেও না, যতক্ষণ না মন সুস্থ হবে। গুরগাঁওয়ের এই মহিলার আচরণ আসলে এক ভয়াবহ বর্তমান ও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। এটা কোনও পরিকল্পিত চক্র কিনা, সেকথা সময়ই বলবে। তবে, সমাজ সংস্কারের নামে ইদানীং রীতিমতো পরিকল্পনা করে যেভাবে প্রগতিশীল ভাবনা ও দর্শনকে হত্যা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, এই পোশাক বিতর্ক তার রূপক হলে অবাক হব না।