একবিংশ শতাব্দী তথ্যপ্রযুক্তির, এ নিয়ে তর্ক করতে গেলেও অনলাইন হতে হবে। আমার কেনাকাটা গত শতাব্দীতেই হাট ছেড়ে পাকা বাজারে প্রবেশ করেছিল। ক্রমশ রাস্তার ধারের এলোমেলো দোকানেরা মল-বন্দী ও চকচকে হয়ে উঠতে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেই। ২০১৮ সালে মল-মুখী হওয়াও পরিশ্রমসাধ্য। স্মার্ট মানুষের স্মার্টতর ফোনের টিএফটি কাচে আঙুল ছোঁয়ালেই ওলকপি থেকে ওলাগাড়ি, পিৎজা থেকে বেনারসি, বাড়ির দরজায় হাজির। ওষুধও একপ্রকার পণ্য, যা খরিদযোগ্য। বাজারে যদি তার নাগাল মেলে, তবে বেতার জগতেই নয় কেন?
যখন মনে হচ্ছিল ডক্টর গুগল আর ফার্ম ইজি, মেডপ্লাস বা সস্তা সুন্দরের সৌজন্যে একমাত্র বাইপাস সার্জারি ছাড়া যাবতীয় চিকিৎসা একটি ল্যাপটপ বা সেল ফোনের সাহায্যে বাড়ি বা অফিসে বসেই সেরে ফেলা যাবে ব্যক্তিগত ইচ্ছানুসারে, ঠিক সেই সময় বেসুরো গাইলেন দিল্লীর উচ্চ ন্যায়ালয়।
জাহির আহমেদ নামক এক চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের আনা জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে বিচারপতি রাজেন্দ্র মোহন ও বিচারপতি ভি কে রাওয়ের বেঞ্চ রায় দিলেন, অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে অনলাইন ওষুধ বিক্রি। রায়টি গুরুত্বপূর্ণ, চমকপ্রদ এবং সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর। এই রায়ের ফলে জাঁকিয়ে বসা কিছু অনলাইন ওষুধ বিপণির বাণিজ্য ধাক্কা খাবে অন্তত সাময়িকভাবে। কিছু ক্রেতারও দু-তিন বছর ধরে তৈরি হওয়া অভ্যাস আহত হবে। কাল থেকে আমাদের ফোনে ৭০ শতাংশ অবধি অকল্পনীয় ডিসকাউন্টের বিজ্ঞাপনী এসএমএস আসবে না।
আরও পড়ুন: প্রবাসিনীর চিঠি: আমায় আবার বিয়ে করতে বোলো না
এহ বাহ্য। রায়টি আদতে আমাদের বেশ কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করালো। আবেদনকারীর পক্ষে উকিল নকুল মোহতা যে কারণগুলি দর্শিয়েছিলেন, তা প্রণিধানযোগ্য এবং আলোচনাযোগ্য।
১) ১৯৪০ সালের ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিক্স অ্যাক্ট এবং ১৯৪৮ সালের ফার্মাসি অ্যাক্ট অনুসারে ওষুধের এহেন অনলাইন বিক্রিবাটা অনুমোদিত নয়।
২) অনলাইনে ভুল, নিম্নমানের বা ভেজাল ওষুধ বিক্রির সম্ভাবনা প্রবল।
৩) নেশা করার জন্য কিছু ওষুধ অনলাইনে সহজেই কিনে ফেলা যায়।
৪) ওষুধ বস্তুটি আর পাঁচটা সাধারণ জিনিসের মতো নিরীহ নয়। তার অপব্যবহারে শরীরের গুরুতর ক্ষতি হতে পারে, যা ক্রেতা ছাড়াও অন্য মানুষের পক্ষে হানিকর হতে পারে। বিশেষত শিশু-কিশোরেরা ও স্বল্পশিক্ষিত গ্রামবাসী মানুষ অনেকেই এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। অনলাইন ওষুধ কেনার সময় এঁরা ভুলের ফাঁদে পা দিয়ে বিপদগ্রস্ত হতে পারেন। অতএব এই বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।
৫) সংবিধানের ২১ নং ধারা অনুসারে জনস্বাস্থ্য রক্ষা সরকারের দায়িত্ব, যা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছেন। ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল স্বয়ং ২০১৫ সালে রাজ্যগুলির ড্রাগ কন্ট্রোলারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, অনলাইন ওষুধ বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করে জনস্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখতে। এই নির্দেশেও কোনো কাজ হয়নি এবং লক্ষ লক্ষ ওষুধ অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে।
বাদীপক্ষের এই যুক্তিসমূহ মহামান্য আদালত মেনে নিয়েছেন। তার মানে এই নয় যে অভ্যস্ত ক্রেতা এবং বিক্রেতাও খুশি মনে তা মেনে নেবেন। আদালতের রায় সকলে মেনে নিতে বাধ্য হলেও বাদীপক্ষের যুক্তির বিরুদ্ধে তর্ক চলতেই পারে। যেমন বলা যায়, ১৯৪০ বা ১৯৪৮ সালের আইনে অনলাইন বিক্রির অনুমোদন থাকবে কী করে? তখন তো এই প্রযুক্তিগত বাস্তবতাই ছিল না! ঠিক। প্রযুক্তি ও অর্থনীতি বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছু আইন বদলানোর প্রয়োজন হতেই পারে, কিন্তু নতুন কাজ শুরু করার আগেই তার আইনগত অনুমোদনের ব্যবস্থা করে নেওয়া উচিত। যতদিন তা না করা হয়, ততদিন পূর্ববর্তী আইন লাগু থাকে এবং কাজটি বেআইনি থেকে যায়।
২, ৩, ৪ এবং ৫ নম্বর যুক্তিগুলির সারবত্তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সত্যিই এসব বিপদ হতে পারে এবং তা থেকে জনগণকে রক্ষা করার দায় সরকারের আছে। মেনে নেওয়ার পরেও প্রশ্ন করা যায়, এসব বিপদ কি দোকান থেকে ওষুধ কিনে হতে পারে না? উত্তরটা করুণ। দোকান থেকে ওষুধ কিনতে গিয়ে এমন বিপদ হওয়া উচিত নয়, কিন্তু বাস্তবে হতে পারে। ভেজাল ওষুধ, নিম্নমানের ওষুধ, ভুল নামের ওষুধ, ইত্যাদি দোকানেও পাওয়া যায়, কারণ ওষুধ প্রস্তুতি, প্যাকেজিং, সরবরাহ, সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের ওপর যে নজরদারি থাকা উচিত, তা বাস্তবে অনুপস্থিত।
ক'টা দোকানে প্রেসক্রিপশন দেখতে চায়, এমনকি অ্যান্টিবায়োটিক, হার্টের ওষুধ, মৃগীর ওষুধ বা ঘুমের ওষুধ বিক্রি করার সময়? সরকার বাহাদুর দেখার সময় পান না বলে পুরনো বাড়ির গোপন ঘরে ছাইভস্ম ক্যাপসুলে ভরে তার মোড়কে নামী কোম্পানির দামী ওষুধের নাম ছেপে দেওয়া হয়। এক্সপায়ারি তারিখ পেরোনো ওষুধের পুনর্নবীকরণ হয় সহজেই দুষ্টু তারিখকে ভ্যানিশ করে দিয়ে নতুন তারিখ মুকুলিত করার মাধ্যমে। ওষুধের দোকানের সাপ্লায়ার যদি পাঁচ পাতা সঠিক ওষুধের সঙ্গে পাঁচ পাতা ভেজাল ওষুধ মিশিয়ে দেন, তাহলে দোকানে দুটোই সম-মর্যাদায়, সম-মূল্যে বিক্রি হবে। আপনার এবারের কেনা প্রেশারের ওষুধটি যদি সেই ভেজাল পাতা হয়ে থাকে, তবে আগামী সপ্তাহে স্ট্রোক আটকায় কে?
আরও পড়ুন: সারা দেশে কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া সিপিএমের, ভোটের পর জোট, বাংলায় পদ্ম রুখতে ঘাসফুলে নয়
এই বিপদ অনলাইন ক্রয়েও হতে পারে, সম্ভবত আরেকটু বেশি মাত্রায়, কারণ সেখানে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা আরেকটু বেশি কঠিন। যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত, অথবা অনলাইন ব্যাঙ্ক তহবিল তছরুপের খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, অদৃশ্য মানুষের অনলাইন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়।
সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক ধাপ সব বিক্রেতার পঞ্জিকরণ এবং নিয়মিত তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর নজর রাখা। এই উদ্দেশ্যে ভারত সরকার ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ 'সেলস অফ ড্রাগস বাই ই-ফার্মাসি' নামক একটি খসড়া নিয়মাবলি তৈরি করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল অনথিভুক্ত (অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন বা ট্রড লাইসেন্সহীন) কেউ ই-ফার্মাসি পোর্টালের মাধ্যমে কোনো ওষুধের বিলি, বিক্রি, সঞ্চয় বা বিজ্ঞাপন করতে পারবে না।
এই বিধিকে প্রয়োগে আনার জন্য যে তথ্যপ্রযুক্তির পরিকাঠামো প্রয়োজন, তা সরকারের আছে কিনা জানা নেই। আশা করা যেতে পারে যে ব্যবসায়িক স্বার্থে নথিভুক্ত বিক্রেতারাই অনথিভুক্ত বিক্রেতাদের খবর সরকারকে জানাতে থাকবেন, কিন্তু এটা তখনই সম্ভব যখন দুই শ্রেণীর বিক্রেতাদের মধ্যের বিভাজনটা সাদা-কালো, অর্থাৎ যদি নথিভুক্ত ব্যবসায়ীদের ব্যবসার পুরোটা সফেদ হয়, বেনামে দু'নম্বর বন্দোবস্ত না থাকে। ই-ফার্মাসি আইনবলে একেবারে বন্ধ করে দিলে যেহেতু বাছ-বিচারের বালাই থাকে না, তাই সবকিছু বন্ধ করে রাখা একটু সহজ হয়।
সহজতর কাজটা এই মুহূর্তের জন্য একটি বাস্তবোচিত সমঝোতা ঠিকই, কিন্তু সেটাই চূড়ান্ত অভিপ্রেত নয়। অনলাইন ওষুধ বিক্রির কিছু ভালো দিক আছে। বয়স্ক একাকী মানুষের পক্ষে বাড়ি বসে ওষুধ পাওয়া সম্ভব হয়। তাছাড়া তিনি একটি জেনেরিক নামের অনেকগুলি ব্র্যান্ড দেখে নিয়ে সস্তা দেখে অথবা নিজের পছন্দমত কোম্পানির (যাতে তাঁর ভরসা আছে) ওষুধটি কিনতে পারেন। এতে সমগ্র বন্দোবস্তটিতে ক্রেতার ভূমিকা একটু বড় হয়, যেটা গণতান্ত্রিক। দোকান দেবার পুঁজি যাদের নেই, সেরকম কিছু ডেলিভারি বয়ের কর্মসংস্থানও হয়, যদিও দোকান মালিকদের লোকসান হতে পারে এবং তার জেরে কিছু কর্মচারীর চাকরি যেতে পারে। অর্থাৎ অনলাইন ওষুধ বিক্রির ভালো দিকগুলো কাজে লাগানো সম্ভব, যদি খারাপ দিকগুলোকে বাদ দেওয়া যায় বা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
বস্তুত নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন অতি ব্যাপক। দেশের ওষুধ বিক্রির পুরো ব্যবস্থাটাতেই অনেক বেশি কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। অনলাইনে আপনি শুধু ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল হিসেবে নিজের এক মাসের ওষুধ কিনতে পারেন তাই নয়, কিলো দরে অ্যান্টিবায়োটিক চূর্ণ কিনতে পারেন এবং তা নিয়ে নিজের মতো ক্যাপসুল বানাতে পারেন বা জলে ঢালতে পারেন। এখানে ভার্চুয়াল আর স্থূল জগতের মেলবন্ধন ঘটে।
দিল্লীতে থাকতে চাঁদনি চক বাজারে বিশাল বিশাল পলিথিনের বস্তায় ফাঁকা ক্যাপসুল বিক্রি হতে দেখেছি। এই ক্যাপসুল যে কেউ কিনতে পারেন এবং তার মধ্যে যেকোনো পদার্থ ভরে যেকোনো নামে রোগীকে গছাতে পারেন, যা সেই শহরের হাতুড়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাটির ভিত্তি। অবশ্যই এর মধ্যে আপনি প্রয়োজনীয় ওষুধ, আটা-ময়দা, নেশাদ্রব্য কোনটা ভরবেন, তা একান্তই আপনার বিবেকের ওপর নির্ভরশীল। বিবেক খুব ভালো জিনিস, কিন্তু এই বিরল বস্তুটির ওপর ভরসা না রেখে সরকারের উচিত আইন ও নজরদারির ওপর ভরসা রাখা। খাদ্য এবং ওষুধে ভেজাল দেবার ক্ষেত্রে সরকারে উচিত 'জিরো টলারেন্স' অবস্থান নেওয়া।
আরও পড়ুন: বুলন্দশহর মনে করাচ্ছে গার্ডেনরিচকে
তেমনিভাবে হারুবাবু ইন্টারনেট মারফৎ বা ওষুধ কারখানা থেক ২৫ কিলো কোলিস্টিন কিনে তাঁর খামারের মোরগদের শরীরে ইঞ্জেকশন হিসেবে দিতে পারেন বৃদ্ধি ত্বরাণ্বিত করার জন্য। মাংসের ব্যবসায় লাভ করার অধিকার তো তাঁর আছেই। কিন্তু কোলিস্টিন একটি জীবনদায়ী অ্যান্টিবায়োটিক, যা একেবারে শেষ ধাপে ব্যবহার করা হয়, অন্যান্য ওষুধ হেরে যাওয়ার পর। হারুবাবুর খামারের মোরগের মাংস খেতে খেতে আপনার শরীরের অল্প অল্প কোলিস্টিন প্রবেশ করবে বারবার। আপনার শরীরের জীবাণুরা তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। তারপর আপনি যখন অসুস্থ হবেন, তখন কোনো অ্যান্টিবায়োটিকে আর আপনার রোগ সারবে না।
অর্থাৎ জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে শুধু ওষুধের দোকান বা ই-ফার্মাসি নিয়ন্ত্রণ করলেই হবে না, ওষুধের মূল প্রস্তুতকারকদের থেকে শুরু করে মুরগী খামার, দুগ্ধ উৎপাদক, মৎস্যচাষী থেকে ধানচাষী, সকলকেই নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
আশা রাখি সরকার এবং জনগণ এই সমস্ত বিষয়েই সচেতন হবেন। কৃষি থেকে চিকিৎসা, সর্বত্র আর্থিক মুনাফাই একমাত্র ভাবনা না হয়ে জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটি প্রাধান্য পাবে। নাগরিকের বিবেক এবং সরকারের চোখ নীতিকে জীবন্ত রাখবে। সেই সুসময়ে ই-ফার্মাসি আবার ফিরে আসবে স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য হয়ে। সেই দিন যত তাড়াতাড়ি আসে, ততই ভালো।