Advertisment

দিল্লি লাইভলি: বিশ্ব বইমেলা

যখন এয়ারপোর্টে ঢুকছি তখন বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। ঢোকার মুখে ছুটতে ছুটতে গিয়ে সিকিউরিটি অফিসারকে বললাম পাখি উড়ে যাবে ভিতরে না গেলে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

আমাকে হুকুম করা হয়েছিল, ওয়র্ল্ড বুক ফেয়ার নিয়ে লিখতে। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের বিশ্ব পুস্তক মেলা। সারা শহর ছেয়ে যায় হোর্ডিং-এ হোর্ডিং-এ। তাতে লেখা থাকে এশিয়ার বৃহত্তম পুস্তক মেলা। অবশ্য লার্জেস্ট আর বিগেস্টের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সেটা বৃহত্তম দিয়ে বোঝানো যায় না বোধহয়।

Advertisment

তবে আমার ধারণা ছিল। মাঝে চার-পাঁচবার গেছি তো, তাই। আসলে প্রগতি ময়দান আকারে মিলনমেলার ডবল। তার একটা উত্তরের ব্যারাকপুরের কাছে স্টল নিলে আর একটা দক্ষিণের লক্ষ্মীকান্তপুরের কাছে নিলেই, ব্যাস! হয়ে গেল বিস্তৃততম।

এরকম একবার হ্যাণ্ডিক্র্যাফট ফেস্টিভ্যাল দেখেছিলাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। হস্তশিল্প মেলা। আইএনএ-র কাছে দিল্লি হাটে হচ্ছে। দিল্লি হাট হল শিল্পগ্রাম টাইপের ব্যাপার। সব রাজ্যের খাবার এবং হস্তশিল্প পাওয়া যায়। হস্তশিল্প আর জামাকাপড় বে-এ-এশ দাম দিয়ে। আর খাওয়া দাওয়া তো তাও হাতের মুঠোয়। তা এহেন দিল্লি হাটের মিড অনে একটা স্টল, স্কোয়ার লেগে আরও দুই। পয়েন্টে খান তিনেক, থার্ড ম্যানে আধখানা আর আম্পায়ারের টুপির উপর আরও দুটো স্টল নিয়ে চলছে হস্তশিল্প মেলা। ছেপে বের হবে বলে এর বেশি বলা ঠিক হবে না। আপনারাই বুঝে নিন এর ফলে কী হতে পারে।

তা দিল্লির ওয়র্ল্ড বুকফেয়ারটাও এরকমই। কলকাতা মেলা, জেলার মেলা এমন কি দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের বাংলা বইমেলার চোখে একে দেখতে গেলে ঠকবেন। এ হল শীতের দুপুরের পিকনিক। বই এখানে টেবিলে ছড়িয়ে রাখা আছে। অথবা ডিসপ্লেতে। খুবই কম সংখ্যক পাঠক বই আর প্রকাশক আগে থেকে জেনে এসে ঢোকেন। সাত নম্বর থেকে বারো নম্বর প্যাভিলিয়নে ছড়ানো ছেটানো দুশোর কিঞ্চিৎ অধিক স্টল। খাওয়া দাওয়ার দোকান আর এন্টারটেনমেন্টের সাজি। এই নিয়েই বইমেলা। ভিড় যদি গুনতে যান, তা মন্দ নয়। তবে তারা ক’জন সারা বছরের সঞ্চয় নিয়ে বই বগলে ফতুর হয়ে যাচ্ছে সেসব বলতে পারব না। থিম কান্ট্রি, থিম প্যাভিলিয়ন, চিল্ড্রেন্স প্যাভিলিয়ন, আদার ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাভিলিয়ন, সবই আছে। লোকও ঘুরছে সে সব জায়গায়। বাংলা ভাষায় দেখলাম পাবলিশার্স গিল্ড, পশ্চিমবঙ্গ প্রকাশনী সভা, পশ্চিমবঙ্গ প্রকাশনা ও বিক্রেতা সভা, আত্মজা প্রকাশনী এবং বিশ্বভারতী রয়েছে। ছোট্ট ছয় বাই ছয়ের স্টল নিয়ে। বাকিরা আসেই, আত্মজাকে বোধহয় এবারই দেখলাম। কে জানে, কী জেনে এসেছেন! সে থাক। দিল্লির বাঙালি বাংলা বই কিনতে বরং এপ্রিলের ১৭ থেকে ২১ গোলমার্কেটের কাছে গৃহ কল্যাণ বিভাগের কম্যুনিটি সেন্টারে আসবেন। বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের দিল্লি বইমেলা হবে। সত্তর আশিটা স্টল থাকবে এইসব আর কি!

ব্যাস এই হল বইমেলার গল্প। কিন্তু এতেই কি দিল্লি লাইভলির গল্প শেষ হচ্ছে? কদাপি নহে। গত বুধবার লাঞ্চে উপরওলার অনুমতি নিয়ে ঘন্টাখানেকের জন্য বিশ্ব পুস্তক মেলা ঘুরে এলাম। তারপর চারটে নাগাদ হঠাৎ সেক্রেটারির ডাক। আমাকে আর আমার সিনিয়র ডেপুটি সেক্রেটারিকে। গিয়ে দেখি আমাদের জয়েন্ট সেক্রেটারিও ওখানে আছেন। হুকুম হল গৌহাটি যেতে হবে! আমি বা ডেপুটি সেক্রেটারি শ্রী কমলেশ ঝেল। ঝেল সাহেব মজার মানুষ। একটা ইয়াব্বড় অ্যালসেশিয়ান পোষেন। পুরনো গাড়িটা রেখে দিয়েছেন কুকুরকে হাওয়া খাওয়াবার জন্য। কারণ তাঁর শ্রীমতী নতুন গাড়িটায় জান্তব গন্ধ অ্যালাউ করেন না। তা তাঁকে এমনিতেই পরের সপ্তাহে পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির সঙ্গে ভুবনেশ্বর কটক করতে হবে। তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমার তো এদিকে শিয়রে শমন। খোদ বাজেট সেশনের সময় কলকাতা বইমেলা। ছুটির জন্য করণ জোহরের কভি খুশি কভি গমের কখনও কাজল কখনও হৃত্বিক হতে হবে। তাই এইই সই।

কিন্তু টিকিট? বিকেল চারটের সময় সেদিনই গৌহাটি যাওয়ার সম্ভাবনা শেষ। শেষ ফ্লাইট সোয়া ছটায়। সে ধরা যাবে না। অথচ পরের দিন গৌহাটি আই আই টির কনফারেন্স উদ্বোধনে বিভাগীয় মন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত থাকতে হবে। ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম রাতের ফ্লাইটে কলকাতা এসে খুব ভোরে গৌহাটি উড়ে যাব। বয়স্ক বাবা মার সঙ্গে একবার হঠাৎ দেখাও হয়ে যাবে। আর একমাসের অক্সিজেন নিয়েও যাওয়া হবে।

সেই মতো মেল করে অপেক্ষা না করে কাছেই বামের লরি (সরকারী টিকিটিং কোম্পানি)-র কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কেটে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। স্টুডিওর ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটে। ফ্লাইট সোয়া আটটায়। বাড়ি পৌঁছতে পাঁচটা। তৈরি হয়ে বেরোতে বেরোতে পাঁচটা কুড়ি। দোষের মধ্যে শুধু ওয়েব চেকইন করতে গেছি। আইব্বাস এয়ার ইন্ডিয়ার ওয়েব সাইট কুড়ি মিনিট কাঁদুনি গেয়ে তারপর বলল, ‘পারবুনি! গিয়ে করাও!’

খাইছে। উবার বুক করে ডাক দিলাম কুড়ি মিটারের মধ্যে থাকলে আবার ম্যাপে মুভমেন্ট দেখায় না। তাকে ধরতেও গেল মিনিট পাঁচেক। শেষ মেশ ছটা বাজতে দশে চড়ে বসলাম। উবার উড়তে লাগল। ড্রাইভারকে আমার দীর্ঘ কুড়ি বছরের জ্ঞান দিতে যাচ্ছিলাম, সে ধমকে দিল, ‘বৈঠিয়ে চুপচাপ। ম্যায় আপনা নুকসান করকে আপকো জলদ সে জলদ পৌঁছা দে রহা হুঁ। হর রোজকা কাম হ্যায় মেরা।’ ভালো কথা! কিন্তু অতিরিক্ত তাচ্ছিল্যও ভালো না। গেল ব্যাটা তাজ হোটেলের কাছে ভি আই পি মুভমেন্টে ফেঁসে। যে জ্যাম ৫ মিনিটে পরিষ্কার হয় তা সরতে ২০ মিনিট।

শেষে যখন এয়ারপোর্টে ঢুকছি তখন বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। ঢোকার মুখে ছুটতে ছুটতে গিয়ে সিকিউরিটি অফিসারকে বললাম পাখি উড়ে যাবে ভিতরে না গেলে। কী বুঝল কে জানে, ছেড়ে দিল! এয়ার ইন্ডিয়া কাউন্টারে দেখলাম অদ্ভুত প্রশান্তি। আমাকে বলল ছোটাছুটির দরকার নেই, চেক ইন হয়ে গেল, এবার গেলেই হল। না নিয়ে ছাড়বে না। সে ভাল। কাঁচা চাল আর ডালের খোসা চিবিয়ে বাড়ি ঢুকলাম সাড়ে এগারোটায়। মা চিংড়ির মালাইকারি আর ভেটকির তেলঝাল করে রেখেছিলেন। আহা মমতাময়ী মা আমার। তিন ঘন্টার মধ্যে ভেটকি কোত্থেকে পেলেন কে জানে!

তা সে সব খেয়ে দেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুতে গেছি, বারোটা প্রায় বাজে। সাড়ে তিনটেয় উঠতে হবে। উই মা! এয়ার ইণ্ডিয়ার এসএমএস এল। সকালের গৌহাটির ফ্লাইট ক্যান্সেল্ড। খেয়েছে। পরের ফ্লাইট সাড়ে এগারোটায়। গেল বুঝি আমার সাড়ে নটার আগে পৌঁছনো। একদিনের সফর, ল্যাপটপ নিইনি। তাই মোবাইলেই বামের লরির ওয়েবসাইটে গিয়ে বুক করলাম ইন্ডিগোর ফ্লাইট ভোর ছটা পঞ্চাশের। ওবাবা, বলে কি না ‘বুকিং পেণ্ডিং’! ফোন করলাম কাস্টমার কেয়ারে। বলে এক ঘন্টা অপেক্ষা করুন। তখনই বাজে বারোটা কুড়ি। এক ঘন্টায় তো ভোরই হয়ে যাবে।

যা থাকে কপালে বলে ঘুমিয়ে পড়লাম, সোয়া তিনটেয় উঠে দেখি সে তখনও পেণ্ডিং। আবার ফোন লাগালাম কাস্টমার কেয়ারে, সে বলে ফ্লাইট পিছিয়ে গেছে আটটা দশ। পৌঁছবে নটা পঁচিশে। সেও ভি চলবে! বললাম। ছেলেটা ভাল, নাম করণ। সে বলল আপনাকে মেলে লিঙ্ক পাঠাচ্ছি। টিকিটের দাম ষোলশ টাকা বেড়ে গেছে। পেমেন্ট করতে গেলাম আবার ফোন। করণ! বলে আরও সতেরোশ বেড়েছে। আমি বললাম ‘ভাই টিকিট ব্লক কর! যাব তো বুঝতেই পাচ্ছ! তাহলে কেন আর ধ্বসিয়ে দিচ্ছ?’ কাজ হল শেষ মেশ দশ হাজার টাকার টিকিট কেটে গৌহাটি রওনা হলাম।

তারপর? তারপর আর কী? বাকিটা অফিসগত! তবে সারাদিন ধরে গৌহাটি শহর চষে ফেললাম, কিন্তু বনধের নামগন্ধ পেলাম না। বনধ বোধহয় পরের দুদিনের ছিল। ঐ এনআরসি নিয়েই। এবারে অহমিয়ারা খেপে গেছে। সেই, পাশাপাশি দুই ভাই থাকি অথচ শুধু ভাষা আলাদা বলে মুখ দেখাদেখি নেই। সে অনেক জটিল সমস্যা। অন্য কোনদিন অন্য কোনখানে তার গভীরে যাব। আজ আসি বরং! সকলের রবিবার ভালো কাটুক!

delhi
Advertisment