Advertisment

দিল্লি লাইভলি: প্রবাসে বাঙালি

আজ যে বাংলাকে সঠিক বলে চালাবার চেষ্টা করছি সে কিন্তু আরবি, ফারসি, ইংরাজি, পর্তুগীজ, উর্দু, হিন্দি, প্রাকৃত বা সংস্কৃত শব্দে ঋদ্ধ। তাই ভবিষ্যতের ভাষা কেমন হবে বা তার ব্যাকরণ কেমন হবে সেটা না হয় সময়ই বলে দিক?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

একটা কথা খুব শুনতে পাওয়া যায়। বিশেষত যে সব নব্য উচ্চশিক্ষিত বাঙালি সদ্য কক্ষচ্যুত হয়ে বৃত্তের বাইরে এসে পড়ে, তাদের মুখে। সেটি হল, ‘ডায়াস্পোরা সেন্টিমেন্ট’। মোদ্দা অর্থ হল, বাংলার বাইরে থাকা বাঙালি প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাংলা বাংলা করে আর আমাদের গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, কান ভরা গান, কলমভরা লেখনী এইসব করে হেদিয়ে মরে।

Advertisment

কিন্তু যদি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলেন, তবে দেখি যে অধিকাংশ বাঙালির সে হেলদোল নেই। ভাষাটাকে স্বচ্ছন্দে ভুলে গিয়ে কসমোপলিটান মানসিকতায় নিজেকে রাঙিয়ে নিতে পারলেই সে খুশি। বাঙালি চট করে রামধনু সংস্কৃতিকে ধারণ করতে পারে।

আরও পড়ুন, দিল্লি লাইভলি: দূষণ ও স্নানাগার

দিল্লি ছেড়ে দিই, যদি কলকাতার কথাই ধরি, দেখতে পাই যে সেখানকার বঙ্গসন্তানরাই ট্যাঁশ বাংলায় কথা বলতে শুরু করেছে। যদিও মনে করি প্রতিটি ভাষা প্রসার লাভ করে আহরণের মাধ্যমে। মানে আজ যে বাংলাকে সঠিক বলে চালাবার চেষ্টা করছি সে কিন্তু আরবি, ফারসি, ইংরাজি, পর্তুগীজ, উর্দু, হিন্দি, প্রাকৃত বা সংস্কৃত শব্দে ঋদ্ধ। তাই ভবিষ্যতের ভাষা কেমন হবে বা তার ব্যাকরণ কেমন হবে সেটা না হয় সময়ই বলে দিক? ভাষাটা বেঁচে থাক, তার পোশাক আশাক, আচার আচরণ বদলে গেলেও।

আপনাদের কাছে এ কলম যখন পৌঁছবে তখন দিল্লিতে বাংলার প্রায় ৪৭ জন শিল্পী, ভরা হলে ভাটিয়ালি, লোকগীতি, ভাওয়াইয়া, রায়বেঁশে, ছৌ নিয়ে কাঁপাচ্ছে। বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের হীরক জয়ন্তী বর্ষের সমাপন সমারোহে।

সে যাক, গত দু সপ্তাহের গল্প বলি। দু খেপে প্রায় আট দিন ছিলাম নৈনিতালে। না না, ঘুরতে নয়! কাজে। আর সত্যি বলতে কি, হিল স্টেশন বেড়াতে যাবার জন্য আদর্শ হতে পারে, কিন্তু কাজে গেলে? নৈব নৈব চ। সমস্তটা ওয়ান ওয়ে। পার্কিং ২০০ টাকা। একটু এগিয়ে গেলেই শিরে সংক্রান্তি। ফিরে আসতে আধ ঘন্টা। চড়াই উতরাই, উতরাই চড়াই। তার উপর পাহাড়ের ঠাণ্ডা। আইনজীবীর সঙ্গে কনফারেন্সে সোজা কথা বলা যাচ্ছে না। গলা কেঁপে কেঁপে যায়।

বছর চোদ্দ আগে, ইউপিএসসির পরীক্ষায় এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ২৬শে ডিসেম্বর, রাম ঠাণ্ডা। হাতের আঙুলগুলোই অনুভব করতে পারছি না। লিখতে গেলাম Invitation। খালি I আর n  লেখা গেল। মাঝখানে পুরো সরল রেখা। অনিল কুম্বলের লেগস্পিন। যত চেষ্টা করলাম একটুও পেন বেঁকাতে পারলাম না।

নৈনিতালেও তাই। ৩ ডিগ্রী তাপমাত্রায় রাত দশটায় গলা দিয়ে কথা নয় আর্তি বের হয়। আর সরকারি আইনজীবীর কথা? সে না হয় থাক।

তবু একটা জিনিস দেখে মন ভালো হয়ে গেল জানেন? ওই চরম ঠাণ্ডাতেও ছেলেমেয়েগুলো বাস্কেটবল কোর্টে ঘন্টা তিনেক বল বাস্কেটস্থ করতে প্রাণপণ পরিশ্রম করছে। ছেলেদের ভিড়ে দুটি মেয়েও ছিল। হয় তো শক্তিতে নয়, কিন্তু কুশলতায় কারুর থেকে কম নয়। আর ফিরে আসার দিন দেখি, পাথরকুচি দেওয়া বিশাল বড় মাঠের মতো কিছুতে ম্যাট পেতে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। প্রতিযোগিতা মূলক ক্রিকেট, দুই স্কুল দলে। বলের পালিশ কতটা থাকবে সে সব নিয়ে আলোচনা না করেও, অধ্যাবসায়ের তারিফ তো করতেই হয়।

তবে দিন আটেক পরিশ্রমে, আজকাল দিল্লিতে ফিরে এসে দেখছি সামান্য পাঁচশো মিটার দৌড়তে হাঁটু টনটন মাথা ভনভন বুক ধড়ফড় করছে না। ফিরে যেতে হবে আবার, আগামী উনিশ কুড়িতে হয়তো। যে কোর্ট কেসটা নিয়ে গেছিলাম সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদপত্রে দেরাদুনের দৃষ্টিহীনদের ইনস্টিটিউটের সমস্যা হয়তো আপনাদেরও চোখে এসেছে। তাই আর বললাম না আলাদা করে। তবে বিচার বিভাগ মাঝে মাঝে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যখন গণতন্ত্রের অন্য দুটি স্তম্ভের কাজের মধ্যে ঢুকে যায় তখন সংসদীয় ও প্রশাসনিক কার্যে কোথাও না কোথাও বড় গলতি দেখা যাচ্ছে বলে বোঝা যায়। বিচার বিভাগ, প্রশাসন এবং সংসদ এই নিয়েই তো আমাদের শাসন ব্যবস্থা। যে যার নিজের জায়গায় ঠিক থাকলে সব কিছুই ঠিক থাকে। ঠিক কি না? ঠিক ঠিক!

আর একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে আজকের লাইভলি শেষ করছি! এই দু খেপে নৈনিতাল গমন (ভ্রমণ নয়)-এর মাঝেই একটা সুযোগ এসেছিল। বেতার বিভাগের প্রণব দত্তের সৌজন্যে। দিল্লিতে ওড়িয়া ভাষায় পল্লিবাণী বলে একটি পরিচিত পত্রিকা আছে। তার একটি সাহিত্য সভায় ডাক পেলাম। মোট উনিশজন। বাংলা ভাষায় আমি, জাকির হোসেন কলেজের বাংলা অধ্যাপক মুন্সী ইউনিস এবং জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণা চক্রবর্তী। বাকীরা মূলত ওড়িয়া, ইংরাজি ও হিন্দিভাষী কবি বা গদ্যকার। একটি ছোট মেয়ে তো সংস্কৃতেও কবিতা পড়ল। সবগুলি হয়তো দারুণ কিছু না। তবে চার ঘন্টার এই অনুষ্ঠান মনের জানালা খুলে দেবার জন্য যথেষ্ট।

দিল্লিতে বসে এই সুযোগটা পাই, যেটা পশ্চিমবঙ্গে বোধহয় সম্ভব হত না। ভিন্ন ভাষাভাষী বা সংস্কৃতির আঁচ। ওই যে শুরুর দিকেই বলেছিলাম না? আহরণ করেই একটা সংস্কৃতি বা ভাষা বেঁচে থাকে। দিল্লির তথাকথিত ‘ডায়াস্পোরিক’ বাঙালি এই সুবিধাটাকে কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাষাটাকে কীভাবে বাঁচাতে পারে বা পারি সেটাই দেখার। আশা করছি হতাশ করব না। হব তো নাই!

delhi
Advertisment