Advertisment

একেই বলে শুটিং

ছেলেটির কুম্ভমেলায় যাওয়ার তাড়া থাকায়, জোড়ার সিন প্রথমে হয়ে গেল। একবার সামনে থেকে, একবার পিছন থেকে আর এক একবার করে একক ভাবে একই সিন শুট হল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
delhi lively blog

অলংকরণ- অরিত্র দে

চলচ্চিত্র বানানো মুখের কথা নয়। আর তাও যদি স্যুস্ট্রিং বাজেটের হয়। সত্যজিৎ রায় থেকে মৃণাল সেন তাবড় তাবড় চলচ্চিত্র নির্দেশক নিজের মতো করে গল্প বলতে গিয়ে কত যে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তা আর কহতব্য নয়। আর সেখানে দিল্লিতে বসে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্ম বানানো তো মঙ্গল গ্রহের কথা।

Advertisment

যে ফিল্মটার কথা বলছি সেটার নাম স্টার্ট আপ। আজ এই অবধিই, বাকি নাম ধাম সব যখন শুটিং সম্পূর্ণ হবে তখন। তা সেই ফিল্মেই অযাচিতভাবে সুযোগ জুটে গেল কলাম লেখকের, দু কলম ডায়লগ বলে দেওয়ার জন্য।

আমার শ্যুটিং-এর অভিজ্ঞতা নতুন নয়। এরও আগে এক বন্ধু একটা স্বল্প দৈর্ঘ্যের শিক্ষামূলক ছবি বানাতে গিয়ে আমাকে ডেকে নিয়েছিল। কেন জানি না তার মনে হয়েছিল আমি মঞ্চে যেরকম স্বচ্ছন্দ বোধ করি তেমনই ক্যামেরার সামনেও করব। মঞ্চে তাও বাংলায়। ক্যামেরার সামনে একটা শিক্ষামূলক বার্তা দেওয়ার জন্য বার তিনেক হিন্দি এবং ইংরাজিতে সূত্রধরের ভূমিকায় আসতে হল। আরে ইংরাজিটা যাও বা হচ্ছিল, হিন্দিটা এতটাই তৎসম শব্দের প্রভাব ছিল যে দাঁত ছরকুটে এক শা। তার উপর যে তিনটে ছোট সিচুয়েশনের অভিনয় হচ্ছিল তার অভিনেতারা টেকের পর টেক নিয়ে নিয়ে নিয়ে নিয়ে ট্রামলাইনকেও বন্ধুর বানিয়ে দিয়েছিল। মনে আছে রুটি খাওয়ার দৃশ্য এতবার টেক হয়েছিল যে রুটিটা শেষ পর্যন্ত পাঁপরভাজা হয়ে গেছিল। সকাল সাতটায় শুটিং শুরু করে পরের দিন ভোর সাড়ে পাঁচটা অবধি টানা শুটিং হয়েছিল সিঙ্কসাউন্ডে। সিঙ্ক সাউন্ডে রেকর্ডিং হয় না। সরাসরি দৃশ্যেই শব্দগৃহীত হয়। তা তাতেও হয়নি। সাতদিন পরে আবার ডেকে শুটিং করতে হয়েছিল। বন্ধুটি আর কখনও শুটিং ফ্যুটিং-এ ডাকেনি। তারপর তো নাটক করাও ছেড়ে দিলাম ২০১৩য়। লেখালিখিতে সময় দিতে হবে বলে।

সে অন্য জমানার কথা। পরে বেশ কয়েকবার এক দাদার বদান্যতায় ডাবিং করলেও শ্যুটিং করা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য তখনও দিল্লিতে তেমন কিছুই হত না আর ওয়েব সিরিজ বা ওয়েব প্ল্যাটফর্মের জন্য বানানো ফিচার ফিল্মের নামও কেউ শোনেনি। যদিও প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটি হ্যাণ্ডহেল্ড ক্যামেরায় বানানো হয়ে গেছে এবং এমেচার সিনেমা বানানোয় ধীরে ধীরে জোয়ার আসছে।

এই যে সিনেমাটার কথা বলছি, এর নির্মাতাও মুম্বইয়ের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ করে সিনেমা বানাতে চলে আসে। এবং অদ্ভুত হলেও প্রশংসনীয় যে তার বাবা মা এতে আপত্তি করেছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু ছেলে যখন একবার নেমেই পড়েছে, তখন তারাও ছেলের সঙ্গে রাস্তায় ঝাঁপ দিতে কসুর করেননি।

আমার এক বন্ধু, তাঁদের প্রতিবেশী। সেই আমায় বলে, বেশি নয়, ছোট্ট একটা রোল। নির্মাতার বাবার সঙ্গে আমি বহুদিন আগে একবার আবৃত্তি প্রতিযোগিতার বিচারক হয়েছিলাম। আমার চালিয়াতি উনি মনে রেখেছিলেন এবং উনি নাকি নিজেই আমার নাম করে বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন যে আমি করব কি না।

চিরকালই এই সব বনের মোষ বা বাইসন খেদাতে সবার আগে নাম লেখাই। এবারো ব্যতিক্রম হল না। পার্শ্ববর্তিনীও দেখি উৎসাহ দিলেন। তা এক শনিবার পোঁ করে নিজেই গাড়ি চালিয়ে হাজির হলাম নলিনী সিং-এর স্টুডিও কাম ইনস্টিটিউটে। ভদ্রলোক গান্ধী টু হিটলার বলে একটি সিনেমা সাম্প্রতিককালে বানিয়েছেন, এবং ওয়েব প্ল্যাটফর্মের জন্য সিরিজ বা ফিল্ম বানান। এই স্ক্রিপ্টটা ওঁর পছন্দ হওয়াতে এগিয়ে এসেছেন।

যা হয় আর কী, কোস্টার আসতে প্রায় তিনঘণ্টা দেরি করায় দুপুর দুটোয় শুটিং শুরু হল। তিনটে দৃশ্য, আমি এবং আমার সেই বন্ধু ইন্টারভিউকর্তা এবং তিনটে জোড়ি চাকুরীর ইন্টারভিউ দেবে। একটি সত্যিকারের জোড়া, যারা শেষে আসবে। এক জোড়া মেয়ে। তারমধ্যে একটি গ্ল্যামারাস এবং একটি সাধারণ। আর এক জোড়া ছেলে, যার মধ্যে একটি কেউকেটা রেফারেন্স মার্কা। ছেলেটির কুম্ভমেলায় যাওয়ার তাড়া থাকায়, জোড়ার সিন প্রথমে হয়ে গেল। একবার সামনে থেকে, একবার পিছন থেকে আর এক একবার করে একক ভাবে একই সিন শুট হল।

বয়ফ্রেণ্ড গার্লফ্রেণ্ড সাজতে গিয়ে উভয়েই দেখি গোলাপি জামা পরেছে। কাকতালীয়ই।

এরপর সুযোগ এলো, ওই দুটি মেয়ের। উরিবাবারে বাবা। প্রায় তিন ঘন্টা ধরে শুট হল। দুজনেরই কথা সরছে না। আর তার উপর গ্ল্যামারাস যে আছে, সে অতিরিক্ত গ্ল্যামার দেখাতে গিয়ে আরও ছড়াচ্ছে। আর অপরটি, অতিরিক্ত সাধারণ থাকতে গিয়ে অভিব্যক্তিই দিতে শিখছে না। শেষে নলিনী বাবু মেয়েটির ক্লোজআপে একবার সামনে একবার উপরে একবার নিচে একবার ডানে একবার বামে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে রেখে শুটিং শেষ করলেন।

পরেরটা অবশ্য ঝটপট হয়ে গেল। দুটি ছেলের মধ্যে একটির বাবা কোন এক কোম্পানির সিইও আর আরেকজনের বাবা ব্যাঙ্কে চাকুরী করে। এহ বাহ্য কার জন্য কোম্পানির দরজা খুলে যাবে। পরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্যান লঙশট ক্লোজআপ ইত্যাদি নিয়ে তবে শান্তি হল, ততক্ষণে স্টুডিও ফ্লোরে সাড়ে আটঘন্টা থাকা হয়ে গেছে। তারউপর একটা সামারকুল ফর্মাল পোশাক পরতে গিয়ে একটা ছোট ব্লেজারে ভয়ানক পিঠে ব্যথা হয়েছে।

মজাটা হল শেষপাতে। গ্রীনপার্কে একটি বাঙালি মিষ্টির দোকান অন্নপূর্ণা স্যুইটস আছে। যেখানে সন্দেশ, ক্ষীরকদম, গুড়ের রসগোল্লা, চমচম, জলভরা এসব মোটামুটে মূল্যে অবস্থিত। সকালে দেখে রেখে এসেছিলাম। আমার পার্শ্ববর্তিনী এবং মেয়ের আশার কথা ছিল শুটিং-এর শেষে। কোথাও একটা যাওয়ার ছিল। তা শুটিং শেষ হতে নির্মাতার বাবা সবাইকে নিয়ে বলল চল চল মিষ্টি খাওয়াই। কিন্তু সদলবলে সেথায় গিয়ে দেখি ভোঁভাঁ। অন্নপূর্ণার থলি ফুরিয়ে যাওয়ায় এদিনের মত পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলেছে তারা। তাই এ যাত্রা গড়ের মাঠ জুটল পরে কখনও সুদে আসলে পুষিয়ে নেওয়ার আশ্বাসে।

এরপর যেখানে যাওয়া হল, সেখানে গল্পচ্ছলে উঠে এলো ব্লুলাইন বাসের গল্প। বাসরে, নব্বইয়ের দশকে বিভীষিকা ছিল তারা। বায়ু ও শব্দ দূষণ এবং বিপজ্জনক চালানোর জন্য ব্লুলাইন বিখ্যাত ছিল দিল্লিতে। শিলা দীক্ষিতের বিরুদ্ধে কমনওয়েলথ গেমসের সময় যতই অভিযোগ থাকুক না কেন। পনেরো বছরের রাজত্বে ব্লুলাইন বাসের দৌরাত্ম কমিয়ে সিএনজি কমার্শিয়াল ভেহিকল চালানোর মতো একটি কাজ করার কারণে মানুষজন ওঁকে চিরটাকাল মনে রাখবে।

সেই ব্লুলাইন, যেখানে আমি একবার বসার জায়গা পেয়ে বসে, তারপর তাতে কলকাতার স্বভাব অনুযায়ী রুমাল রেখে দিল্লির স্বভাব অনুযায়ী কন্ডাক্টরের সীটে গিয়ে টিকিট কেটে ফিরে এসে দেখি এক জাঠ তনয় সযত্নে রুমালটিকে জানলার উপর রেখে ঐ সীটে বসে পড়েছে। রুমাল রেখে সীট রাখা একটি অত্যন্ত পশ্চিমবঙ্গীয় স্বভাব, দিল্লির জাঠ বুঝবে কোন ঠেলায়?

গল্প ফুরিয়ে এসেছে, রাত বাড়ছে। কিন্তু একটা কথা না বলেই পারছি না। আমি সচরাচর এসব বলি না। এক, সব ব্যাপারে সকলের মন্তব্য করা সাজে না। দুই, এবং এটাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সরকারি অধিকারী হিসাবে যেন ফেঁসে না যাই। তবুও একটা কথা না বলে পারছি না। দেশপ্রেমের বাংলা হল লাভ ফর দ্য কান্ট্রি। আর ন্যাশনাল শব্দটা জাতির সঙ্গে যুক্ত। অথচ দেশপ্রেমকে আজকাল জাতির সংকীর্ণতার মধ্যে দিয়ে দেখা হচ্ছে। এমন কি শচীন তেন্ডুলকার, নাসিরুদ্দিন শাহ বা অন্যান্য দেশকে ভালোবাসা মানুষকেও লোকে ছেড়ে কথা বলছে না।

তবু, কিছু কিছু মন্তব্যের পর মনে হয় মানুষের কোথায় থামতে হয় জানা উচিৎ। অথবা একবার অন্তত জীবনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিৎ। যা পরিস্থিতি, কে জানে, তথাকথিত জাতিপ্রেমীদের হাতে লোকজন মার খেলে বা জান খোয়ালে বোধহয় তাদের বীরের সম্মান দিতে হবে। নির্ভীক ভাবে যে যুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়াতে পারে, মারের ভয় সত্ত্বেও, তারা বোধহয় সম্মানের যোগ্য। শহিদ শুধুমাত্র সীমান্তেই হয় না। দেশের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম মানুষও সংবিধানের সার্বভৌমত্বের সম্মানে এই তকমা পেতে পারে। সম্মানের দাবিদার সেও। এদের হাতে পড়ে নেতাজীর স্লোগান বা জাতীয় সঙ্গীতটার মতো বুকের কাছাকাছি জিনিস ব্র্যাণ্ডেড বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ব্র্যাণ্ডেড বিভেদকামী শক্তির। ভালো থাকবেন। একসঙ্গে থাকবেন।

Advertisment