Advertisment

মেলা বইয়ের মেলা

সল্টলেকের বইমেলাটা মিলনমেলার তুলনায় অনেক বেশি কার্যকরী হচ্ছে। দু তিনটে কারণ থাকতে পারে। এক- সেন্ট্রাল পার্ক বেশ দূরে হওয়ার জন্য শুধুমাত্র বইপ্রেমীরাই আসেন। হুল্লোড় প্রেমীরা নন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

এই যে ফি বছর বইমেলা আসি, কারণ কী? এসব ঠিক বলে বোঝাতে পারব না আমার দিল্লির কলিগ বা সিনিয়রদের। এবারেও তো গানপয়েন্টে ছুটি নিয়ে এসেছি।

Advertisment

এমনিতে তো সমস্যা ছিল না। একটু চাপাচুপি করলে ছুটি পেয়ে যেতাম। কিন্তু গত বছর থেকে হঠাৎ করেই সরকার বাজেট অধিবেশন এগিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর ফেলবি তো ফেল বইমেলা সপ্তাহেই। ব্যাস ছুটি পাওয়া যেন বিভীষিকা হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন, বইমেলা: একটি মৃত্যুরচনা ও একটি মৃত্যুরটনা

এই অবধি শুনেই পাঠক/ পাঠিকা আপনারাই প্রশ্ন করবেন, ‘ভাই এত ঝামেলা করে আসার কী মানে?’ তা বটে। আসলে এই যে বই মেলা, মেলা বইয়ের মেলা। নতুন বইয়ের গন্ধ, সকলের সঙ্গে আড্ডা হাসি কান্না, সন্দেশ বিতরণ, ভাবের আদান প্রদান। এসবের মধ্যে আমি আমার না হওয়া জীবনটাকে বেঁচে নেবার চেষ্টা করি। বা হয়তো কখনও করে ফেলতে পারব এমন কিছু।

না না সেসব কিছু না। আসলে ভালোলাগাটাকে ডিফাইন করা যায় না বোধহয়। সঠিক অর্থে। মনে হয়, ভালো লাগে, করি। এটুকুতেই থাক। বাকি কারণ খুঁজতে যাওয়া বৃথা।

সে থাক। আমি বরং বইমেলার সাধারণ অভিজ্ঞতার কয়েকটা গল্প আর অনুধাবন আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করে নিই।

সল্টলেকের বইমেলাটা মিলনমেলার তুলনায় অনেক বেশি কার্যকরী হচ্ছে। দু তিনটে কারণ থাকতে পারে। এক- সেন্ট্রাল পার্ক বেশ দূরে হওয়ার জন্য শুধুমাত্র বইপ্রেমীরাই আসেন। হুল্লোড় প্রেমীরা নন। দুই- সেন্ট্রাল পার্কের আশেপাশে যাঁরা থাকেন বিশেষত সল্টলেক, বেলেঘাটা, নিউটাউন, দমদম, লেকটাউন, বাগুইআটি ইত্যাদি এলাকায় বইক্রেতার সংখ্যা বেশি। কিন্তু মিলনমেলার আশেপাশের বাসিন্দাদের প্রোফাইল ঠিক পাঠকের মতো নয়। কেন নয়, সেটা আপনারা ভালো বলতে পারবেন। তিন- সেন্ট্রাল পার্কে জায়গা কম থাকার দরুণ মেলা ছড়াতে পারে না। ফলে একবারে ঢুকে একজন কম বেশি সুস্থ মানুষ পুরো স্টলগুলো ঘুরে নিতে পারেন। যদিও, নতুন এবং উঠতি প্রকাশকরা বেশি জায়গা পাচ্ছেন না স্থান সংকোচনের ফলে। তবুও বলতে হবে আদতে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাঁরা লাভবানই হচ্ছেন, কিছুটা হলেও। বাদবাকি গিল্ডের সুবন্দোবস্ত নিয়ে সত্যিই অভিযোগের জায়গা কম।

তবে একটা কথা না বলে পারছি না। অবশ্য বইমেলাকে একা দায়ী করে কী করব? সারা শহরে এই সচেতনতার অভাব টের পাই। কর্মক্ষেত্রের লব্ধ জ্ঞান দিয়ে দেখতে গেলে দেখি, দৃষ্টি, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা মূক বা বধিরজনের জন্য বিশেষ সুবিধা কলকাতায় বেশ কম। নতুন লো ফ্লোর বাসগুলি ছাড়া বাকিগুলিতে বিশেষ ধরার সুবিধাও নেই। না আছে সুগম্য শৌচালয়, না বিভিন্ন বিল্ডিঙগুলিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য সুবিধা।

তাই বইমেলাতেও সুগম্য টয়লেট, হ্যান্ডরেল এবং হুইলচেয়ারের চলাফেরার সুবিধা সর্বত্র নেই। যাই হোক সব সময় নেই বললেই তো হয় না। আশা করি গিল্ড কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত শব্দের সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়ে ভবিষ্যতে সচেতন হবেন।

সে যাক বই কেনা বেচা আড্ডা ঠাট্টার মধ্যেই কত গল্প লুকিয়ে থাকে। পরাক্রমী স্ত্রী তাঁর পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোককে কি মধুর সম্ভাষণে ডাকছেন। বঙ্গভাষী ললনা তার হিন্দিভাষী সঙ্গীটিকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে প্রেমের গল্প কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কবিতার বইয়ের বিক্রয় সংখ্যা জনপ্রিয় গদ্যগ্রন্থকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ঠাণ্ডা ফিসফ্রাই আর তার থেকেও বেশি ঠাণ্ডা চা দিয়ে মহানন্দে মফস্বলের পরিবারটি সান্ধ্য ভোজন সারছে। মুক্ত মঞ্চ বা জাগো বাংলা স্টলে নেতৃর সাতাশি পেরিয়ে ভেসে আসছে বাউল গানের প্রাণ খোলা আহবান। প্লাস্টিক প্যাকেট নিয়ে এক দাড়িওলা চাচা ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘প্যাকেট লাগবে’ কি না জিজ্ঞাসা করে। গলায় প্ল্যাকার্ড লাগানো বৃদ্ধ বা ছোট গল্প বিক্রেতা বয়স্কা সকলেই এই বইয়ের মেলায় নিজেকে খুঁটে খুঁটে বেছে নিতে চায়।

ছোট্ট খাট্টো গল্পগুলো তো ফেসবুকে চলে যায়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে গল্পরা মনের মধ্যেই থেকে যায়। সেই ট্যাক্সিওলার গল্প যার ট্যাক্সির প্রথম সিটে ফেলে আসছিলাম বইয়ের ব্যাগ। দৌড়ে এসে হাতে ধরিয়ে দিল সে। করুণাময়ী বাস স্ট্যান্ড থেকে বই নিয়ে আসার সময় যখন দড়ি আলগা হয়ে পড়োপড়ো অবস্থা তখনই পুরনো বন্ধুর দেখা ধড়ে প্রাণ আনে। পুরনো বন্ধুর প্রতি সন্ধ্যায় কফি খাওয়ার জন্য আড্ডা। সারা দিনের বিকিকিনির শেষে হিসাব মেলানোর পালা। অথবা ফেবুর বন্ধুর সামনা সামনি দেখে চিনতে পারা সংকোচ ডিঙিয়ে। পাঠক পাঠিকা, এসবের জন্যই তো বারবার ফিরে আসি এই সাহিত্য মেলার কিনারে। আর মাত্র একদিন। তারপর ফিরে যাব বইমেলার শেষ দিন হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই। কিন্তু তবু সারাবছরের অক্সিজেন দিয়ে দেয় এই বইমেলা।

এবছর আবার পার্শ্ববর্তিনী এবং ছোট মেয়ে এসেছিল প্রথমবারের জন্য বইমুখী উন্মাদনার আস্বাদ নিতে। পরের বার হয়তো ছেলে আসবে। এইভাবেই হয়তো, সত্যিই হয়তো আমার ক্ষ্যাপামি তাদের মধ্যে চারিয়ে যাবে। এই আশাতেই তো বই বাঁধি।

Kolkata Book Fair
Advertisment