কয়েকদিন আগে থেকেই আমার মেয়ে দাবী করে বসেছিল যে তাকে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড দেখাতে হবে। বছর তিনেক আগে হলেও ইচ্ছে ছিল। আর সরকারী পদের সুবাদে মোটামুটি ভালো জায়গার ‘রিপাবলিক ডে’র পাস পাওয়া যায়। কিন্তু তার প্রচুর হ্যাপা। পার্শ্ববর্তিনী একবার তাঁর জার্মান বন্ধুদের নিয়ে গিয়ে নাজেহাল হয়েছিলেন। সেসব শুনে আমিও আর সাহস টাহস করি না।
ভোর চারটেয় উঠে হাজির হওয়া রাজীব চক। তারপর ট্যাঙস ট্যাঙস করে হেঁটে হেঁটে আড়াই কিমি দূরের গ্যালারিতে যাওয়া। আজকাল তো আবার নাকি জলের পাউচও নিতে দেয় না। সারা এলাকা সিল করা থাকে। হাঁ করে মাছি ঢুকিয়েও যে ক্ষুধা নিবৃত্তি করবেন তারও উপায় নেই। তারপর অনন্ত অপেক্ষা। বলে নটায়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আসতে আসতে দশটা আর তারপর মাথার উপর দিয়ে সুখোই উড়ে যেতে যেতে আরও দু ঘন্টা। তারপর আরেক ঘন্টা। খালি পেটে কি আর দেশপ্রেম হয়? জিঙ্গোইজম-টম আর জনগণের পেট ভরায় না!
আরও পড়ুন, এ সময় ওবিটের ওবিট লেখার
কিন্তু এমনটা বললে চলবে কেন? কাল যখন ইন্ডিয়া গেটের পাস দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম, তখন দেখি বিকানের হাউসের টিকিট কাউন্টারে মহম্মদ আলি পার্কের লাইন। মানুষের মনে দেশের জন্য এখনও খাঁটি সোনা আছে। তাতে কার্গিলের কারফিউ জারি হয়নি এখনও।
বেশ কিছুদিন আগে, সিনেমা হলে ‘দঙ্গল’ দেখার সময় জবরদস্তির ‘জনাগণামনা’র সময় ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াবার সময় মনে হচ্ছিল। এই যে রবি ঠাকুরের লিখে যাওয়া কবিতার প্রথম স্ট্যাঞ্জা। যার শেষ দিকের ‘তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে...’ শুনলেই মনে হয় মায়ের ডাক। যার জন্য ভরা রাজপথে দিনদহাড়ে, ট্রাফিক পুলিশের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেও স্কুটার থামিয়ে দিই। সে কবে এমন অদৃশ্য ডাণ্ডার রূপ ধারণ করল কে জানে! অথচ একই সিনেমায়, শেষে যখন ফোগট কন্যার স্বর্ণপদকের সম্মানে বেজে ওঠে সে, আপনা আপনা তসরিফের তলা থেকে সিনেমাহলের সিট সরে যায় মানুষকে দুপায়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য, শ্রদ্ধায়।
আসলে দেশপ্রেমটা একটা বেশ জটিল অনুভূতি। ব্রিটিশদের আগে তার উপস্থিতি ছিল না বলেই হয়তো, এই ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, মত, পরিধানের দেশকে একত্র রাখতে এর উদ্ভব। আর বর্তমানে তার আখর গাঁথা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কূট উদ্দেশ্যে। আর তা নিয়ে এত নিউজরিল, এত অক্সিজেন খরচ হয়ে গেছে যে আলাদা করে উল্লেখ নাই বা করলাম। আরে বাবা চাকরিটাকে রাখতে হবে তো!
তবে দেশপ্রেম বা দেশের জন্য কাজ করাকে নিয়ে আমার বাবা একবার একটা কথা বলেছিলেন, বছর পঁচিশ আগে, চেন্নাইয়ের চ্যাটার্জীনগরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। যা বোধহয় জীবনের ধ্রুবতারা হয়ে গেছে। বলেছিলেন, “যার যা কাজ তা যদি সবাই ঠিক মতো করে তাহলে কাউকে আর আলাদা করে দেশপ্রেম জাহির করতে হয় না। (পড়ুন কার্গিল পাঠাতে হয় না!)”
পাঠক/ পাঠিকা, দেশের দশ শতাংশ মানুষও যদি এটা বুঝতে পারে তাহলে সত্যিই বহু সমস্যার সমাধান হয়।
সে যা হোক, আমি বরং ওয়েদার আপডেট দিয়ে দিই। দিল্লিতে এবারের শীত পাঁকাল মাছের মতো ফসকে যেতে যেতেও বাড়ির আদুরে বেড়ালের মতো দিন চারেকের জন্য ফিরে এসেছে।
এটা গত বছরও দেখেছিলাম বটে। তখন অবশ্য ফতেপুর সিক্রির রাস্তায় ছিলাম। সে এক অভিজ্ঞতা বটে। দুই পরিবার মিলে আমার মিনি প্যাসেঞ্জার ভেহিকেলে করে আগ্রা এক্সপ্রেসওয়েতে মাঝরাস্তায় পাংচার করেও রাত নটায় সত্তর কিলোমিটার চালিয়ে ভুস করে পাংচারওয়ালার দেখা পাওয়া যেমন দৈব হস্তক্ষেপ বলে বলা যেতে পারে। তেমনই মথুরা রিফাইনারির পরেই এক কাজ চলতে থাকা ব্রিজ বেয়ে নেমে অন্ধকার গ্রামের মধ্যে নিজের হেডলাইটের গন্তব্যও পুরো দেখতে না পাওয়া কুয়াশায় শুধুমাত্র রাস্তার ধারের উপর নজর রেখে এক লেনের রাস্তায় তিরিশ কিলোমিটার চালিয়ে শেষমেশ ফতেপুর সিক্রিতে পৌঁছনোটাও নারকীয় অভিব্যক্তি ছাড়া কিছুই না।
তবে এরকম চ্যালেঞ্জ নিয়ে গাড়ি চালাতে বেশ থ্রিলিং লাগে। ভয়ানক প্রতিকূলতার মধ্যেও সমস্ত ইন্দ্রিয়কে তীক্ষ্ণ রেখে করাতের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। পরের দিন থেকে বয়স যে এক বছর কমে যায় তার আর দোষ কী। একবার জয়পুরের রাস্তায় এমন মুষলধারে বৃষ্টি নামল যে বৃষ্টির ছাঁট গাড়ির নিচে পর্যন্ত ধাক্কা মারছে। তার মধ্যেই একটা লরির পিছনে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে পঞ্চাশ মিনিট গাড়ি চালিয়ে রাত দুটোয় জয়পুরে ঢুকে পড়েছিলাম। আর তারপর কোন দৈব বলে এক সহৃদয় ব্যক্তি নিজের গন্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন দিক হলেও আমাদের সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত এক কিলোমিটার এগিয়ে যায়। তারপর ফোনে নিজের স্ত্রীকে জানায়ও যে ‘মুসাফির আয়ে হ্যায় আপনি শহর মে ভাগওয়ান। রাস্তা দিখাকে আ রহা হুঁ।’
যদিও নিজেদের রাস্তা চিনে নেবার পর এক কিমি ফিরে ভদ্রলোককে তাঁর বাড়ির রাস্তায় পৌঁছিয়ে দিই। তবুও বিদেশ বিভূঁইতে এরকম সাহায্যই বা কজন করে।
তারপর সেই ফতেপুর সিক্রি থেকে ভরতপুর যাব গত বছরের প্রজাতন্ত্র দিবসে। ভোর পাঁচটায় বেরিয়েছি। একটু এগিয়েই ফতেপুর সিক্রির পোল (বুলন্দ দরওয়াজা নয় কিন্তু!)। কিন্তু স্রেফ দেখতে পাচ্ছি না। এতটা কুয়াশা। বসে থাকলাম মিনিট কুড়ি। তারপর উদয় হল এক ব্যক্তির, অত সকালে বোধহয় ‘সন্ডাস’ উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন। তা যাই হোক। তাঁর পশ্চাদপসরণ করে বের হলাম কোন রকমে।
অবশ্য এবছরের গণতন্ত্র কাম প্রজাতন্ত্র দিবসে সেরকম কোন কুয়াশা অপেক্ষায় ছিল না। বরং ঝকঝকে সূর্য আমাদের স্বাগত জানাল। আর কালকেই একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। একটা অ্যাপার্টমেন্টের স্বাধীনতা দিবসের উৎসবে বয়স্করা কত আনন্দ নিয়ে অংশ নিচ্ছেন। আর কমবয়সীরা দূর থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার পরেও কোথাও যেন বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে।
সত্যিই, আগে বোধহয় এত জটিলতা ছিল না। নিজের দেশকে ভালবাসতে গেলে অন্য দেশকে শত্রু বানানো বা ঘৃণা করা। আদতে ঘৃণা জিনিসটাকেও কীভাবে যে সিস্টেম থেকে বার করা যায় তাই ভাবছি। শুধুমাত্র দেশ নয়। জীবনের যে কোণ ক্ষেত্রে বিরুদ্ধমতকে বুক চিতিয়ে গ্রহণ করার শিক্ষা আমরা বোধহয় ভুলতে বুঝেছি। তাই এত অসূয়া, অসহিষ্ণুতা। অথচ ভারতের মতো মহান দেশে জন্মানোটাই একটা বিস্ময় বা সত্যিই সৌভাগ্য। কিন্তু আদতে এই সৌভাগ্য আমাদের স্পর্শ করতে পারছে না, বা আমাদের অনুভূত হচ্ছে না। সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকে যে কোণ ভাবে কেটে টুকরো টুকরো করতে উদ্যত হয়ে পড়ছি।
বিশেষ দিনগুলোতে এই কথাগুলো বারবার মনে পড়ে। ইটারনাল অপ্টিমিস্ট আমি। তাই সোনার সূর্যের মধ্যেই ভবিষ্যতকে পড়ার চেষ্টা করি। হয়তো ভুল করি। কিন্তু ঠিকটাও তারই আসেপাশেই আছে। একটু খুঁজলেই কিন্তু ধরে ফেলতে পারব। আশা তো মানুষেই করে। মানুষ হয়েই না হয় বেঁচে থাকি বাকি জীবন। ভারতীয় হয়েও। প্রকৃত ভারতীয়। যার নিজস্ব আইডেনটিটি ক্রাইসিস নেই। সেই রবি ঠাকুরের কথা মতো...
দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে...!
ভালো থাকুন। জনগণতন্ত্রের আলোকে উদ্ভাসিত হোন।