Advertisment

নিজবাসে

এ শহরের হিসেব এখন পালটে যাচ্ছে। বাংলা রঞ্জি খেলার সময় ক্রিকেটাররা নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলে। দুই প্রধানে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা এক আঙুলের করে গোনা যায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

বেশ কিছুকাল আগে, যখন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ে দিনগুজরান করছি, তখন এক জয়েন্ট সেক্রেটারির ঘরে দেখি পুঁচকি একটা গণেশের বাহন ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পা তুলে চাপা দিতে গেছি, অমনি জয়েন্ট সেক্রেটারি ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করে উঠেছেন। 'কৃষ্ণের জীব'। পরে খেয়াল পড়ল, আরে ভদ্রলোক তো জৈন। জৈনরা এমনি অনেক বদনাম থাকলেও  পশুহত্যার দায়িত্ব নিতে চান না। তাই হয়তো কাউকে কাউকে দেখতে পারেন, মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ঘুরছে। দূষণ নয়, যাতে হাঁ করলে মুখে মাছি পর্যন্ত ঢুকে না যায় সেই জন্য। তা সেই ভদ্রলোকের 'হাঁ হাঁ'তে চাপ খেয়ে আমি ইঁদুরটিকে হাতে তুলে একটা বাক্সের মধ্যে রেখে তবে শান্তি।

Advertisment

কিন্তু এখানেই যে ইঁদুরকাহিনি আমার শেষ নয় সেটা ফিসফাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন। তবে ইদানীং একটু বেশিই বিব্রত হচ্ছি। গত তিন চার মাস যাবত আই পি এক্সটেনশনের যে সোসাইটি ফ্ল্যাটে উঠে এসেছি, সেটি প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শে রয়েছে। বড় রাস্তার কাছে হলেও। কিন্তু প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যাও উপস্থিত হচ্ছে। প্রথমে মশা। বর্ষার শেষভাগের মশা, চড়াইপাখির মতো বড়, বর্শার মতো বেঁধে। তাকে দূরে রাখতে নিমতেলে কর্পুর ঢেলে উপরে তা রেখে নিচে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখি মশা ধারেকাছে ঘেঁসে না। কিন্তু ওই সার, মাঝ রাতে মোম ফুরিয়ে বাতি নিভে গেলেই হামলা শুরু হয়। শেষে মুশকিল আসান করলেন আমার জননী দেবী। আসলে আমরা পলিসি ফলিসিগুলো সবই জানি, খালি কিছুটা এদিক আর ওদিক। মায়েরা সেসব করে দেন। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র এককাপ জলে তিন চারটে কর্পূরের ট্যাবলেট ফেলে ঘরে রেখে দিলেই হল। মশারা এসব সমস্যা আবার বেশিদিন সমস্যা বলে মনেই করে না। অ্যাডপ্টেবিলিটিই অনন্য। কিন্তু তদ্দিন তো সুখনিদ্রা।

বেশ চলছিল, কিন্তু বাধ সেধেছে কৃষ্ণের জীব গণেশের বাহনটি। প্রথম প্রথম ছোটখাটো ছিল। এখন দিন দুই দরজার নিচ দিয়ে ঢুকে এদিক ওদিক সেঁটে তাগড়াই হয়ে গেছে। ছোটখাটো মিনি বিড়ালের সাইজের। সে এখন সামান্য দরজায় আটকে থাকে না, মার্বেলের স্ল্যাবেও না। সেসব ঠেলে ঢুকে পড়ে। তার পিছনে ডাম্বেল রেখে খিছুটা সাইজ হয়েছে। কিন্তু তখন অন্য রাস্তা খুঁড়ে বার করেছে। প্রথমে জানলার তারজালি কেটে। তারপর দরজার কোণ, শেষে বাথরুমের নর্দমা।

লঙ্কাগুঁড়ো, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, সবরকম ইউটিউবীয় হ্যাকেও কিস্যু হয়নি। শেষে র‍্যাটকিলই ভরসা। তবে র‍্যাটকিলের সমস্যা আছে। আগের বাড়িতে যতবার দিয়েছি, হয় আমাদেরই মিটসেফে ঢুকে 'মমাৎ চ' হয়েছে। অথবা দুদিন পরেই পাশের বাড়ি থেকে শোনা গেছে 'আমা ইয়ার ইয়ে চুহা কাঁহাসে আকে মর গয়া!' মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

সে যাক, এই যে আজ বসে লিখছি আর একটু পরেই আপনারা পড়বেন। এটা কিন্তু পরবাসে লেখা হচ্ছে না। এমনিতেই কুড়ি বছরের পাথুরিয়া জিন্দেগির অক্সিজেনের জন্য মাঝে মাঝেই নিজভূমে ফিরতে হয়। এখনও তাই। দিন তিনেক, নিজস্ব কিছু কাজ। তারপরেই ব্যাস! আবার ফুড়ুৎ, সেই বইমেলায় আবার ফেরা।

তবে এই জ্যাম মাঝে সাঝে আসা। নিয়নের আলোয় একটু হেঁটে নেওয়া। শহরের একটা গান আছে, একটা প্রাণ আছে। তাকে বুকে নেওয়া। এভাবেই হয়ত বেঁচে বেঁচে থাকি।

তবে আজ দুটো ঘটনা ঘটল। মানে দেখুন দেখি, আমার আসলি শহরের চরিত্রটা বুঝতে দুটো ঘটনা আপনাদের কতটা সাহায্য করে?

দুটো নয়, তিনটে।

প্রথমে, যাদবপুর থানায়। রাস্তা পেরচ্ছি জেব্রা ক্রসিং দিয়ে। হঠাৎ উল্টোদিকের সিগনাল সবুজ হয়ে গেল। তাতে কী হয়েছে? জেব্রা ক্রসিং-এর উপর থাকা পথচারীর অধিকার সবার থেকে বেশি। যে কোন আন্তর্জাতিক ট্রাফিক আইন তাইই বলে। কিন্তু এ শহরের হিসেব এখন পালটে যাচ্ছে। বাংলা রঞ্জি খেলার সময় ক্রিকেটাররা নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলে। দুই প্রধানে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা এক আঙুলের করে গোনা যায়। খোদ কলকাতাতেই বাঙালি সংখ্যালঘু।

তা উলটো দিক থেকে সবার আগে একটা ভক্সওয়াগন পোলো এলো। আমি হাত দেখিয়ে জেব্রা ক্রস করছি। সে বেমালুম গাড়ি চালিয়ে দিল। হতবাক আমি দেখলাম আমার ডান পায়ের গোড়ালির উপর দিয়ে সাদা রঙের পোলোর কালো চাকাটা চলে গেল। লাগেনি, জানি না কী করে। তবু একটু নিচু হয়ে দেখলাম গাড়ির চালক এবং সওয়ারিদের কপালে ও গালে পান মশলার প্রভাব। নিজের শহরে এসে থেকে মন ভালো থাকে। তার উপর সক্কাল সক্কাল এক বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে দুর্দান্ত সাহিত্য চর্চা হয়েছে। ফুরফুরে মনে ছিলাম বলে কিছুই করলাম না। কিন্তু পরে মনে হল করা উচিৎ ছিল। না হলে শহরের রাস্তা ঘাট পানের পিকেই ভরে যাবে। জঞ্জালে।

দ্বিতীয় ঘটনাটা তার বেশ কিছুক্ষণ পরে। এবারে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ থেকে বাসে উঠেছি। এক চেনা মুখ বেরিয়ে পড়েছে। গল্প করছি। হঠাৎ একটি রোগামতো ছাপোষা লোক উঠা আমার সামনে দিয়েই বাসের পিছনের দিকে যেতে গেল। স্বাভাবিকভাবেই বাধা দিলাম, বললাম, 'পিছন দিয়ে যান না!' ওমা গুড়ুম করে খেপে গিয়ে ভয়ানক চিৎকার করে উঠল সে। তারপর জনে জনে ডেকে আমি কতটা অসভ্য বলতে লাগল। চেনামুখের সঙ্গে একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি ব্যাস ওইটুকুই। আবার ফিরে গেলাম বার্সিলোনা আর মোহনবাগানে। ওই যে বলে না নিজের শহর!

এবারে শেষ গল্পটা। তার বেশ কিছুক্ষণ পরে গেছোদাদার স্টাইলে কলেজস্ট্রিট থেকে বেরচ্ছি। আমার সঙ্গে আমারই এক বন্ধু। এক রিক্সাওলা, হাবেভাবে এবং কথার টানে বোঝা গেল পাশের রাজ্যের। কষ্ট করে বাংলায় জিজ্ঞাসা করল, 'বাবু এই বৈঠকখানা রোড কোথায় আছে?' আমার বন্ধু সম্পূর্ণ বেখেয়ালে তাকে উত্তর দিয়ে দিল। কিন্তু? হিন্দিতে! সে কী ভাষা ব্যবহার করেছে সেই বিষয়ে না ভেবেই। ওই যে বললাম না শহরটা বেমালুম পালটে গেছে। ভাষাটাও।

তবুও কেন যে ফিরে ফিরে আসি অক্সিজেনের সন্ধানে। আসলে আত্মাটা বোধহয় এখনও সেই অমলিন রয়ে গেছে। কুড়ি বছরের আগের সেই ছোট্ট ছেলেটার মতো। একটু পাকা চুল একটু বিজাতীয় হাবভাব। কিন্তু শহরটা তো একই রয়ে গেছে। পরশু চলে যাব। কিন্তু আপনাদের জিম্মায় রেখে যাব শহরটাকে। যত্ন নেবেন কিন্তু! নেবেন তো?

Advertisment