Advertisment

ধর্না বিবাহ না কী রাক্ষস বিবাহ!

সিঁদুরদান, ছবি তোলা, তথাকথিত স্বামীটির আলগোছে কাঁধে হাত রাখা, সমস্ত কিছুতে একটি কথাও না বলে শরীরী ভাষায় ক্রমাগত প্রত্যাখান করে গেছে এই জেদি মেয়েটি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Dhupguri Dharna Marriage

মেয়েটির শরীরী ভাষা ছিল প্রত্যাখ্যানের

আট বছরের প্রেম! আ--ট বছর! নাজিম হিকমতের অমোঘ অক্ষর তুচ্ছ করে ওরা আট বছর ধরে প্রেমের অনন্ত লিপি লিখেছিল! মনে হয়ত আশা ছিল এই প্রেমলিপিকা সত্যিই অনন্ত হবে।

Advertisment

হ্যাঁ, এই কাহিনির ছেলেমেয়ে দুটির নাম সত্যি সত্যিই অনন্ত এবং লিপিকা।

আরও পড়ুন, জলপাইগুড়ির ধর্না বিবাহ নিয়ে সোচ্চার নেট দুনিয়া

অথবা নামে কী-ই বা আসে যায়। অন্য যে কোন নামের মানুষ মানুষীর ক্ষেত্রেও কাহিনির উপসংহার একই হতো, যদি তাতে সবচেয়ে বড় শর্তটি পূরণের মালমশলা সব মজুত থাকে। সে শর্তটি হলো একটি নারীর এজেন্সি, তার সক্রিয়তা, নিজেই নিজের কর্ত্রী হয়ে উঠবার বাসনা। যাকে অস্বীকার করার প্রথা শহরে গ্রামাঞ্চলে সমান তীব্রতায় কাজ করে।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে আমি ধূপগুড়িতে সদ্য ঘটে যাওয়া রাক্ষস বিবাহটির কথা বলছি। এটি অবশ্যই একটি রাক্ষস বিবাহ, কারণ প্রাচীন শাস্ত্রানুসারে যতোরকম বিবাহ হতে পারে, তার মধ্যে রাক্ষস ও পৈশাচিক বিবাহের ভিত্তি বলপ্রয়োগ। বাৎস্যায়নের যুগে এই প্রথাগুলির সামাজিক স্বীকৃতি ছিল। দ্বিতীয়টিতে তো মাদক খাইয়ে কন্যাকে অজ্ঞান করে ধর্ষণ করবার নিদান দেওয়া ছিল। কারণ তাহলে সে আর বিবাহেচ্ছু পাত্রকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না, যতই হোক সে পৃথিবীর সবচাইতে ক্রুর ধর্ষক।

অনন্ত-লিপিকার রাক্ষস বিবাহ, কারণ বলপূর্বক এই বিবাহের তোড়জোড় চলে, কন্যাকে অপহরণও জায়েজ, শুধু পরে ব্রাহ্মণ ডাকিয়ে হোমাগ্নি সাক্ষী রেখে সিঁদুর পরালেই চলে। অনন্ত একবিংশ শতকের সন্তান, আধুনিকতা এবং নারীস্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিতি তার থেকে থাকবে হয়ত বা। তাই সে থানাপুলিশ, কোর্টকাছারি এড়িয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে প্রাক্তন প্রেমিকার  ওপর মানসিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করবার জন্য জলের বোতল ও হাতে লেখা কিছু প্ল্যাকার্ড নিয়ে লিপিকার বাড়ির সামনে অনির্দিষ্টকালের অনশনে বসে। সে প্ল্যাকার্ডে আপত্তিকর কিছু লেখা ছিল না, ছিল অনন্তের প্রাণের আকুতি, সে গত আট বছরের নষ্ট সময় ফিরে পেতে চায়, আর ছিল তাদের দুজনের ঘনিষ্ঠ মূহুর্তের দুটি ছবি। অনন্তের কাঁধের ওপর লিপিকার হাসিমুখ। খোলা চুলে সে বড় দ্যুতিময়ী।

ব্যস, তাতেই কেল্লা ফতে। মফস্বলী সমাজে ছি ছি পড়ে যায়, স্থানীয় মিডিয়া ক্যামেরায় অনন্তের লাগাতার  ইন্টারভিউ নিতে থাকে। কিছু প্রেমদিওয়ানা, হাফসোল, কিন্তু না-কামিয়াব যুবকের কাছে সে রোমিও, মজনু বা বাজ বাহাদুরের পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে রাতারাতি। শুধু কেউ খতিয়ে দেখে না, মেয়েটি ইচ্ছুক না অনিচ্ছুক।

এইভাবে কৌতূহলী মানুষজনের ভীড় বাড়তে থাকে মেয়েটির বাড়ির সামনে। তারা বেশিরভাগই অনন্তের প্রতি সহানুভূতিশীল, কারণ সবাই জানে মেয়েদের চারিত্রিক বিশৃঙ্খলা সমাজে ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিতে সক্ষম, যেমন তার ছোট পোশাক নাকি অবধারিত ডেকে আনে পৈশাচিক ধর্ষণ।

চিরকাল সমাজপতিরা নিজেরাই পিতৃতন্ত্রের ধারক ও বাহক। নারীর সক্রিয় ভূমিকা, হোক সে তার চূড়ান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে, সবসময় এদের চক্ষুশূল। এই মেয়েটি স্ব-ইচ্ছায় প্রেমসম্পর্ক গড়ে তুলেছে, স্ব-ইচ্ছায়  তা ভেঙেছে। এই স্পর্ধা সমাজ মেনে নেবে কেন? অতএব ভালবাসার জয়-এই আকাশছোঁয়া ঢক্কানিনাদের আড়ালে হারিয়ে যেতে বাধ্য একটি মেয়ের নিজের জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠবার ইচ্ছা ও সাহস। যেমন সেকালে প্রবল ঢাকের আওয়াজে হারিয়ে যেতো সতীদাহের আর্তনাদ। একটি তরতাজা হাসিখুশি তরুণীর সমস্ত ভবিষ্যত স্বপ্নে জল ঢেলে, সামাজিক বলপ্রয়োগে তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জীবনের সব চাইতে বড় সিদ্ধান্তটি নিতে বাধ্য করা হল, এই ঘটনা চিতায় জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার মতোই মর্মান্তিক।

বাদবাকি জীবন দূর মফস্বলের এই মেয়েটি এই সম্পর্কে বিষণ্ণ এবং জীবন্মৃত থাকবে, আবার চাপিয়ে দেওয়া সম্পর্ক তুচ্ছ করলে তার খারাপ মেয়ের অভিধা জুটবে, তার বাবা-মা পরিচিত হবেন এই খারাপ মেয়েটির পরিচয়ে। এক কথায়, গোটা পরিবারটির সামাজিক সম্মান ধুলোয় লুটোবে। খুব কম পরিবারই পারে এই বিপুল চাপকে অগ্রাহ্য করতে। ব্যক্তি এবং পরিবারকে কীভাবে বাইরের বলপ্রয়োগে নিঃশব্দে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ লিপিকা-অনন্ত বিবাহকথা।

কিন্তু এইসব দৃশ্যমালা কেবল প্রশ্নেরই জন্ম দিতে থাকে। কাগজে প্রায়ই দেখি, মুখ ফেরানো প্রেমিক অথবা স্বামীর বিরুদ্ধে নারী প্রতিবাদ করছে। কই অনন্তের মতো চটজলদি সমাধান কেউ পেয়েছে বলে মনে পড়ে না তো। পাওয়াটা খুব কাম্য নয় জেনেও একটা প্রশ্ন পীড়া দিতে থাকে - তাহলে প্রত্যাখ্যাত হবার লাঞ্ছনা শুধু সহজলভ্য নারীরই প্রাপ্য? সে এতই পরমুখাপেক্ষী যে কাউকে প্রত্যাখ্যান করবার স্বাধীনতাও তার থাকতে নেই? প্রেমের স্বাভাবিক গন্তব্য কি সবসময়ই বিবাহমণ্ডপ? সাহিত্যে ও জীবনে এর অহরহ অন্যথা তাহলে কীভাবে ব্যাখ্যাত হবে? লিপিকার স্বর্গজ 'পবিত্র বিবাহবন্ধনে'র প্রতি কোন দায়বদ্ধতা ছিল না, তার বিয়েই হয় নি, তাহলে তার স্ব-ইচ্ছাকে তুচ্ছ করতে হলো কেন? ঝি কে মেরে বৌকে শেখানোর মতো সমাজ কি এইভাবে  আরো পাঁচটি স্বাধীনতাকামী নারীকে সতর্কবার্তা পাঠাল ? তাহলে কাছাকাছি আসবার পর যদি দেখা যায় প্রেমিকটি নেশাসক্ত, নিষ্ঠুর এবং অন্যায়কারী, বা প্রেমিকাটি দায়িত্বজ্ঞানহীন, অমানবিক, তবুও তাদের পরস্পরের প্রতি সংলগ্ন হয়ে থাকতেই হবে? কিম্বা শুধু মেলে না বলে যে বিচ্ছেদ তাকে তো ইনকম্প্যাটিবিলিটি আখ্যা দিয়ে আইন মেনে নিয়েছে। দেশের আইনের থেকেও যেখানে বড় হয়ে ওঠে পিতৃতান্ত্রিক দেশাচার, সে দেশ বড় দুর্ভাগা নয় কি?

এখানে বিশ্বস্ত থাকার দায় নারীর, মাথা নীচু করে সমস্ত অন্যায় মেনে নেবার প্রত্যাশা নারীর কাছে, আপাদমস্তক আবৃত করে পুরুষের চিত্তবিক্ষেপ না ঘটাবার গুরুদায়িত্বও তার, এক কথায় সমস্ত অসম্ভব বোঝা চাপানো এখনো নারীর কাঁধে। হাতে কলঙ্কের আলকাতরার টিন নিয়ে লম্বা আঁকশি উঁচিয়ে অর্ধেক আকাশকে ভয় দেখাতে ব্যস্ত যে পিতৃতন্ত্র, সে কী করে নিজের অর্ধেক আকাশকে নির্মল, নীলাভ রাখবে?

এত কথা বলার হেতু এই বিবাহের ভিডিও ক্লিপিংটি। সিঁদুরদান, ছবি তোলা, তথাকথিত স্বামীটির আলগোছে কাঁধে হাত রাখা, সমস্ত কিছুতে একটি কথাও না বলে শরীরী ভাষায় ক্রমাগত প্রত্যাখান করে গেছে এই জেদি মেয়েটি। সে জানে না তার এই কুলোপানা চক্কর ভাঙার কাজে কাল থেকেই লেগে যাবে তার প্রাক্তন প্রেমিক ও বর্তমান স্বামী, আত্মীয় পরিজন এবং পাড়াপ্রতিবেশী। চাই কী পঞ্চায়েত প্রধান বা পার্টি মাতব্বরও উপদেশ বিতরণের সুযোগ ছাড়তে নারাজ হতে পারেন।

এই রৌরব নরকে বিবাহিত জীবনের সুগন্ধি পারিজাত ফোটানো ও স্বর্গীয় সুষমা ছড়িয়ে দেবার দায়িত্বও, কে না জানে, মেয়েটিরই। ধূপগুড়ির লিপিকার সেই চেষ্টা সম্ভবত অনন্ত হবে, কিন্তু সফল হবে কিনা কে জানে।

(প্রতিভা সরকার ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনার সুবাদে উত্তরবঙ্গে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন।)

Advertisment