Advertisment

ডাক্তার পেটানো? আড়ালে রাজনীতিটা বুঝুন

স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা সংক্রান্ত রাজনীতি এবং ব্যবসার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে এই অশান্তিকে নির্বিঘ্নে বাড়তে দেওয়ার ওপর।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ উসকে দেবার যে প্রক্রিয়া দুই দশকের অধিক সময় ধরে চলছে, তা ভুল করে হয়ে যাচ্ছে না, পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে

রাজ্য জুড়ে ক্রমাগত ঘটে চলা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিগ্রহের ঘটনা এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে সামগ্রিক অসন্তোষের বাতাবরণ কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা? কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করেন এটি অতি গুরুতর সামাজিক সমস্যা এবং এর প্রতিবাদে পথে নামেন। এই দলের প্রায় সকলেই চিকিৎসক। বেশীরভাগ মানুষের এ নিয়ে ভাবার ফুরসৎ নেই, এমনকি হাতে অবসর সময় থাকলেও। তাঁরা মূলত আম-নাগরিক, যাঁদের আরো অনেক কাজ এবং বিনোদন আছে। অল্প কিছু মানুষ মনে করেন, এটা সমস্যা তো নয়ই, বরং এক ধরণের সুযোগ। তাঁরা মূলত বীমা, আইন এবং রাজনীতি ক্ষেত্রের ব্যবসায়ী এবং ক্রমবর্ধমান অশান্তির সঙ্গে তাঁদের ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত। কিন্তু অশান্তির বিষয়ে শান্তিরক্ষকদের মনোভাব কী?

Advertisment

আপাতত আরেকটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা কি আদৌ ঘটে? দেশে বা রাজ্যে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে কিনা, এই প্রশ্ন করলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সরকার প্রায়শ নানারকম গল্প ফেঁদে অনাহারে মৃত্যুর কথা অস্বীকার করতে চেষ্টা করেন, কারণ তাঁরা অনাহার বা অপুষ্টি দূর করার দায়িত্ব নিতে চান না এবং দায়িত্ব এড়ানোর সহজতম উপায় হল সমস্যার অস্তিত্ব অস্বীকার করা। তেমনি শান্তিরক্ষার দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার সহজ উপায় অশান্তির অস্তিত্ব অস্বীকার করা। মজাটা হলো, এক্ষেত্রে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী চিকিৎসক নিগ্রহের কথা অস্বীকার করেননি, বরং চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকে তাঁর হাতে সাম্প্রতিককালে ঘটা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিগ্রহের ঘটনার একটি তালিকা তুলে দিলে তিনি জানিয়েছিলেন, তালিকাভুক্ত ঘটনাগুলির চেয়েও বেশী সংখ্যক নিগ্রহ বাস্তবে ঘটেছে, সেই খবর তাঁর কাছে আছে। অথচ রাজ্য পুলিশের উপরমহলের বক্তব্যে মনে হচ্ছে এই বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানেন না।

না, পুলিশ কর্তারা মাইক হাতে ঘোষণা করেন নি যে রাজ্যে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে না। বস্তুত এমন কথা বলা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয় যেহেতু অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকগুলি এফআইআর তাঁরা নিতে বাধ্য হয়েছেন, এবং কিছুদিন আগে তাঁদের নিজেদের অফিসার কলকাতার একটি হাসপাতালে ডাক্তার পিটিয়ে হাতের সুখ করেছেন। অতীতে তাঁরা ফেসবুক পোস্ট দিয়ে সেসব ঘটনার সাফাই গাইবার চেষ্টা করেছেন, যা প্রত্যাশিত কিন্তু অনভিপ্রেত। সম্প্রতি চিকিৎসক নিগ্রহ সংক্রান্ত মামলাগুলির বর্তমান স্থিতি জানতে চেয়ে রুজু করা একটি আরটিআই আবেদনের উত্তরে তাঁরা জানালেন, এই বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান বা তথ্য তাঁরা রাখেন না।

publive-image কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে জারি করা সচেতনতা প্রচারমূলক পোস্টার। ছবি সূত্র: ফেসবুক

এই নির্লিপ্ত উত্তরটার গুরুত্ব কীরকম? ধরা যাক, হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে ভর্তি হয়ে আপনি জানতে পারলেন, সেই চিকিৎসক হৃদরোগ বিষয়ে কোনো পড়াশোনা করেন না এবং করতে আগ্রহী নন, তাহলে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে? সেই উদাসীন, বিমুখ চিকিৎসকের উপর কি আর ভরসা রাখবেন আপনি? রাজ্যের চিকিৎসকেরাই বা কী করে ভরসা রাখবেন রাজ্য পুলিশের উপর, এই উদাসীনতা দেখার পর?

বস্তুত, একে পুলিশের দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ না বলে দায়িত্ব এড়ানোয় আগ্রহ বলাই হয়ত সমীচীন হবে। এর জন্য ব্যক্তি পুলিশ আধিকারিকদের দোষও দেব না। ভুলে গেলে চলবে না যে পুলিশকে অনেক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। সত্যকে অবলম্বন করে নিজেদের বিবেক অনুসারে কাজ করার স্বাধীনতা সর্বদা তাঁদের থাকে না। হয়ত চিকিৎসক নিগ্রহে প্রশ্রয় দেওয়াই তাঁদের দায়িত্ব, কারণ স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা সংক্রান্ত রাজনীতি এবং ব্যবসার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে এই অশান্তিকে নির্বিঘ্নে বাড়তে দেওয়ার ওপর।

কোনো অপরাধকে সামাজিক স্তরে ব্যাপকভাবে চলতে দেওয়ার সহজ উপায় হলো, জনমানসে এমন ছবি এঁকে দেওয়া, যাতে ঘটনাগুলিকে অপরাধের বদলে স্বাভাবিক মনে হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সংবাদমাধ্যম স্তরে বিবিধ প্রচারের মাধ্যমে এই “লেজিটিমাইজেশন” প্রক্রিয়া নিপুণভাবে সম্পন্ন করা হয়। মূলত সেই উদ্দেশ্যে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী নিগ্রহকে অতি সাধারণ, স্বাভাবিক ঘটনা এবং জনতার ক্ষোভের ন্যায্য প্রকাশ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। গণশত্রু নির্মাণের প্রক্রিয়া এতটাই সুসম্পন্ন যে পুলিশ প্রশাসন অনায়াসে ঘোষিতভাবে উদাসীন থাকতে পারেন সেই নির্মিত শত্রুর বিরুদ্ধে ক্রমাগত ঘটতে থাকা অপরাধ বিষয়ে।

আরও পড়ুন: গণতন্ত্রের গেরো

এই উদাসীনতা বা নৈরাজ্য কীভাবে স্বাস্থ্য বাণিজ্য, আইনব্যবসা ও বীমা ব্যবসাকে পুষ্ট করে, তার সামগ্রিক আলোচনা সংক্ষেপে সম্ভব নয়। আপাতত আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এর রাজনৈতিক প্রয়োজন সম্বন্ধে দু-এক কথা বলা যাক। চিকিৎসক শিক্ষকদের মতো পেশার মানুষদের পেটানোর সুযোগ জনগণের হাতে তুলে দেওয়া আসলে প্রেশার কুকারের সেফটি ভালভের মতো একটি বন্দোবস্ত, যাতে চাপ ও তাপ নির্গত হতে পারে বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে। স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে জনগণের ক্ষোভ বহুমাত্রিক। গ্রামাঞ্চলে বাড়ি থেকে হাসপাতালের দূরত্ব প্রায়শই দীর্ঘ এবং যানবাহনের অভাবে দুরতিক্রম্য। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, এমনকি ব্লক বা মহকুমা স্তরেও, ব্যবস্থা অপ্রতুল।

পরিষেবা ক্রমশ সরকারের হাত থেকে ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে, যাঁরা ব্যবসার কাজে সরকারি বাড়িগুলো ব্যবহার করার অনুমতি পাচ্ছেন। এ রাজ্যে কঠিন রোগের ব্যয়বহুল চিকিৎসা সরকারি খরচে সারানোর জন্য কিছু সুদর্শন বাড়ি ইদানীং তৈরি হয়েছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু বাড়িগুলির যথোপযুক্ত ব্যবহার হওয়ার ব্যবস্থা নেই। এ কথা মুখ্যমন্ত্রীর কানে তুললে তিনি বিনা পয়সায় কিছু ওষুধের বন্দোবস্ত করে দেবেন, কিন্তু ওষুধ ক্রয়, বন্টন বা নিয়মিত জোগানের ক্ষেত্রে বড়সড় গলদ তাঁর একার পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। ওষুধ থাকলেও তা হাতে পাওয়ার জন্য আমলাতান্ত্রিক নিয়মের চক্করে মৃগী রোগীকে করিমপুর থেকে কলকাতার হাসপাতালে এসে সকাল থেকে বিকেল অবধি তিনটি আলাদা লাইনে দাঁড়াতে হয় প্রতি দুই সপ্তাহে একবার। ফলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকে অনেকেরই।

স্ট্রোক (মস্তিষ্কের) বা হৃদরোগের জরুরি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালকে তৈরি করলেও দেখা যায় রোগী সেই চিকিৎসা থেকে লাভবান হওয়ার মতো সময়সীমার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছতেই পারলেন না যানজটের কারণে। অর্থাৎ স্বাস্থ্য পরিষেবা পরিবহন ব্যবস্থার ওপরেও নির্ভরশীল। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রধান স্তম্ভ সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল নয়, বরং পুষ্টি, শুদ্ধ পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা, রোগ প্রতিরোধ (যথা মশক নিরোধ), টিকাকরণ, প্রাথমিক চিকিৎসা, নারী ও শিশু কল্যাণ ইত্যাদি। দুর্ভাগ্যক্রমে এসব ক্ষেত্রগুলি এখনো অবহেলিত। ওষুধের দাম নিয়ে যখন সাধারণ্যে হাহাকার শোনা যায়, ভারত সরকার তখন ওষুধ বিক্রি থেকে কর বাবদ রোজগার বাড়াতে মরিয়া। পৃথিবী জুড়েই বাজার অর্থনীতির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণাটি ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে সকলের জন্য স্বাস্থ্যের দায়িত্ব থেকে সরকারগুলির সরে যাবার প্রবণতা।

আরও পড়ুন: 'পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের মতামত সরকার শুনবে না'

সমস্যাগুলি ব্যাপক মাত্রার, এবং নীতিগত কারণেই বাজার অর্থনীতির সেবক রাষ্ট্র এসবের সমাধান করতে আগ্রহী নয়। কিন্তু ভোট বড় বালাই, এবং শাসক যত ক্ষমতাবান বা অত্যাচারী হন না কেন, জনগণের ক্রোধকে গোপনে ভয় করেন। তাই তাঁরা জনতাকে হয় দাবিয়ে রাখেন অথবা বিভ্রান্ত করেন। এক্ষেত্রে বিভ্রান্তিই হাতিয়ার। স্বাস্থ্য বিভ্রাটের বিশাল সমুদ্রে চিকিৎসক অতি ছোট মাপের মাছ, কিন্তু যন্ত্রণাক্লিষ্ট, হতাশ বা উত্তেজিত রোগী ও পরিজনের সামনে তিনিই থাকেন। যাবতীয় হতাশা ও ক্ষোভ সেই দৃশ্যমান মানুষটির দিকে চালিত করার মতো সহজ আর কিছু নেই।

চিকিৎসকদের (এবং কিছুক্ষেত্রে সেবিকাদের বা অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের) ভিলেন সাজানো তাই আমাদের দেশে একটি সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক স্তরে বা প্রচারমাধ্যমে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ উসকে দেবার যে প্রক্রিয়া দুই দশকের অধিক সময় ধরে চলছে, তা ভুল করে হয়ে যাচ্ছে না, পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে। হাসপাতালে তাণ্ডবের সুযোগ দিলে পার্লামেন্টকে অক্ষত রাখা যায়, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে জরুরি। পুলিশ অতএব সঙ্গত কারণেই এই তাণ্ডবে তেমনভাবে বাধা দিতে পারে না।

পুলিশ বাধা দিতে চায় না, এটা জানা আছে বলে আপনিও একটু হাতের সুখ করে নিতে পারেন ডাক্তার পিটিয়ে। তাই কি করবেন? নাকি বুঝতে চেষ্টা করবেন আদতে এই পদ্ধতিতে রোগী সাধারণের কী ভয়াবহ ক্ষতি করা হচ্ছে? কেমন সেই ক্ষতি? সে কথা আরেকদিন।

(লেখক কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment