'ঈদে ছুটি নাইক্যা এই দেশে'। কালাম মিয়াঁর বড়োই আফসোস। তিনি বাংলাদেশের। বার্লিনে একটি কারখানায় শ্রমিক। খুবই ধর্মপ্রাণ। ৩০টি রোজার একটিও বাদ দেন না। নামাজ পড়েন। ঈদ উপলক্ষে একদিনের ছুটি নিয়েছেন। সমস্যা তাঁর ৮ বছরের কন্যাকে নিয়ে। ছুটি নেই স্কুলে। যেতেই হবে, কামাই করা চলবে না। করলে পিছিয়ে পড়বে। খ্রিস্টমাসে ছুটি থাকে, বড়দিনে ক্লাসের বন্ধুদের নিয়ে মজা করে, বন্ধুদের বাড়িতে যায়, বন্ধুরাও আসে, কিন্তু ঈদে একা। যদিও ঈদে জামাকাপড় কিনে দেন বাবা মা, দিলেও পরে কাকে দেখাবে, কে তারিফ করবে, এই নিয়ে মেয়ের যেমন দুঃখ, বাবা মায়েরও।
দশ বছর আগেও ছিল না, ইদানীং বার্লিনে বাংলাদেশিদের তিনটি মসজিদ। তিনটি অঞ্চলে। পাকিস্তানিদের দুটি, ভারতীয়দের একটি, আফগানিদের একটি। মসজিদেই ঈদের নামাজ আদায়। রোজা উপলক্ষ্যে, মসজিদে-মসজিদে ইফতারি ফ্রি। ভারতীয় উপমহাদেশের ইফতারি (বার্লিনে) নানা সুস্বাদু খাদ্যে ভরপুর। যারা রোজদার নন, তারাও খান। ইফতারি খাওয়া, ইসলামিতে 'সোয়াব'। খাদকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ন্ত।
বার্লিনে সবচেয়ে বড় মসজিদ সৌদি আরবের। ক্রয়েৎসব্যার্গ এলাকায়। অবশ্য তুর্কি-মসজিদের সংখ্যা বেশি। ইরাক-ইরানেরও কম নয়। কম করেও গোটা দশেক। রোজার ইফতারি নিয়ে মসজিদে মসজিদে রীতিমতন প্রতিযোগিতা। কোন মসজিদ কতো ভালো, সুস্বাদু খাবার (ইফতারি) দেবে। সব ফ্রি। যে মসজিদে ভিড় বেশি, নিশ্চিত খাবার পরিমাণ অধিক এবং খাদ্যেরও রকমফের। এই প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য মুসলিমকে কাছে টানা, ইসলামে দীক্ষিত করা। উদ্দেশ্য কতটা সফল অজানা, ফ্রয়েৎসব্যার্গের সৌদি আরবের মসজিদ চত্বরে যে উপচে পড়া ভিড় দেখি, বেশির ভাগই জার্মান। ভিড়ে প্যাঙ্ক (মদ্যপ তরুণ-তরুণী), ভবঘুরে, বেকার। ওরা ইফতারিকে বলে 'আবেন্ডএসেন', অর্থাৎ ডিনার। একাধিকবার নেয়। পেটপুরে খায়। গোটা রোজার মাসে 'আবেন্ডেসেন'-এ আর কোনও খরচ নেই। দুঃখ একটাই, বলে, "বিয়ার কিংবা ওয়াইন নেই, শুধুই সরবত বা জল। কী আর করণীয়!"
ইফতারি খেয়ে, ইসলামি শরিয়তে, নামাজ পড়া অবশ্য কর্তব্য, কিন্তু কোনও জার্মান খাদককে কখনও দেখি নি। না দেখলেও, ইসলাম প্রচারে সৌদি আরব বহু কসরতে মেতেছে। নানা ভাবে। নানা কালচারাল অনুষ্ঠানে। এবং এসব ইসলামি কালচার। প্রকাশ্যে। গতবছর রোজার মাসে সৌদি আরব জার্মানির প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে (জার্মানিতে ৮৩ মিলিয়ন লোকের বাস) বিনামূল্যে কোরান বিতরণ করেছে (কোরানের জার্মান অনুবাদ)। "কত বিলিয়ন ইউরো খরচ ইসলাম প্রচারে, জার্মানিতে?" ঠিক এই প্রশ্নই ছিল পয়লা, এবারের ইউরোপিয় ইউনিয়নের নির্বাচনে জার্মানির কট্টরবাদী ইসলাম-বিদেশি বিদ্বেষী রাজনৈতিক দল এএফডি (অলটারনেটিভ ফ্যুর ডয়েচল্যান্ড)-এর। একই সুর ফ্রান্স-ইটালি-অস্ট্রিয়া-হল্যান্ড-বেলজিয়াম-বুলগেরিয়ার দক্ষিণপন্থী দলগুলোর নেতাদের কন্ঠে। কিন্তু 'খুব' সুবিধে করতে পারে নি। না পারলেও, ইসলাম-বিদেশি বিদ্বেষে ভোটের সংখ্যা বাড়িয়েছে। বাড়তে পারে আগামী নির্বাচনে।
জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশে খ্রিস্টধর্মের প্রতি আস্থায় ঘাটতি লক্ষণীয়, ইউরোপের বহু দেশে চার্চ বিক্রি হচ্ছে, কারণ ধর্মীয়দের উপস্থিতি কম। ফলে, চার্চের খরচাপাতি বেড়ে যাচ্ছে। আয়ও যথেষ্ট নয়। সরকারও সাহায্য কমিয়েছে। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চার্চ বিপদে। বাধ্য হয়ে বিক্রি করছে। ক্রেতা মুসলিম দেশ, বিশেষত সৌদি আরব। কিনে, বড়-বড় মসজিদ বানাচ্ছে। বানিয়ে ইসলাম প্রচার এবং রোজার মাসে বিনে পয়সায় ইফতারি খাওয়াচ্ছে। কে না খেতে চায়? খাওয়ানোর মূল উদ্দেশ্য ধর্মপ্রচারের সঙ্গে রাজনীতিও, কিন্তু বাহুল্য।
জার্মানির কোনও নির্বাচনেই ইসলামিক দল (তিনটে ইসলামিক দল) এক পার্সেন্টও ভোট পায় না। না পেলেও, রোজার মাসে, মসজিদে-মসজিদে, ইফতারিতে জার্মান খাদকের সংখ্যাই বেশি। খেয়ে ঢেঁকুর তুলে খাবারের প্রশংসা করবে, অপেক্ষা করবে আগামী রোজার, কিন্তু কোনও ইসলামি দলকে ভোট দেবে না। না দিক, রোজার মাসে, ইফতারিতে সব ধর্মীয়রা এক কাতারে সামিল। ইফতারি উপলক্ষ্য। "তা হোক ভাইজান," ঢাকাইয়া কালাম মিয়াঁ বললেন, "এই দ্যাশের সরকার ঈদে ছুটি দ্যায় না ক্যান? না দিক, ঈদে আমার বাড়িতে জার্মান কলিগ (কর্মীদের) আইনলাডুং (নিমন্ত্রণ) দিচ্ছি। পায়েস, সিমাই, গোরুর কলিজা খাওয়ামু।"