সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচিত হল। যে কোনও নির্বাচনে বা প্রতিযোগিতায় যেমন হয়, ফলাফলে কেউ খুশি, কেউ অখুশি। নির্বাচনের ফলাফল বিষয়ে টিপ্পনি বা বিশ্লেষণ এই সিরিজের বিষয় নয়। নির্বাচনোত্তর কথাবার্তায় কাজকর্মে যে নৈতিক সমস্যাগুলো চোখে পড়ছে, সেই বিষয়ে দু-এক কথা।
নির্বাচনের আগে প্রচারের যথেষ্ট সময় থাকে। বস্তুত দুটি সাধারণ নির্বাচনের মাঝের পুরো পাঁচ বছরই জনসংযোগ বাড়ানোর এবং নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার সময়। এই সময়ে নিজেদের নীতি অনুযায়ী কাজ করার পাশাপাশি বিপক্ষের বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত প্রচার চালিয়ে যাওয়া যায়। প্রচারের মধ্যে মিথ্যাভাষণ বা ব্যক্তি-আক্রমণ জাতীয় কিছু পদ্ধতি নিন্দনীয়, কিন্তু যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে বিপক্ষের তুলনায় নিজেদের দলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা গণতন্ত্রের ন্যায্য অঙ্গ। একবার হেরে গেলে তৎক্ষণাৎ পরবর্তী নির্বাচনের জন্য কোমর বেঁধে নামা যায়, কিন্তু একটি নির্বাচনের ফল প্রকাশের মুহূর্তে সেটিকে জনাদেশ হিসেবে মেনে নেওয়াই নৈতিক, সেই ফল পছন্দসই না হলেও। অবশ্যই ইভিএম-এর বিশ্বাসযোগ্যতা, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ইত্যাদি নিয়ে তর্ক করা যায় (তা সেসব আশঙ্কা ঠিক হোক বা ভুল), কিন্তু একটা কাজ কোনও মতেই করা যায় না। সেটা হল, ভোটে হেরে জনগণকে মূর্খ বা বিশ্বাসঘাতক বলা। যখনই আপনি একথা বলবেন, তখনই প্রমাণিত হবে আপনি জনগণকে কখনও প্রকৃত বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা করেননি। সেই মুহূর্ত থেকে জনগণ আর আপনাকে শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস করবে কেন? তার পরে আর কোন মুখে সেই অপমানিত জনগণের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন?
আরও পড়ুন, ক্ষমতায় ফিরল বিজেপি, এবার তাহলে কী?
এর চেয়েও অনেক বড়মাপের অনৈতিক কাজ দেখতে অবশ্য অভ্যস্ত আমরা, যার তুলনায় এই বাচিক অসন্তোষের প্রকাশকে মনে হয় নিতান্তই নিরীহ। যেমন দখল-বেদখল-পুনর্দখলের রাজনীতি। যে দল নির্বাচনে জেতে, তারা বিপক্ষের পার্টি অফিসগুলোর দখল নেয়। দখল করে কর্মীদেরও। শুরু হয় মারধর এবং অন্যান্য পদ্ধতিতে চাপ সৃষ্টি। আবার যে দল প্রত্যাশার তুলনায় খারাপ ফল করল, সে যদি মোটের ওপর ক্ষমতাশালী হয় এবং অন্তত রাজ্যস্তরে ক্ষমতাসীন হয়, তাহলে যেসব সাধারণ মানুষ তাঁদের ভোট দেননি, তাঁদের উপর শুরু হবে আক্রমণ। তারপর প্রশাসনের সর্বস্তরে শুরু হয় "আমরা-ওরা" বৈষম্যের খেলা… স্বজনপোষণ এবং "অপর"-এর প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ। বহু বছর ধরেই আমরা দেখছি এই চিত্র, যা রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে প্রায় স্বাভাবিক আচরণ বলে মনে হতে শুরু করেছে এতদিনে। ক্ষমতাসীন দল বা জোটের "পরিবর্তন" হয়, কিন্তু "আমরা-ওরা' রাজনীতির পরিবর্তন হয় না। অদূর ভবিষ্যতে তেমন বদল হবার সম্ভাবনাও নেই।
এসব নিয়ে যখন ভাবছি, তখনই চোখে পড়ল বামফ্রন্ট নেতা শমীক লাহিড়ীর একটি ফেসবুক পোস্ট, যা আপাত দৃষ্টিতে নির্দোষ তো বটেই, এমনকি প্রশংসনীয় বলা যায়। অথচ সেই পোস্টটি পড়েই ধাক্কা খেল আমার চিকিৎসক সত্তা, স্পষ্ট হল আমাদের সমাজ ও সময়ের অবক্ষয়িত চেহারা। ২৪ মে শ্রী লাহিড়ী লিখেছেন, "মহেশতলা থেকে আজ একজন ডা. ফুয়াদ হালিমের কাছে গিয়েছিলেন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে। ডা. ফুয়াদ জিজ্ঞাসা করেন নি, রোগী কাকে ভোট দিয়েছেন। তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এই হল কমিউনিস্টদের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা।" রাজ্য সরকারের হাসপাতালগুলো পরিষেবা দিচ্ছে না, এই ইঙ্গিত দেওয়ার পাশাপাশি তিনি আরেকটি বার্তা দিলেন তাঁর দলীয় প্রার্থীর মহানুভবতা সম্বন্ধে। চরম বৈরিতার পরিবেশে ভারি মিষ্টি একটি পোস্ট। খুশি হওয়াই যায় এবং সেখানেই বিপদ।
আরও পড়ুন, মাঝে মাঝে মূর্তি ভেঙে পড়াই ভাল
ডক্টর হালিম রোগীর রাজনৈতিক আনুগত্য সম্বন্ধে প্রশ্ন না করে সঠিক কাজ করেছেন। আসলে তিনি নিজের কর্তব্য করেছেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, চিকিৎসক হিসেবে। চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে নেবার আগে কিছু শপথ নিতে হয়। একজন চিকিৎসক কখনও ধর্ম, জাতি, বর্ণ, জাতীয়তা, দলীয় আনুগত্য ইত্যাদির ভিত্তিতে কোনো রোগীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। সুতরাং বামপন্থী না হয়ে দক্ষিণপন্থী হলেও যেকোনো চিকিৎসক ঠিক এটাই করতে বাধ্য হতেন, নাহলে নিজের রেজিষ্ট্রেশন খোয়াতেন। শপথ বা আইনের কথা যদি ছেড়েও দিই, তাহলেও সাধারণ মানবিক বোধ বলে যে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক, অন্যথা হওয়া অন্যায়।
নিজেদের প্রশ্ন করা দরকার এমন সহজ স্বাভাবিক কাজটি একজন করেছেন, তা এভাবে ঘোষণা করার কথা একজন বর্ষীয়ান নেতার মনে এল কেন? কেনই বা সেই কথা শুনে আমাদের অনেকেরই বিশেষভাবে ভালো লাগল? আসলে আমরা এমন এক সময়ে বাস করি, যখন নিজের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করাকেও বিরল মহানুভবতা মনে হয়। নির্দিষ্ট স্বার্থ ছাড়া মানুষকে সাহায্য করাকে মনে হয় অস্বাভাবিক। কাউকে সে কাজ করতে দেখলে আমরা সন্দেহ করি। মানুষের ক্ষতি করা, মানুষকে হত্যা করা বরং দৈনন্দিন, প্রত্যাশিত এবং স্বাভাবিক। সকলেই ব্যক্তিস্বার্থকে মোক্ষ মনে করেন এখন। মূল্যবোধের চর্চা একপ্রকার ন্যাকামি হিসেবে গণ্য হয়। পেশা কেবল উপার্জনের পদ্ধতি এবং রাজনীতিও একটি পেশা। অতএব একজন রাজনীতিবিদ ভোটে লড়বেন জেতার জন্য, জিতবেন নিজের আখের গোছানোর জন্য, জেতার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করবেন (যেমনটা করতে হয় ব্যবসায়) এবং জিতে সেই অর্থ সুদে-আসলে উসুল করবেন… এমনটাই যেন হবার কথা। স্বভাবতই জিতলে মোচ্ছব হবে আর হেরে গেলে রাগ, দুঃখ। মানুষকে বিশ্বাসঘাতক মনে হবে, যাঁরা অন্যদিকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের ওপর প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করবে। ক্ষমতাবান ক্রোধোন্মত্ত নেতা-নেত্রীরা দেখে নেওয়ার হুমকি দেবেন। সরকার কোনো প্রতিবাদ বরদাস্ত করবেন না পাঁচ বছর। সরকারের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুললে কোনো রাজা বলবেন দেশদ্রোহী, অন্য কেউ বলবেন মাওবাদী।
আরও পড়ুন, রবীন্দ্রনাথের নাটক ও সমসময়
সরকারি প্রকল্পগুলির প্রাপ্য সুবিধা পেতে গেলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। এমনকি সরকারি হাসপাতালের অর্ধেক শয্যাও নেতাদের সুপারিশ নিয়ে আসা রোগীদের দখলে থাকে, গুরুতর অসুস্থ রোগীরা জায়গা পান না। শিক্ষা থেকে সরকারি চাকরি, সর্বত্র দলবাজি ও দুর্নীতি। এমত পরিবেশে কেউ ভিন্ন ধর্মের বা দলের মানুষের বাঁচার অধিকারটুকু স্বীকার করবেন, এটাও আশ্চর্য লাগে! এই আশ্চর্য লাগাটার চেয়ে বড় আশ্চর্য আর কী আছে? পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে নাকি আমাদের বসবাস!
ডক্টর হালিম আসলে চিকিৎসকের স্বাভাবিক কর্তব্যটুকু পালন করেছেন। তবু এটুকুর জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতে পারেন, কারণ শোনা যায় গুজরাটের গোধরা-উত্তর দাঙ্গার সময় প্রবীণ তোগাড়িয়া নামক এক চিকিৎসক তথা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা কিছু নার্সিংহোমকে মুসলমান রোগী ভর্তি করতে নিষেধ করেছিলেন। আকলাখ হত্যার পর যখন দেশ জুড়ে সেকুলার মনোভাবের মানুষ নানাভাবে প্রতিবাদ করছিলেন, তখন অন্যরকম প্রতিবাদও হয়েছিল, যা স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো। মুম্বাইয়ের এক সংখ্যালঘু মহিলা চিকিৎসক ঘোষণা করে বসেন, তিনি হিন্দু রোগীদের দূর করে দেবেন। সেই ভারতে বাস করে ডক্টর ফুয়াদ হালিম এখনও "হিপোক্র্যাটিক ওথ" ভুলে যাননি বলে তাঁকে ধন্যবাদ। এত সামান্য কারণে তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে বলে গণতন্ত্রের স্মৃতিতে দু'মিনিট নীরবতা পালন করা যাক।
আরও পড়ুন, নির্বাচনী ইস্তেহারে যেসব নাগরিক অধিকারের কথা নেই
চিকিৎসকদের মতোই সাংসদ ও বিধায়কদেরও কিছু শপথ নিতে হয় বিশেষত মন্ত্রিসভায় প্রবেশের আগে। শাসক হিসেবে কাজ করার সময় তাঁরাও দল বা জাত-ধর্ম দেখে কারো প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারেন না। দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও দেশবাসীর উন্নতিকল্পে তাঁদের কাজ করার কথা। এই প্রতিজ্ঞা ভুলে যেতে অবশ্য তাঁদের সময় লাগে না। তাঁদের বিলীয়মান শপথের পিছুপিছু বিলীন হয়ে যায় গণতন্ত্রের যাবতীয় বিধি ও বিধান, শ্বাসরুদ্ধ হয় সংবিধান। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন, তখন প্রহসনে পরিণত হয় সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি। সরকার সামগ্রিকভাবে স্বৈরনীতি অবলম্বন করলে আধুনিক মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের অর্জন গণতন্ত্রের প্রাণসংশয় হয়, এমনকি সেই সরকারের উদ্যোগগুলো ভালো হলেও।
পৃথিবী জুড়েই গণতন্ত্র আক্রান্ত। কোথাও উগ্র দক্ষিণপন্থীদের হাতে, কোথাও বৈপ্লবিক শুভায়নকামী বামপন্থীদের হাতে, কোথাও ধর্মোন্মাদদের হাতে। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে জনগণের ভূমিকাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। তাঁদের কণ্ঠস্বর মন দিয়ে এখন শোনা আবশ্যক কর্তব্য। সাধারণ মানুষের মতামতকে তাত্ত্বিক বক্তা বা নেতাদের মতের সমান গুরুত্ব দিলে তবেই গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হবে। নিজেদের পছন্দসই প্রতিনিধি নির্বাচন করা মানুষের অধিকার। এটা মেনে নিতে হবে, তাঁদের পছন্দ আমাদের পছন্দের সঙ্গে মিলুক বা না মিলুক। যাবতীয় বিশ্লেষণ ও পাল্টা প্রচার শুরু হতে পারে এটুকু মেনে নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েই। মানুষকে মূর্খ বা বিশ্বাসঘাতক দাগিয়ে দেবার বা তাঁদের নির্বাচন মানি না বলে হুঙ্কার দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। তেমন করলে শাসকের স্বৈরতান্ত্রিক ভাষাকেই পুষ্ট করা হয়। বদলে মানুষের পছন্দকে মেনে নিয়ে তাঁদের সচেতন করা যায় যে প্রতিনিধি নির্বাচনেই তাঁদের দায়িত্ব ও অধিকার শেষ হয় না, নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও পাঁচ বছরের জন্য সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হয়ে ওঠেন না। সরকারকে প্রতিদিন নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার নির্বাচকমণ্ডলীর থাকে। জনগণ আসলে স্রেফ ভোটার নন, নির্বাচক। মানুষের শক্তি সামান্য নয়। "তাহারই কৃপার পরে করে দেব মহিমা নির্ভর।" মানুষ সজাগ থাকলে গণতন্ত্র চুরি করার সাধ্য কারো থাকে না। সচেতন মানুষ নিজেই নিজের অধিকারের চৌকিদার।