গত সপ্তাহে, অর্থাৎ সিরিজের ষষ্ঠ পর্বে (সৈনিকের কফিন ও ভোটের বাক্স) আমরা কথা শুরু করেছিলাম পুলওয়ামার ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে। তার প্রেক্ষাপট এবং কীভাবে নিহত সৈনিকের কফিনকে ভোটের সিন্দুকে পরিণত করা হচ্ছে, তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা হয়েছিল। সংঘ পরিবারের পছন্দানুযায়ী জাতীয়তাবাদের রেটরিক কীভাবে তৈরি হয়েছে, এবং সেই সময়ে বামপন্থীসহ বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা কেমন ছিল, সেই বিষয়েও কিছু কথা হয়েছিল পঞ্চম পর্বে (নির্বাচনমুখী জাতি ও জাতীয়তা)। বাকি রয়ে গেছে আরো বেশ কিছু কথা। জাতীয়তাবাদ ও সীমান্তের অশান্তিকে মূলধন করে শাসকদলের (তথা শাসক শ্রেণীর) এই দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রকল্পকে সামলাতে হলে কয়েকটি বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন।
দেশের বা রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান সীমানা দিয়েই চিহ্নিত হয়, তা মেনে না নেবার কোনো কারণ নেই। মানচিত্রে যা সীমানা, রাজনীতিতে তা পরিণত হয় সীমান্তে। সীমানা একটি চিহ্নমাত্র, সীমান্ত একটি দায়। সীমান্ত হল এমন এক রাজনৈতিক বিষয়, যাকে ইংরেজিতে বলা চলে "অ্যাটেনশন সিকিং"। সীমানা নিজের মতো থাকে, সীমান্তকে প্রতি মুহূর্তে রক্ষা করতে হয়। সীমানা মানুষের অবস্থানকে পরিমিত করে বড়জোর, কিন্তু সীমান্ত মানুষকে ব্যস্ত রাখে। সীমানাকে সীমান্তে পরিণত করার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক রাজনীতির অনেকখানি। এর ওপর ভরসা করে চলে এক বিপুল আইনসিদ্ধ বাণিজ্য, যার নাম প্রতিরক্ষা। আর চলে বহুবিধ বেআইনি বাণিজ্য, যেমন মানুষ থেকে গরু হয়ে নানারকম জিনিসপত্র পাচার করার কাজ। দেশের অভ্যন্তরের বহু সমস্যাকে কার্পেটের তলায় লুকোতেও সীমান্ত ও আগ্রাসী প্রতিবেশীর উপস্থিতি কাজে লাগে।
আরও পড়ুন, বিনা প্রস্তুতিতে কেন প্রিয়াঙ্কাকে যুদ্ধে নামানো?
সুতরাং সীমান্তকে ভাঙিয়ে যাঁদের রাজনীতি বা ব্যবসা চলে, তাঁরা সীমান্তকে যথাসম্ভব মোটা রেখায় দাগিয়ে, কাঁটাতারে মুড়ে বেশ ভয় পাওয়ানো আর চিন্তায় ফেলার মতো একটা ব্যাপারে পরিণত করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। এর বিপরীতে বলার ছিল এটুকুই যে সীমান্তই দেশ নয়, দেশের খোলসটুকু মাত্র। দেশের মানুষের ক্ষুধা, অপ্রাপ্তি, ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে, মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলে এই কথাটুকু বলা যেত। তার জন্য সীমান্তের অস্তিত্বকে অস্বীকার বা লঘু করার দরকার পড়ত না। বাস্তবে হাল্লা রাজার যুদ্ধ যুদ্ধ রবের বিরুদ্ধে যেভাবে সীমান্তহীন মনুষ্যত্বের বাণীকে হাতিয়ার করা হয়েছে, তার মধ্যে অতিরিক্ত ভালোমানুষি এবং রাজনৈতিক "স্টেপ জাম্প" ছিল।
এই জায়গায় একটু খটকা লাগতে পারে। সীমান্তকে দেশের চেয়ে বড় করে ফেলার বিপক্ষে বলছি, অথচ সীমান্তহীনতার জয়গান গাইতে ঝাঁপিয়ে পড়ছি না, এ কেমন দ্বিচারিতা? বোঝার জন্য একটু "আত্মপরিচয়" (identity) ব্যাপারটাকে দেখি। প্রতিদিন আমরা প্রত্যেকে যখন একেকজন "আমি" হয়ে ঘুরি, তখন বিভিন্ন পরিচয় গায়ে সেঁটে ঘুরে বেড়াই। যেমন নাম, পদবি, ডিগ্রি, পেশা, ভাষা, ধর্মবিশ্বাস বা অবিশ্বাস ইত্যাদি। সেইসব পরিচয় আমাদের চিহ্নিত করে। যখন "আমরা" হিসেবে থাকি, তখনও নানা পরিচয় থাকে। যেমন ফুটবল মাঠে মোহনবাগান বা ইস্ট বেঙ্গল, মাধ্যমিক পরীক্ষার হলে অমুক স্কুলের ছাত্রী/ছাত্র, ভোটের ময়দানে তমুক দলের সমর্থক ইত্যাদি। জাতীয়তা তেমনি একটি পরিচয়, যা দুম করে ফেলে দেবার নয়। দেশে থাকা অবস্থায় "ভারতবাসী" আমাদের সমষ্টিগত পরিচয়, বিদেশের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তা রীতিমতো ব্যক্তিগত পরিচয়। (অনেক ক্ষেত্রে, যেমন ধরুন বেড়াতে গেলে সেটাই ট্যুরিস্ট ব্যক্তিটির প্রধান পরিচয়।)
আরও পড়ুন, পায়ের ফাঁকে মিসাইল আর লেনিনকে এক ঘুষি
আমাদের অস্তিত্ব ও পরিচয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রই কোনো না কোনোভাবে চিহ্নিত বা সংজ্ঞায়িত। সেই চিহ্ন বা সংজ্ঞা থেকে আমাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে অন্যরা সচেতন হতে পারেন এবং আমাদের চিনতেও পারেন। অস্তিত্ব বা পরিচয় চেনার যোগ্য হতে গেলে, তার একটা সীমানা (boundary) প্রয়োজন হয়। স্ব স্ব ক্ষেত্রে আমরা এই সীমানার মধ্যে স্বচ্ছন্দ থাকি, সুরক্ষিত অনুভব করি, অন্যদের ব্যক্তিগত সীমানাকে সাধারণত সম্মান করি এবং অন্যরাও আমাদের সীমানাকে সম্মান করবে, এই প্রত্যাশা করি। যদি আমাদের সীমানা কোনোভাবে বিপর্যস্ত হয়, তাহলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে বলে আমরা ভয় পাই। এটা প্রতিবর্ত ক্রিয়া এবং এমন প্রতিক্রিয়া হবার কিছু বাস্তব (প্রায়শ জৈবিক) কারণ আছে। এর ফলে আমাদের সীমানা যখন বিনা অনুমতিতে অতিক্রান্ত (invaded) হয়, তখন আমরা প্রতিরোধ করি, এননকি হিংস্র হয়ে উঠি ক্ষেত্রবিশেষে। এভাবে, এমনকি ব্যক্তিগত সীমানাও সীমান্ত হয়ে ওঠে।
একটা সহজ উদাহরণ দিই। আমার শরীরের সীমা চিহ্নিত করে ত্বক। সেই ত্বক শুধু শরীরের আকৃতিকে স্থির রাখে না, বাইরে থেকে অনেককিছুকে শরীরে ঢুকতে বাধাও দেয়। আবার আমরাও আমাদের ত্বকের সীমানাকে যত্নে রক্ষা করি, সে আহত হলে প্রতিরোধ করি। ধরা যাক একজন অতি শান্ত, অহিংস মানুষ খবরের কাগজ পড়ছেন। এমন সময় একটি মশা তাঁর শরীরে হুল ফোটালো। প্রবল সম্ভাবনা যে তিনি প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় একটি চাপড় মারবেন, যাতে মশাটি মারা যাবে অথবা উড়ে যাবে। এর পিছনে তাঁর কোনো সচেতন ভাবনা নেই, হিংস্রতার অনুশীলন তো নেই একেবারেই। আসলে এভাবে নিজস্ব সীমান্তকে রক্ষা না করে জীবের পক্ষে বেঁচে থাকাই কঠিন।
আরও পড়ুন, আমি ভারতীয় মুসলমান, আমার ভয়ের মৃত্যু হয়েছে
আরেকটু মানবিক স্তরে আমরা নিজেদের ব্যক্তিত্ব, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদির সীমানা স্পষ্ট করে এঁকে রাখি। মানবিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এসব বাউন্ডারিকে সম্মান করার কথা বারবার বলা হয়। কেউ সহজভাবে সেই সম্মান না দিলে, নিজের অধিকারের সীমা ছাড়ালে আমরা আমাদের সীমানাগুলোকে দৃঢ়তর সীমান্তে পরিণত করি এবং সেই মানুষের সামনে বেড়া তুলে দিই। নিজের বাড়ি, উঠোনের সীমানায় আমরা বেড়া দিতে শিখেছি ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদের (private property) ধারণা পোক্ত হবারও আগে থেকে, শুধুমাত্র "personal possession"-এর উপর নিজের দখলটুকু কায়েম রাখার জন্য। মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যেও নিজের দখলের এলাকা চিহ্নিত করার চল আছে। তারা বেড়া দিতে জানে না, বদলে ফেরোমন ছড়াতে জানে। জানে যুদ্ধ করতেও। অর্থাৎ সীমানা ও সীমান্ত ব্যাপারগুলো নেহাৎ আধুনিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নয়। মানুষের ও অন্যান্য জীবের যাপনের মধ্যেই আছে তার বীজ। সুতরাং খুব সহজে এই ধারণাটিকে জীবনের সব ক্ষেত্র থেকে মুছে ফেলা যাবে না৷
জাতি-রাষ্ট্র (নেশন স্টেটের খুব ভালো বাঙলা এটাই কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত নই) এবং জাতীয়তাবাদ নিঃসন্দেহে আধুনিক রাজনীতির সৃষ্টি। তা বলে এগুলোও দুম করে কারো একার বুদ্ধিতে হয়নি। দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় মানুষের গোষ্ঠীগত পরিচয় (আইডেন্টিটি) বদলাতে বদলাতে সার্বভৌম শাসনব্যবস্থার একক হিসেবে জাতি-রাষ্ট্রগুলো স্বীকৃতি পেয়েছে। এরই সমান্তরালে জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠেছে আধুনিক রাজনীতির অন্যতম ভিত্তি, ভাষ্য এবং হাতিয়ার। কেমনভাবে জাতীয়তাবাদ ও নেশন স্টেটের ধারণা তৈরি হল এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল, তার আলোচনা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। এই বিষয়ে বেশ কিছু ভালো বই ও আলোচনা আছে৷ আগ্রহী পাঠক বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের "ইম্যাজিনড কম্যুনিটিজ" (Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism) নামক বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
আরও পড়ুন, সাধ্বীর বেলায় আঁটিশুটি!
একসময় জাতীয়তাবাদ প্রগতিশীল এবং বৈপ্লবিক কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। তারপর, আরো অনেক কিছুর মতো, ক্রমশ চলে গেছে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর দখলে এবং ব্যবহৃত হয়েছে গণবিরোধী অসৎ উদ্দেশ্যে। অস্বীকার করা যায় না যে অন্য অনেক সামাজিক মেলবন্ধনের এককের তুলনায় জাতীয়তাবাদ অনেক বেশি অপ্রাকৃত, সচেতনভাবে নির্মিত, চরিত্রগত রাজনৈতিক এবং এর নির্মাণের মধ্যেই উগ্রতার উপাদানগুলো (নিজেদের সবন্ধে অহংকার, প্রতিবেশীকে নিয়ে আশঙ্কা ও অপরের প্রতি ঘৃণা) মেশানো আছে। সুতরাং জাতীয়তাবাদ নবজাগরণ বা স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো কিছু ক্ষেত্রে সাংগঠনিকভাবে উপযোগী হলেও শাঁখের করাতের মতো বিপজ্জনকও বটে। সামলে না রাখলে উগ্র হয়ে উঠে অপরের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে যেমন উৎসাহ দিতে পারে, তেমনি নিজের দেশের ভেতরে শোষণ সংঘটিত করতে তথা প্রতিবাদীকে চুপ করিয়ে দিতেও এর নির্দয় অপব্যবহার সম্ভব।
তাহলে কি সীমান্তহীনতা, আন্তর্জাতিকতার কথাই জোর দিয়ে বলা উচিত নয়? ভারত-পাকিস্তান এক হবার ডাক দিয়ে বা ইন্টারন্যাশনালের গান গেয়ে জগতের অনশন-বন্দীদের শহীদ মিনারের তলায় জমা করলেই হয়। করতে পারলে খারাপ হত না। কোনো একদিন সব রাজনৈতিক সীমান্ত মুছে গিয়ে সব মানুষ বিশ্বনাগরিক হিসেবে বাঁচবে, এই স্বপ্ন আমিও দেখি। কিন্তু ভিড় রাস্তায় ওভারটেক করতে গেলে যেমন অনেকের আর বাড়ি পৌঁছানো হয় না, তেমনি রাজনৈতিক তাড়াহুড়োতেও অনেক সময় লক্ষ্যে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। মনে রাখা প্রয়োজন জাতীয়তাবাদ আধুনিক একটি ধারণা যার জনপ্রিয়তার গ্রাফ এখনও ঊর্ধ্বমুখী, বিশেষত এশিয়া, তথা ভারতীয় উপমহাদেশের মতো এলাকায়, যেহেতু এই অঞ্চলে ধারণাটি দক্ষিণ আমেরিকা বা ইউরোপের চেয়ে দেরিতে এসেছে এবং এখনো তার চকচকে নবীন দেহে মরচে পড়ে যায়নি এসব দেশে। আমাদের এই দেশগুলো ঔপনিবেশিক শাসনকালে প্রবলভাবে অত্যাচারিত ছিল। সেই অবদমন থেকে মুক্তি পেতে যে লড়াই আমাদের পূর্বজরা লড়েছেন, তার ভিত্তি ছিল জাতীয়তাবাদ। এখনো আমরা ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে বিপ্লব বলতে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামকেই বোঝাই৷ মোটের ওপর জাতীয়তাবাদ সাধারণ শিক্ষিত ভারতবাসীর কাছে যথেষ্ট "পজিটিভ" একটা বোধ। উপরন্তু এদেশে জাতিগঠনের প্রক্রিয়াটিই এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতপাত, ভাষাভিত্তিক হানাহানি ইত্যাদি অশুভকে থামাতে, দাঙ্গা রুখতে এখনো "এক জাতি, এক প্রাণ" গোত্রের জাতীয়তাবাদী আবেগের গঠনমূলক ব্যবহার প্রয়োজনীয়। সুতরাং এখনি এদেশে জাতীয়তাবাদের প্রচারকে একটি হিটলারসুলভ ফ্যাসিবাদী প্রকল্প হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করলে সেই যুক্তি অধিকাংশ সাধারণ ভারতবাসীর মনে বিরূপ প্রভাবই ফেলবে। সংঘ পরিবারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে অনেকে নিজের নামের পাশে "দেশদ্রোহী" তকমাটিকে সানন্দে জুড়ে নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধিতাকে দৃঢ় করতে চাইছেন। এটা করতে গিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হবার আশঙ্কা আছে বলে মনে হয়।
আরও পড়ুন, এনআরসি ও নাগরিকত্ব বিল: রাষ্ট্রনীতি বনাম শরণার্থী
বরং প্রাথমিকভাবে মেনে নেওয়া যাক যে বর্তমান পৃথিবীতে জাতি-রাষ্ট্র আছে, জাতীয়তা আছে, সীমান্ত আছে, সীমান্তগুলোতে শান্তির প্রয়োজনও আছে৷ শান্তির উন্নততর মানে আমরা যতদিন না বুঝি, ততদিন শান্তির অন্যতম শর্ত সুরক্ষা। পৃথিবীর কোনো দেশের সীমান্তে সেনাবাহিনী না থাকলে, সব সেনাদলকে সেবাদলে পরিণত করা গেলে খুব ভালো হবে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়া শুরু না করে শুধু ভারতীয় সেনাবাহিনীর একতরফা নিন্দা করা বিশেষ কাজের কথা নয়। যতদিন সীমান্ত আছে, রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অধিকার আছে নিজের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার। যদি সব পতাকাই হয় শান্তির পতাকা, তবে বেশ হয়। কিন্তু যতদিন জাতীয় পতাকা বস্তুটি আছে, তেরঙা পতাকাটি মূল্যবান। ততদিন সেই পতাকা নামালে, ছিঁড়লে, পোড়ালে ভারতীয় হিসেবে বাধা দেবো।
এই ভারতীয়ত্বের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজের দেশের মানুষকে অনেক কাছের মনে হয়, আর তাঁরাও আমাদের দেখতে পান দূরবীন ছাড়াই। তখন অনেক সহজে তাঁদের বোঝানো যায় দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের তফাত, বোঝানো যায় উগ্রতা কেন সকলের পক্ষেই ক্ষতিকারক, বোঝানো যায় যে দেশপ্রেমে তো নয়ই, এমনকি জাতীয়তাবাদেও হিংস্রতা আবশ্যিক উপাদান নয়। তাঁদের বলা যায় যে ত্বক দেহকে শুধু সুরক্ষিত রাখে না, সুস্থ রাখতেও সাহায্য করে। সে শুধু বহিরাগতদের বাধা দেয় না, তার গায়েই বাসা বেঁধে আজীবন বন্ধু হয়ে থাকে অজস্র জীবাণু, যাদেরকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে মেরে ফেললেই শরীরের ক্ষতি৷ এমনকি জীবাণুরাও সকলে শত্রু নয়। হাই স্কুল অব্দি পড়া যেকোনো ছেলে বা মেয়েকে মিথোজীবিতার এই সামান্য কথাটুকু সহজেই বুঝিয়ে বলা যায়।
আরও পড়ুন, মোদী বাংলার ক’জন ভোটারকে বুথে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন?
এরপর সবাই মিলে উচ্চারণ করা যায়, "জয় জওয়ান, জয় কিষাণ"। তারপর শপথ নেওয়া যায়, জওয়ানের রক্ত অকারণ যুদ্ধে ঝরতে দেওয়া হবে না এবং যুদ্ধের দামামার প্রবল আওয়াজে কিষাণের কণ্ঠস্বরকে ডুবে যেতেও দেওয়া হবে না। এই পর্যায়ে বোঝানো যায় যে সীমানা বাস্তব, কিন্তু সীমান্তই সমগ্র দেশ নয়। সীমান্তে গণ্ডগোল লাগিয়ে দেশের ভেতরের সম্পদ লুণ্ঠন করে যে দস্যুরা, তারা সকলেই সীমান্তের ওপারে থাকে না। তাদের বাস আমাদের পাড়ায়, আমাদের শহরে, আমাদের রাজধানীতে। তারা সীমান্তকেন্দ্রিক বিদ্বেষমূলক জাতীয়তাবাদকে উপরে তুলে ধরে আসলে আমাদের দেশপ্রেমকে শ্বাসরুদ্ধ করার জন্য, আমাদের দেশকে হত্যা করার জন্য। এরকম আদান-প্রদানের মাধ্যমেই সবাই মিলে এই বিশ্বাসে পৌঁছানো যায়, যে অন্যের ক্ষতি না করেও আমরা ভালো থাকতে পারি। আমরা ভালো থাকতে পারি যদি আমরা সবসময়ে সমস্যার কারণ খুঁজতে দেশের সীমানার ওদিকে না তাকিয়ে ভেতরটায় নজর দিই, যদি বাইরের শত্রুকে চিনতে গিয়ে অন্দরমহলের বন্ধুকে ভুলে যাওয়ার অভ্যেসটা কাটিয়ে উঠি।
সীমান্তের সীমানা পেরোতে গেলে প্রথমে সীমান্তকে চিনতে হবে তার স্ব-রূপে। সীমান্তকে চিনতে হবে শুধু মানচিত্রে নয়, প্রাত্যহিক যাপনেও। সীমান্তে অপরের উপিস্থিতিকে সহজভাবে নেবার ক্ষমতা অর্জন করতে গেলে নিজের স্বাস্থ্যের উন্নতি প্রয়োজন, আর প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস।
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক। মতামত ব্যক্তিগত)