মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং অকাজে ব্যস্ত রেখে মূল সমস্যাগুলোকে আড়াল করার রাজনীতি নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল আগের পর্বে (“গরু, উকুন ও মানুষ”)। রাজনীতির এই খেলা আমাদের (সাধারণ মানুষের) রাজনৈতিক বোধকে আবিষ্ট করে রাখে এবং নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করে। খেলা হলেও তা নিরাপদ বা নিরীহ কিছু নয়। শুধু কিছু নেতার উল্টোপাল্টা কথাবার্তা, ময়ূরের চোখের জলে ময়ূরীর গর্ভধারণ বা উকুনের সাবল্টার্নত্ব নিয়ে অকারণ বিতর্কই যদি সেই ইন্দ্রজালের একমাত্র উপাদান হত, তাহলে তা বিপজ্জনক হলেও এরকমভাবে সহনীয় হত। বাস্তবে এর চরিত্র আরো ভয়াবহ। হত্যা, ধর্ষণ, দাঙ্গা এর উপাদান। কখনো তার বলি কোনো দুর্বল বা সংখ্যালঘু মানুষ, কখনো দেশের সৈনিক স্বয়ং। কিছু ঘটনা এত ভয়ঙ্কর যে তাদের শুধুমাত্র কোনো বৃহত্তর নাটকের দৃশ্য হিসেবে ভাবা যায় না, ভাবা অন্যায়। নাটকের ছকটি বুঝে ফেলার পরেও এই ঘটনাগুলি থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া অনৈতিক, বরং তাদের নিয়ে ব্যস্ত হওয়াই সঠিক মানবিক কাজ। এসব ঘটনা একেকটি ঐতিহাসিক মাইলস্টোন, রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। যেমন গণহত্যা, গণধর্ষণ অথবা গণপিটুনিতে বা গুপ্তঘাতকের হাতে একক নাগরিকের মৃত্যু। যেমন বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গোধরা-উত্তর দাঙ্গা, ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড ও তার পরবর্তী শিখ নিধন যজ্ঞ। যেমন পুলওয়ামা।
দাঙ্গা ও মেরুকরণ স্বাধীন ভারতে জনপ্রিয় নির্বাচনী হাতিয়ার। এরা দুই ভাই। দাঙ্গার সুষ্ঠু আয়োজন করার জন্য যে প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ধর্মীয় মেরুকরণ। আবার মাঝেমধ্যে ইতস্তত ছোট-বড় দাঙ্গা সংঘটিত করে মেরুকরণকে দীর্ঘজীবী করে তোলা যায়, কারণ উৎসবের স্মৃতি মুছে গেলেও দাঙ্গার স্মৃতি সহজে মোছে না। একটি অঞ্চলে একটি দাঙ্গা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ফাটল ধরিয়ে দিয়ে যায়, পঞ্চাশটি মিলনমেলার পুলটিস লাগানোর পরেও তার দাগ মেলায় না। অতএব দাঙ্গাকারীদের কাজ সংহতিবাদীদের চেয়ে সহজ এবং প্রথম গোষ্ঠীর সাফল্যও বেশি। বিশেষত ভোটের বাক্সে ঘৃণা যেমন লাভজনকভাবে জমা হয়, সৌহার্দ্য তেমন হয় না। অতএব ঘৃণাই নির্বাচন জেতার হাতিয়ার, তা সেই ঘৃণা জাত, ধর্ম, আর্থসামাজিক শ্রেণী বা ভাষা, যার ভিত্তিতেই নির্মিত হোক না কেন? সকলেই কমবেশি ঘৃণার কারবারি হলেও একেকটি দল একেকরকম ঘৃণার নির্মাণ, উদযাপন ও বাণিজ্যিক ব্যবহারে বিশেষভাবে দক্ষ। এই মুহূর্তে দিল্লির মসনদে আসীন দলটি ধর্মীয় ঘৃণা ব্যবসায় বিশেষজ্ঞ। রাজনীতির তাত্ত্বিক বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন, ভারতে যখন যেখানে জাতি-দাঙ্গা হয়, তা থেকে (সাধারণত) বিজেপি লাভবান হয়, যেহেতু হিন্দুত্ববাদ তথা ধর্মীয় মেরুকরণ তাদের (ঘোষিত) অ্যাজেন্ডা। এই কারণে অনেকেরই সন্দেহ ছিল যে লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি সুবিধাজনক অবস্থায় না থাকলে মেরুকরণকে চূড়ান্ত রূপ দেবার উদ্দেশ্যে ২০১৯ এর গোড়ার দিকে বড় মাপের দাঙ্গা হতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় যে পরিমাণ ধর্মীয় উস্কানিমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল বেশ আগে থেকেই, তাতে মনে হচ্ছিল যে এক মহাদাঙ্গার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন, গরু, উকুন ও মানুষ: সময় কাটানোর রাজনীতি
তবু খটকা ছিল দুটো। প্রথমতঃ, ধর্মীয় দাঙ্গা ভারতের মাটিতে যদিও ক্লিশে হয়নি এখনো, তবু বহু ব্যবহৃত এবং পুরনো হয়ে গেছে। তাতে নতুনের মতো চমক নেই। বহু মানুষ দাঙ্গা পছন্দ করেন না। তাঁরা বিজেপিকেই সন্দেহ করবেন এবং হয়ত দাঙ্গা রুখে দেবার চেষ্টা করবেন। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে ভারতব্যাপী দাঙ্গা সংগঠিত করা বেশ কঠিন এবং তার নির্বাচনী কার্যকরিতাও নিশ্চিত নয়। পশ্চিমবঙ্গসহ দেশের কয়েকটি জায়গায় হিন্দু এবং মুসলমান দালালদের মাধ্যমে কিছু ছোট মাপের ট্রায়াল রান করে হাতেকলমে পরীক্ষাও করা হয়েছে। দেখা গেছে, তাতে কিছু মানুষকে মাতিয়ে দেওয়া যাচ্ছে এবং কিছু জমি দখল করা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হচ্ছে না। বিশেষত স্নোবল এফেক্ট দেখা যাচ্ছে না এবং সোশাল মিডিয়ায় যথেষ্ট প্রয়াস সত্ত্বেও দাঙ্গাটি নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে তেমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে না।
দ্বিতীয়ত, হিন্দুত্ববাদ বিজেপির ঘোষিত নীতি হলেও ভারতের মূল ধারার রাজনীতিতে এমন কোনো দল নেই যারা ধর্ম বা জাত নিয়ে রাজনীতি করে না। এমনকি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিও তো সারাদিন ধর্ম নিয়েই কথা বলতে থাকে। হয়ত তারা ধর্মের বিরুদ্ধে বলে, কিন্তু কথা তো আটকে থাকে সেই ইস্যুতেই। ধর্ম(নিরপেক্ষতা)কে, অর্থাৎ প্রকারান্তরে ধর্মকেই তারা মূল ইস্যুতে পরিণত করে এবং সংখ্যালঘু ভোটব্যাংকের দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। নিজেদের প্রয়োজনে এরাও মেরুকরণের খেলায় যোগ দেয় এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্ম নামক বিষয়টিকে অপ্রাসঙ্গিক হতে দেয় না। দাঙ্গাকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় এবং ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত করতে হয়, সেসব তারাও এতদিনে শিখে ফেলেছে। সুতরাং বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ভোটের আগে মহাদাঙ্গার আয়োজন করলেও বড়দার পাতা দই নেপোয় খেয়ে যাবে না, এমন ভরসা কোথায়?
আরও পড়ুন, ভীতি ও অহংকার
অতএব প্ল্যান বি-র প্রয়োজন। ২০১৪য় হিন্দুত্ববাদকে তাকে তুলে রেখে উন্নয়নকে (অর্থাৎ উন্নয়নের স্লোগানকে) হাতিয়ার করেছিল বর্তমান শাসকদল। পূর্বতন সরকারের ব্যর্থতায় সেটা ছিল তখনকার জন্য বাস্তবোচিত। উপরন্ত এই দ্বিতীয় প্ল্যান ব্যবহার করায় আধুনিক শিক্ষিত যুবসম্প্রদায় এবং শিল্পমহলের কাছে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদের হাতিয়ারটি অতিব্যবহারজনিত ক্ষয় থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ২০১৯ এর বাস্তবতা আলাদা। নরেন্দ্র মোদি মনমোহন সিংহের তুলনায় বেশি উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন করে দেখাতে পারেননি৷ তাঁর সরকারের কিছু অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত বরং জনমানসে বিরূপতার সৃষ্টি করেছে। এমতাবস্থায় উন্নয়ন শব্দটি উচ্চারিত হলে, তা মোদি সরকারের বিরুদ্ধে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। তাহলে?
২০১৯এ তাই সংঘ পরিবারের নতুন অস্ত্র জাতীয়তাবাদ। এই রেটরিকেরও নির্মাণ চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। জাতি-দাঙ্গার বদলে জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করার সুবিধা হল, একটি নেশন স্টেটে (বা মাল্টিনেশন স্টেটে) বাস করে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করা যায় না। অতএব জাতীয়তাবাদী রেটরিকের দখল একবার নিজের হাতে নিতে পারলেই কেল্লা ফতে। রেটরিকের ওপর জোর এই কারণেই যে বাস্তবে দেশপ্রেমিক হতে দীর্ঘ শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার প্রয়োজন এবং এই ক্ষেত্রে অনেকেরই ইতিহাস সম্মানজনক নয়।
সংঘ পরিবারের জাতীয়বাদ আবশ্যিকভাবে হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে, নাহলে নিজেদের অনেক সদস্যকেই সেই জাতীয়তাবাদের ভাষ্যে উদবুদ্ধ করা যাবে না। হিন্দু হতে গেলে কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয় না, কিন্তু হিন্দুত্ববাদী হতে গেলে শত্রুর ভূমিকায় ফেজ টুপি পরা মুসলমানের উপস্থিতি খুবই জরুরি। তেমনি দেশপ্রেমিক হবার জন্য শত্রু অপ্রয়োজনীয় হলেও জাতীয়তাবাদী হবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু দেশের প্রয়োজন হয়। সংঘ পরিবারের জাতীয়তাবাদ তাই মূলত পাকিস্তান বিরোধিতার অপর নাম। বস্তুত ভারতের উপস্থিতি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আর আইএসআইকে সেদেশে যেমন সুবিধা দেয়, পাকিস্তানের উপস্থিতি এদেশে আরএসএস-বিজেপিকে ততটাই রাজনৈতিক সুবিধা দেয়। সংঘ মডেলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নির্মাণকল্পে পাকিস্তান এক আদর্শ জুজু। শত্রু মনোভাবাপন্ন প্রতিবেশী ইসলামিক রাষ্ট্র, সন্ত্রাসবাদের নিরিখে যাদের ট্র্যাক রেকর্ড মোটেই ভালো না। ওসামা বিন লাদেন থেকে দাউদ ইব্রাহিম বা মাসুদ আজহার, বহু আন্তর্জাতিক অপরাধীর আশ্রয়স্থল এই দেশ। ভারত বিরোধী কথাবার্তায় এক নম্বর, নাশকতায় ইন্ধন জোগানো ছাড়াও সরাসরি যুদ্ধের ইতিহাসও আছে। তার ওপর মারণাস্ত্র নির্মাণে এবং যুদ্ধ প্রস্তুতিতে সেদেশ বিপুল অর্থ খরচ করে থাকে এবং সম্প্রতি চীনের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে আরো সন্দেহজনক।
আরও পড়ুন, মানুষ, র্যাশনাল অ্যানিম্যাল!
অতএব এই প্রতিবেশীটিকে কোনো না কোনো দল জাতীয় রাজনীতিতে জুজু হিসেবে ব্যবহার করবে, এটাই প্রত্যাশিত। সংঘ পরিবারের রাজনীতির পক্ষে তা সবচেয়ে অনুকূল হয়েছে, এবং সুযোগের সদব্যবহার তাঁরা করেছেন। ভারতীয় মুসলমানদের বদলে শত্রু-দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভারতীয় হিন্দু ভোটারদের এককাট্টা করার চেষ্টা করা সহজতর। সুবিধেমত সেই ঐক্যকে দেশজ “অপর”-এর বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা যায়। কিছু রাজনৈতিক দল ও কর্মী (মূলত বামপন্থীরা) সংঘ পরিবারের এই জুজু দেখানো বা উগ্র বৈরিতামূলক জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করতে চেয়েছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু পদ্ধতি সমস্যাজনক হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে। পাকিস্তানের অন্যায়গুলোকে প্রশ্ন না করে বেছে বেছে তাদের ভালো দিকগুলোর (যেমন সাংস্কৃতিক দিক, কিছু পাকিস্তানি সমাজকর্মীর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী কাজের ঘটনা ইত্যাদি) প্রশংসা করে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে সেকুলার ও বামপন্থী দলগুলোকে পাকিস্তানপন্থী বলে দাগিয়ে দেওয়ার খেলাটা সহজ হয়ে যায়। এভাবে জাতীয়তাবাদ তথা দেশপ্রেমের কপিরাইট বিজেপি-আরএসএসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এই পরিণতির ফলে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। গত দু'-তিন বছরে এই জাতীয়তাবাদী বনাম দেশদ্রোহী নির্মাণের রাজনীতি এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে, যে সরকারকে যে কোনো প্রশ্ন করলেই প্রশ্নকর্তাকে পাকিস্তানে নির্বাসন দেবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিছু অতি বুদ্ধিমান ব্যক্তি আবার এসব হুমকির অদ্ভুত জবাব দিয়েছেন, যার সারমর্ম হল, নির্বাসন স্বাগত, কারণ পাকিস্তান ভারি সুন্দর জায়গা, সেখানকার মানুষজন ভালো, উপরন্তু সেখানে হিন্দুত্ববাদী উপদ্রব নেই। এ হল দ্বিতীয় ভুল। বামপন্থী = পাকিস্তানপন্থী সমীকরণটিকে সঠিক প্রমাণ করার আরো একটি অস্ত্র। এরকম জবাব দেবার আগে সচেতন রাজনৈতিক কর্মীরা ভেবে দেখতে পারেন এরকম একটা কথা আপনাদের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেবার জন্যই কৌশলে আপনাদের উত্তেজিত করা হচ্ছে না তো?
বাস্তবে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার বা ধর্মনিরপেক্ষতা জাতীয় বিষয়ে পাকিস্তান ভারতের চেয়ে উন্নত কিছু নয়, এটা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। আম-ভারতীয় আর ভারত রাষ্ট্র যেমন এক নয়, তেমনি আম-পাকিস্তানি আর পাকিস্তান রাষ্ট্রও এক নয়। একজন পাকিস্তানি গজল গায়ক আমার প্রিয় হতেই পারেন বা একজন পাকিস্তানি নাগরিকের কাজকর্ম মানবিকতার উদাহরণ হতেই পারে, কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রটির ক্রিয়াকলাপ প্রশংসনীয় নয়। এই সরল সত্যটা স্বীকার করে নিয়েই বলা উচিত ছিল যে পাকিস্তান রাষ্ট্র, আইএসআই আর জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর কুকর্মের দায়ে পাকিস্তানি সাধারণ মানুষদের ঘৃণা করা বা ভারতীয় মুসলমানদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলা সুস্থতার লক্ষণ নয়। যদি নিজের দেশের সাধারণ মানুষের বিবেকের প্রতি আস্থা থাকে, তাহলে নিশ্চয় মানবেন যে আলোচনায় ভারসাম্য বজায় রেখে মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের তুলনা করে সৎভাবে মানুষের দরজায় কড়া নাড়লে কথাগুলো বোঝানো হয়ত সম্ভব হত। মানুষের উদারতা, সুফি সাধকের মহত্ব সীমান্তের ওপারের রাষ্ট্রীয় অবদমন বা সহিংস কার্যকলাপের কথা চেপে গিয়ে ওদেশের সাধারণ মানুষ আর ভারত রাষ্ট্রের অত্যাচারী ভূমিকা ইত্যাদি আলাদা বিষয়কে একাসনে বসিয়ে অসঙ্গত তুলনার দ্বারা সাধারণ মানুষের মাথা গুলিয়ে দেবার চেষ্টা ছিল অপ্রয়োজনীয়। এভাবে যে রেটরিকের ঘোলা জল সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ছিপ ফেলে রাজনৈতিক মাছটি ধরে ফেলেছে সংঘ পরিবারের নেতৃবৃন্দ। তাঁরাও গুলিয়ে দেবার রাজনীতিই করেছেন, কিন্তু তাঁরা ব্যবহার করেছেন মানুষের ভয় ও অহংকারকে, নিজেদের পছন্দসই পথে চালিত করেছেন মানুষের অপ্রাপ্তির অনুভূতি, ক্ষোভ ও প্রতিহিংসাপরায়ণতাকে। তাই তাঁদের কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ। শত্রু নির্মাণের যেসব পদ্ধতির কথা এই সিরিজের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে আলোচিত হয়েছিল, সেগুলোর সুচারু ব্যবহার হয়েছে এক দেশের মানুষকে অন্য দেশের মানুষের বিরুদ্ধে হিংস্র করে তুলতে। সেই ক্রোধের ভরসাতেই নির্বাচনী বৈতরণী পেরোনোর পরিকল্পনা শাসকদলের।
আরও পড়ুন, আমাদের (রাজ)নীতি
আদিম আবেগের জোয়ারের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে মনুষ্যত্ব, গণতন্ত্র ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের কথা বলার গুরুদায়িত্ব পালন করার সময় আরেকটু সতর্ক, সরল ও সোজাসাপটা হলে ভালো হত। সাধারণ মানুষের বিচারবুদ্ধিতে ভরসা রাখলে মানবতার লড়াইতে হয়ত তাঁদের পাশে পাওয়া যেত, অন্তত তাঁদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রটি নিষ্কণ্টক থাকত। দায়িত্ব অবশ্য এখনো ফুরোয়নি, সম্পূর্ণ হাতছাড়া হয়নি ভারতকে পুণরায় সুস্থ করে তোলার সুযোগও। কিন্তু প্রচেষ্টায় আন্তরিক ও সৎ হওয়া প্রয়োজন। ভবিষ্যতে আরো দাঙ্গা, আরো বিস্ফোরণে ভারতবাসীর অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের যাবতীয় দাবি সম্পূর্ণ চাপা পড়ে যাবে কিনা, তা নির্ধারিত হয়ে যাবে নিকট ভবিষ্যতেই।
(লেখক আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)