গরু একটি নিরীহ প্রাণী। গরু ঘাস খায়। ঘাস শব্দটির ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করলে পাওয়া যায় “অদ+ঘঞ”, অর্থাৎ যা আহার করা যায়, তাই ঘাস। সুতরাং মানুষও সসম্মানে ঘাস খেতে পারে এবং বাস্তবে তা করে থাকে। এর অনুষঙ্গ হিসেবে আসে জাবর কাটা, যা শিক্ষিত সচ্ছল মানুষের প্রিয়তম কাজগুলির একটি। পেট চালানোর জন্য পরিশ্রমে যাদের হাড়-মাস কালি হয়ে যায় না, তাদের পক্ষে সময়ের ভার দুর্বহ হয়ে ওঠে একসময়। সেই সময়টাকে পার করার জন্য কোনো একরকম নেশার প্রয়োজন হয়। তাস-দাবা-পাশা তিন সর্বনাশা ছাড়াও আছে টাকার নেশা, যা কিছু উদ্যমী মানুষকে অপ্রয়োজনীয় সম্পদের পিছনে ছুটতে উদবুদ্ধ করে এবং ধনকুবেরে পরিণত করে। অপরকে কষ্ট দেবার নেশাও জনপ্রিয়। উদ্যমী ধনকুবেরদের মধ্যে তা হয়ে ওঠে অনেক মানুষকে শোষণ করে তাদের কষ্টের পাশে নিজের বিত্তকে আরো প্রকটভাবে দেখতে পাবার আনন্দ। সাধারণ মানুষও এই আনন্দের ভাগ পাবার চেষ্টা করে থাকেন গৃহ-পরিচারিকা বা ক্ষেত-মজুরদের একটু বাড়তি খাটিয়ে বা খারাপ খাবার দিয়ে। বুদ্ধিমান মানুষদের মধ্যে অর্থ উপার্জনের উদ্যম যাঁদের কম, তাঁদের ভাগে থাকে পরনিন্দা ও চর্বিত-চর্বণ। বুদ্ধিমানেরা বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠার পর এই বিনোদন বর্জন করার নৈতিক দায় তাঁদের থাকে, কিন্তু সকলে তা পেরে ওঠেন না। রাজনীতির বৌদ্ধিক চর্চার মুখ্য নিয়ন্ত্রক এই শ্রেণি। সে কারণেই গরুর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ।
আরও পড়ুন, এই সিরিজের তৃতীয় ভাগ ভীতি ও অহংকার
ভারতীয় গরু একটি রাজনৈতিক প্রাণী। আরো এরকম প্রাণী আছে, যেমন ময়ূর বা উকুন, কিন্তু এই দলের প্রধানা হলেন গরু (স্ত্রীং)। ভারতবাসী গরুকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করেন এবং গরু ভারতীয় রাজনীতিকে (দুব্বোঘাস জ্ঞানে) ভক্ষণ করেন। যতটা অনায়াসে এবং বিপুলভাবে তিনি আমাদের মন, বুদ্ধি, রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাতে প্রতীতি জন্মায় যে গো নিশ্চিতভাবে আমাদের মাতা। যখন দেশের শাসক আর আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী মহল একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ, দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন, তখন আমাদের রাজনীতি বিচিত্রভাবে আবর্তিত হয় গরুর চারপাশে, যেন তাঁকে প্রদক্ষিণ করে পুণ্যার্জন করতে চান ডান-বাম, হিন্দু-অহিন্দু, আস্তিক-নাস্তিক সকলেই। সেই অবসরে লুঠ হয়ে যায় গোয়ালের বাইরের বিস্তীর্ণ স্বদেশ, আমরা গোবলয়ে চরকি-পাক খেতে থাকি। সরকার নিদান দেন গোমাংস ভক্ষণ ও বিক্রয় নিষিদ্ধ। গোরক্ষকের দল সেই অছিলায় প্রকাশ্যে আক্রমণ করে একাধিক মুসলমান সহনাগরিককে। বুদ্ধিজীবীরা স্থির করেন প্রকাশ্যে সদলবলে গোমাংস ভক্ষণ করাই একমাত্র ও যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রতিরোধ... কয়েকজন মিলে মাসখানেকের মধ্যে দেশের অর্ধেক গরু খেয়ে ফেলতে পারলেই যেন মুছে যাবে মৌলবাদ, দারিদ্র্য, অনাহার ও যাবতীয় সমস্যা। আমাদের যাবতীয় বৌদ্ধিক চর্চা ধাবিত হয় গোমাংস ভক্ষণের উপকারিতা (যেমন, গরু না খেলে ভারত কোনোদিন ফুটবলের বিশ্বকাপ জিততে পারবে না), গোমাংস ভক্ষণের ইতিহাস (হিন্দুরা গরু খেত), গোমাংস ভক্ষণের রাজনৈতিক ভাষ্য (বিফ-পিকনিকে অংশ নেওয়া এবং ফেসবুকে গরু খাবার ছবি পোস্ট করাই প্রগতির একমাত্র লক্ষণ), ইত্যাদি নির্মাণে। সেই অবসরে দেশ থেকে “নীরবে” পাচার হয়ে যায় কিছু মোদী, মাল্য, চোক্সি, কালো-সাদা নানা রঙের টাকা এবং আরো অনেক কিছু। একে একে বদলে যেতে থাকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলির চরিত্র। আমরা খেয়াল করি না। এর মধ্যে নোটবন্দি বা গৌরী লঙ্কেশ হত্যার মতো বড়সড় ঘটনা হঠাৎ করে ঘটলে আমরা একটু নড়েচড়ে বসি, কিন্তু বিশেষ কিছু করে উঠতে পারি না, কারণ আমাদের অলস রাজনৈতিক মস্তিষ্ক গরুর লেজে বাঁধা পড়ে গেছে এবং আমরা সংগঠিত নই (বরং গোমাংস আমাদের নিদারুণভাবে বিভক্ত করে ফেলেছে)।
গোমাংস খাওয়া উচিত কিনা বা ধর্মে গরুর অবস্থান কী, তা নিয়ে এত বেশি লেখা হয়েছে গত কয়েক বছরে যে সেই বিষয়ে আর একটি কথারও প্রয়োজন নেই এখানে। বরং বলা যাক ফুটবলের কথা। ফুটবলে “ফলস রান” নামে একটি কৌশল আছে। যখন পেনাল্টি বক্সে বল বাড়ানো হচ্ছে, তখন আগুয়ান স্ট্রাইকার হঠাৎ হুড়মুড় করে দৌড়লেন একদিকে। উপস্থিত ডিফেণ্ডারের দল তাঁর পিছু পিছু সেদিকে ছুটল। অথচ বল তাঁর দিকে দেওয়া হল না, দেওয়া হবে না জেনেই তিনি দৌড়েছেন। বল ঠেলে দেওয়া হল অন্য এক দিকে। একটু পিছন থেকে দ্বিতীয় স্ট্রাইকার এসে নিরিবিলিতে গোল করে গেলেন। দ্বিতীয় স্ট্রাইকারে জন্য ফাঁকা জমি তৈরি করার উদ্দেশ্যেই প্রথম স্ট্রাইকারের এত দৌড়োদৌড়ি। ভারতীয় রাজনীতি জনগণকে বোকা বানানো এবং অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণের প্রকল্প থেকে তাঁদের সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে এমন ফলস রানের উদাহরণ নেহাত কম নয়। গো-রাজনীতি সেই তালিকায় একটি সাম্প্রতিক ও সফল সংযোজন।
আরও পড়ুন, এই সিরিজের দ্বিতীয় ভাগ মানুষ, র্যাশনাল অ্যানিম্যাল!
তবে কি সংঘ পরিবারের গো-রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রয়োজন ছিল না? গোরক্ষকদের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে যাবার প্রয়োজন নেই? আকলাখ হত্যার প্রতিবাদ জরুরি নয়? ব্যাপারটা তেমন নয়। নিশ্চয় এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধের প্রয়োজন আছে। পথে নেমে, আইনের দরজায় কড়া নেড়ে, আন্দোলনের মাধ্যমে বহুমুখী ও সার্বিক প্রতিরোধ প্রয়োজন। পাশাপাশি, কী উদ্দেশ্যে গো-রাজনীতিকে এত বড় করে তোলা হচ্ছে, সেটাও বোঝা প্রয়োজন। গরু বিষয়ক এক-একটি সরকারি উদ্যোগ (যেমন গরুর আধার কার্ড), একেকজন নেতার বিক্ষিপ্ত বক্তব্য আমাদের দীর্ঘ সময় ব্যস্ত রেখেছে। কিন্তু আমাদের প্রতিবাদ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ হয়ে উঠতে পারেনি, কারণ আমাদের কার্যক্রমের মধ্যে আলস্য আর আত্মতৃপ্তি ছিল। ফেসবুকে ছড়া কেটে, বিজেপির আইটি সেলের কিছু কর্মচারীকে খানিক কথা শুনিয়ে নিজেদের সেকুলার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার পাশাপাশি দারুণ আমোদ পেয়েছি আমরা। তৃপ্তি যেখানে আসে, কর্ম সেখানেই শেষ হয়। ফেসবুক-টুইটারেই বৌদ্ধিক জয়ের আস্বাদ পেয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে আর এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রেরণা পাননি। অবশ্যই “নট ইন মাই নেম” আন্দোলন হয়েছে, সেখানে জনসমাগম, গান-বাজনা হয়েছে। বলা হয়েছে, “আমি সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীতে জন্মেছি ঠিকই, কিন্তু আমার নামে এই বিভাজন, এই অত্যাচার চলতে পারে না।” এ বেশ ভালো কথা, গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি। কিন্তু আমার নামটি অপরাধীর তালিকা থেকে বাদ গেলেই কি যথেষ্ঠ? আমার বদলে অমিত শাহের নামে এসব কাজ চলতে থাকলে কি তা অনুমোদনযোগ্য হবে? এই সমাবেশগুলোতে উপস্থিত থেকে কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, নিজের ঘাড়ে চেপে যাওয়া পাপের বোঝাটুকু নামিয়ে ফেলতে পারাই প্রাথমিক লক্ষ্য। তা বলে উদ্যোগটি খারাপ ছিল না। এই আন্দোলনটিকে অবলম্বন করেও আরো বড় মাপের প্রতিরোধ হতে পারত, যদি শহুরে শিক্ষিত কতিপয়ের বাইরে গ্রামে-গঞ্জে বস্তিতে-বাজারে একে ছড়িয়ে দেওয়া যেত সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। যদি তা করার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া যেত, তবে তা হত ধর্মভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রতিরোধ।
“নট ইন মাই নেম” আন্দোলনটি চরিত্রগতভাবে এমন ছিল যে কিছুটা অদলবদল করে তাকে ছড়িয়ে দেওয়াই যেত সর্বসাধারণের মধ্যে। প্রকৃত সামাজিক আন্দোলন হয়ে ওঠার যে শক্তি এই আন্দোলনটির মধ্যে ছিল, বিফ পিকনিকের মধ্যে তা ছিল না। বরং বিফ পিকনিক করে মেরুকরণের রাজনীতিকে কিছুটা সাহায্য করা হয়েছে বলেই মনে হয়। এসব পিকনিক যখন হচ্ছিল, তখন “সহিষ্ণু” “অরাজনৈতিক” হিন্দুদের অনেককে, এমনকি বামপন্থী দলের সমর্থক হিন্দুদের অনেককেও প্রশ্ন করতে শুনেছি, “শুধু গরু কেন? গরুর সঙ্গে শুয়োরের মাংসও নয় কেন?” এভাবে বিভাজন আরো একটু ছড়িয়ে পড়ল। শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হল জনমানসে। প্রতিবাদীদের দ্বারাই যেন প্রকারান্তরে আক্রান্ত বোধ করে আত্মরক্ষাপ্রবণ হয়ে উঠলেন অনেক সাধারণ হিন্দু, বলা চলে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দিকে তাঁদের একটু ঠেলে দেওয়া হল। প্রাক-ব্রিটিশ যুগে সাধারণ হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের অত্যাচার, হিন্দু মন্দিরে গরুর রক্ত ঢেলে দেবার ইতিহাস, স্বাধীন ভারতে সেকুলারিজমের নামে মুসলিম তোষণের গল্প... ইত্যাদি যাকিছু সঙ্ঘ পরিবারের প্রচারে ছিল বহুদিন ধরে, তা শোনা যেতে লাগল সঙ্ঘের বাইরে থাকা, সরস্বতী পূজায় অঞ্জলিটুকু দেওয়া সাধারণ হিন্দুদের মুখে। গোরক্ষা নিয়ে শাসক গোষ্ঠীর তাণ্ডবের বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিরোধ পরিণত হল নিষিদ্ধ মাংস বিষয়ক দলাদলিতে।
আরও পড়ুন, এই সিরিজের প্রথম ভাগ আমাদের (রাজ)নীতি
এরকম বারবার হয়েছে। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে মেরুকরণে অংশ নিয়ে ফেলেছেন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বলা মানুষ ও জননেতারাও। রাজনৈতিক ক্রিকেট খেলায় শাসক গোষ্ঠী যে বলটি ছুঁড়ে দিলেন, তা লেগ স্পিন না গুগলি, সেটা ঠিকমতো নজর না করেই আগেভাগে ব্যাট চালিয়ে দিলে শাসকের হাতেই ক্যাচ ও ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেবার সম্ভাবনা থাকে। আমরা আমাদের ভুলের মাসুল দিয়েছি। আজকের ভারতের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নিশ্চিত ছিলেন যে গরুর তাসটি খেলে আমাদের ব্যস্ত রাখার পাশাপাশি বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করা যাবে। তাঁরা সফল। মহম্মদ আকলাখ তাঁদের মূল শত্রু ছিলেন না, তিনি এই প্রক্রিয়াটির “কোল্যাটারাল ড্যামেজ”। মাঝে মাঝে মনে হয়, তাঁর মৃত্যুর জন্য আমরা সবাই দায়ী। আমাদের রাজনৈতিক প্রবণতা দায়ী। সঙ্ঘ পরিবার যদি জানত যে ভারতের সাধারণ মানুষ থেকে বুদ্ধিজীবী সবাইকে গরু নিয়ে ব্যস্ত রাখা যাবে না, বদলে মানুষের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে তাঁরা চিন্তিত হবেন, একজন নাগরিকের অপমৃত্যুকেও মেনে নেবেন না, একটি হত্যার প্রতিবাদে যে ঝড় উঠবে তা গো-মশকরা বা সুস্বাদু পিকনিকের চেয়ে অনেক জোরালো, তাহলে আকলাখের মৃত্যু হত না।
আরও পড়ুন, রাষ্ট্র, সরকার, দেশ: প্রেম
আমরা যদি এখনো এ নিয়ে ভাবি, শিখি, পাল্টাই, ঘুরে দাঁড়াই, তবে ভবিষ্যতের বহু মৃত্যু, বহু লুণ্ঠন রুখে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু আমরা কি শিখব? নাকি ব্যস্ত থাকব ময়ুরের চোখের জল নিয়ে হাসাহাসি করতে একমাস, তারপর উকুনের সাবল্টার্নত্ব নিয়ে ঠিক ভোটের আগের দেড় মাস? আমাদের এই প্রমোদের আসরে কিছুটা সময় বেশ মজায় কাটবে, কিন্তু ক্রমশ আরো কোণঠাসা হতে থাকব আমরাই। যাদের নিয়ে আমাদের বুদ্ধিমান ও উন্নাসিক হাসিঠাট্টা, তাদেরই হাতে বারবার চলে যাবে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা। ফলস রানের কুহকে বিভ্রান্ত আমরা দরজা আগলাতে ভুলে যাব আবারও।
রাজনৈতিক নাটকে কিছু পরিচালক ভিলেনকে একপ্রকার ক্লাউনে পরিণত করে থাকেন। এটিও একটি রাজনৈতিক কৌশল। তার নানা দিক আছে এবং পরিচালকভেদে উদ্দেশ্যও ভিন্ন। বাস্তবের আসরেও এই কৌশল বেশ কার্যকর। সেসব কথা বারান্তরে।